Amazon

মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৭

ডুয়ার্স ডাইরি: (১০ থেকে ২০ ডিসেম্বর ২০১৬)



পর্ব 1।
আগের দিন চন্দনদা দের এনজেপি থেকে বিদায় জানিয়ে মাঝারি মানের বালাজী হোটেলে রাত কাটিয়ে নিলাম। বন্ধু সুজিত এসেছিলো গপ্পো করতে। ওই হোটেলটা আগের দিন রাতে বুক করে দিয়েছিলো। বেশি রাত অবধি ঘুম না হওয়ায় একটু দেরি করেই উঠলাম। ঘড়ি বলছে 6 টা। এনজেপিতে আগের রাতে শায়ীদ আলীর এসে যাওয়ার কথা হলেও এলো ভ্রমণ শুরুর দিন সকালে। রোগ চেহারা, বাচ্চা ছেলে, এদিকে গাড়ি টেম্পো ট্রাভেলার। গাড়ি ভর্তি 33 কোটি দেবতার ছবি। অর্জুন ট্রাভেলস লেখা। একটু পেছনে পার্কিং করেই গান জুরলো "রঘুপতি রাঘব রাজা রাম"। প্রথমেই হোচট। জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই তোমার নাম শায়ীদ না? অকপট উক্তি "হ্যাঁ, শায়ীদ সৌকত আলী"। ঢোক গিললাম ঢক করে।
এদিকে মোড়ল মানে সুগত বসু ফোনে খবর নিয়ে নিয়েছে ছেলে কেমন, আমি ঘোরের মধ্যেই বললাম ভালই লাগলো। কিন্তু মোড়লের গাড়ি কুয়াশার চক্করে 2 ঘণ্টা দেরিতে ঢুকলো এনজেপি। বেশ কয়েকটি ধূমপান হয়ে যাওয়ার পর দেখি সুকু ফোনে বলছে তারা মডেল ইঞ্জিন জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট। গাড়ি পার্ক হলো। যাত্রীগণ অগুনতি ব্যাগ চাপাতে লাগলো। কিন্তু হটাত্‍ মোড়ল গাড়ির ছাদে কী করতে উঠে পরলো সেই রহস্য আমার কাছে অনেকটা সৌকত এর গাড়িতে 33 কোটি দেবতার উপস্থিতির মতই ঘোলাটে।
যাই হোক, মালপত্র লোড করে চললাম শুনতালেখোলা। এখান থেকেই শুরু হবে ডুয়ার্স যাত্রার সূচনা। চলসা, মালবাজার পেরিয়ে, জলের ও জলের বোতল পূর্ণ করে শুরু হলো যাত্রা। রকি আইল্যান্ড গিয়েই বলে ট্রেক করে ঝুলন্ত সেতু ও নদী দেখতে যাবে। একটু চাপ লাগলো। কিন্তু শুরু করে দিলাম। জঙ্গল ও উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চড়াই পেরতে থাকলাম। আমার এসব অভ্যেস নেই। কিন্তু পড়েছি মোঘলের হাতে। খানা খেতে হবে সাথে। সুকু, সুগত মোড়ল আর অন্নপূর্ণার (কল্যাণী বৌদি) উত্সাহে উঠতে থাকলাম। বয়েস্ক মামা উঠছেন তো আমি পারবো না? হাপাতে হাপাতে আড়াই কিলোমিটার মত হেঁটে পৌছে গেলাম একটা গ্রামে। সেখানে দৃশ্য বড়ই সুখের। ঝুলন্ত ব্রিজ। নিচে বয়ে চলেছে মূর্তি খোলা। মূর্তি নদীর উপনদী হতে পারে। সক্ষম সুকু সমরজিত্‍রা ব্রিজ পেরিয়ে অন্য পাশের গ্রামে ঘুরে এলেও আমার পখ্যে সম্ভব ছিলো না। শুধু ব্রিজ পারাপার করেই এক বোতল জল খেয়ে নিলাম। ক্লান্ত শরীরে জল খোজার সময় মামার (ইনি সুগতদার মামা তাই আমাদেরও মামা) বাড়িয়ে দেওয়া জলের বোতল যেনো মানবিকতার সীমা ছড়িয়ে এক টুকরো হালকা বাতাস। তবে এই সব মানুষের চেষ্টায় 2.5 km ট্রেক করতে পারায় নিজেকে নিয়ে গর্ব হতে থাকলো।
এর পর নেমে আসা। বেশি সময় লাগে নি। ফিরেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এর রিভার ক্যাম্প এ আবার ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে প্রবেশ ও রুম নিয়ে ফ্রেস হয়েই 3 টের সময় লাঞ্চ খেতে ঝাপিয়ে পরা। এর পর বাকি রাতের গল্প। সেটা পরের পর্বে।











পর্ব ২।
সুনতালেখোলা তে আমরা। ঘর পেয়েছি। দার্জিলিং জেলার একটি সুন্দর অঞ্চল এই সুনতালেখোলা। উচ্চতা ৯৫০ মিটার। পাস দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট নদী নাম সুনতালে খোলা, যা একটি নেপালী শব্দ, এর অর্থ কমলা লেবু নদী। সবুজের সমারোহ ও সঙ্গে পাখির আনাগোনা। pond heron, black eagle, hill partridge, red-vented bulbul, ashy wood pigeon, bronzed drongo, white-throated fantail, blue rock thrush, scarlet minivet, lesser racket-tailed drongo, rufous sibia, grey treepie, spangled drongo এবং common green magpie জাতীয় পাখি এখানে দেখতে পাওয়ার কথা।
সুনতালেখোলা রিভার ক্যাম্প নামক থাকার যায়গাটি ভালই। গোলকৃতি ঘরগুলি কাঁচের জানলা দিয়ে ঢাকা। স্নানের জন্য জল গরমের যন্ত্র থাকলেও বিকল। তবে ঘর ও স্নানঘর পরিষ্কার। যদিও সরকারী। ঘরে দিয়ে গেলো এক সিসি সুন্দরবনের মধু, দুটো ব্রাশ, গামছা। ঘর গুলির বাইরে তার দিয়ে সীমানা করা। তারের অন্য প্রান্তে ঘন জঙ্গল। তবে এক ঘর থেকে অন্য ঘর উঁচুতে উঠতে হয় বা নামতে হয়। যেমন রান্নাঘর-খাবারযায়গা অনেকটাই নিচে। সেখানেই অনিতা ম্যাডাম চললেন জন্মদিনের পায়েস তৈরি করতে। আজকে অন্নপূর্ণা কল্যাণী বৌদির জন্মদিন। তারিখ ১০ ডিসেম্বর।
পায়েস রান্না শেষেই ঘর সেজে উঠলো রংবেরং বাল্বএ। কালিম্পং বেকারীর বাটার কেক মোম সজ্জিত হয়ে টেবল জুড়ে। নিয়ে আসা হলো বৌদিকে। বৌদি অবাক। ঝা চকচকে না হলেও সুসজ্জিত জন্মদিন পালন হলো হাততালি ও কেক কেটে বিতরণের মধ্যে। সুখের মুহূর্ত। রাতের খাবার আজকে সুগতদার নামে।
১১ তারিখ ভোর হলো পাখির ডাকে। নানা রকমের পাখির আনাগোনা বেড়েই চলল। নামী দামী ক্যামেরা ঝলসে উঠে বন্দি করতে লাগলো। আজকে শায়ীদ গাড়ি চালাবে না। চালাবে তার কাকা আনোয়ার। সকাল সকাল প্রাতরাশে ডিম সহযোগে তৈরি হতেই গাড়ি এসে পরলো। আবার গাড়িতে মালপত্র উঠিয়ে এগিয়ে যাওয়া পারেনের দিকে। এক স্বপ্নের উপত্যকার মধ্যে দিয়ে।


পর্ব ৩।
আজকে আমাদের গন্তব্য পারেন। জঙ্গলে ঘেরা সুন্দর এক রহস্যময় অংশ। একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পরলাম। রাস্তা অনেকটাই। যাবো ধীরে ধীরে। আজকে আনোয়ার সাহেব গাড়ি চালাচ্ছেন। তিনি খুব একটা রাস্তা চেনেন না। অনেক যায়গায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে করতে যেতে হচ্ছে । সামশিং পেরলো। সামশিং এ কমলালেবু পাওয়া যায়। সামশিং পেরিয়ে খানিক সমতল। ঠিক পাহাড়ের পাদদেশ। তরাই অঞ্চল। মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হলো চা বাগানের। আরও কিছু এগিয়ে গাইরাবাস অঞ্চলে রাবার গাছের থেকে রাবার নিষ্কাশন দেখলাম। মাঝে শর্মার দোকানে দাঁড়িয়ে চা মোমো খাওয়া হলো। আমার, শুকুর ইচ্ছা ছিলো পর্ক মোমো। কিন্তু দোকানের মালিক জানিয়ে দিলেন তিনি শর্মা, তাই তার কাছে এগুলো অচ্ছুত্‍। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম যে আমরা দুজনেই পইতে ধারি জানানোর, কিন্তু তিনি বিশেষ বুঝলেন না, ভাবলেন বাংলায় পইতে ধারি হতেই পারে না।
যাই হোক, মোমো টোমো খেয়ে জলঢাকা ভিউ পয়েন্ট থেকে সুন্দর নদিখাত ও আশপাশের ছবি নিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। ধীরে ধীরে আবার পাহার চড়ে ফেললাম।
পারেন দার্জিলিং জেলার পূর্ব সীমান্তের একটি ছোটো গ্রাম। বলাচলে এখান থেকেই শুরু ডুয়ার্স। দুয়ার বা door শব্দটি থেকেই এসেছে ডুয়ার্স। ভুটানে পণ্য চলাচলের বাণিজ্যিক রাস্তার ভারত-ভুটান সীমান্তে এই অঞ্চলটি আক্ষরিক অর্থে দরজা বা দুয়ার। পাশেই নেওরা ভ্যালী জঙ্গল। এখান থেকেই শুরু। এক দিকে বয়ে চলেছে জলঢাকা। কয়েকটি ছোট নদী ও ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পৌছলাম পারেন।
পারেন নেচার রিসর্ট এ 4 টে ঘর, পসিমবঙ্গ ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কার্পোরেশন এর অধীন। আমাদের সব কটি ভাড়া নেওয়া। অতিরিক্ত হিসেবে আরও 4 জনের ব্যবস্থা আছে। এই 4 জন কে আলাদা আলদা ঘরে 3 জন প্রতি ঘর অনুসারে থাকতে দিতে হবে। উদ্বৃত্য মোড়ল, বৌদি, আমি আর সুকু। বৌদিকে একটা ঘরে ঢোকান গেলো। কিন্তু বাকি 3 ঘরের অন্তত 2 ঘরে কী ভাবে আমরা 3 ঢুকবো মাথায় এলো না। মোড়ল যোগাড় করলো পরিতক্ত রান্নাঘর। একটু ওপরে কিন্তু ভালই। তবে নিচ থেকে খানিকটা উঠতে হয়। রাতে সমস্যা হতেই পারে। যাই হোক, আপাতত মালপত্র রেখে উঠে পরলাম আবার গাড়িতে। লক্ষ্য বিন্দু। বিন্দু আসলে ভারত-ভুটান সীমান্ত। ভারতীয় দিক থেকে ভুটান যাওয়া যায় না। এক পাশে জলঢাকা নদী। নদীতে বাঁধ দেওয়া। বাঁধের ওপরে রাস্তা পেরলেই ভুটান। আমরা গাড়ি করে প্রায় গেট পর্যন্ত চলেতো গেলাম। কিন্তু গেট আগলে রক্ষী জানিয়ে দিলেন এখানেই শেষ। অগত্যা ভুটান দর্শন ফুংত্সেলিঙ্গ এর জন্য তুলে রেখে আমরা জলঢাকা নদীতে নেমে পরলাম। জল অনেক কম। তবে পাথরে এঁকে বেঁকে স্রোত মোটেই কম নয়। এই জলঢাকার উত্স মেমেঞ্চ লেক বলে জানতাম। সেই লেক আমি সিল্করুট যাওয়ার সময় দেখে এসেছি।
ছবি তুলে, চা মোমো খেয়ে সবাই আবার পারেনে ফিরে এলাম। সন্ধে হওয়ার একটু আগে দিপ্রহরিক ভজন সম্পন্ন হলো। ধীরে ধীরে গাছের ফাঁকে আগুন ধরিয়ে সূর্য নিভে গেলো। সূর্য ডুবতেই ঠান্ডা বেড়ে যায়। আমি সুকু সমর্জীত আমাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এগিয়ে গিয়েও ঠিক রাস্তা চিনতে না পারায় যেতে পারলাম না। এতো রাতে অসম্ভব যাওয়া। মোরলের মাথায় বুদ্ধি ও সুযোগ সন্ধান খুব দ্রুত হয়। আবিষ্কার করে ফেললো ওদের স্টোর রুম। সেখানে গাদা গাদা কম্বল বিছানা বালিশ। রাতে হালকা নাচ গান হবেই। আমি আছি যে। তবে এখানে আমরা 3 ও সমর্জীত। বাকিরা ঘরেই।











পর্ব ৪।
স্টোর রুম যোগাড় হলো রাত কাটাবার জন্য। কোনও খাট নেই। দুটো গদি। একটি মোড়ল তো একটি ভৃঙ্গী (সুকু) চটপট দখল করেছে। কিন্তু আমাকে শুতে দিতেই হবে। দুজনের মাঝে
মাথা গলিয়ে দিলাম। রাতে একটু আধটু প্রাকিতিক ডাক সারা দিতে হয়েছে। কিন্তু ঘুম জব্বর হয়েছে। কারণ? এটা ওদের লেপ/কম্বল রাখার স্টোর রুম। তাই যত খুশি লেপ কম্বল খুলে গায়ে চাপিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। এই প্রথম সুগত বসু আমার কাছে হার স্বীকার করলো। নাক ডাকায়। ভোরের দিকে প্রতিযোগিতায় হেরে জেগে শুয়ে ছিলো।
পরদিন সকালে অর্থাত্‍ ১২ ডিসেম্বর উঠেই দেখি আহা কী প্রকৃতির রূপ। আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। আজকে ঢুকবো জঙ্গলে। মামা মামি ও আরও এক পরিবার থাকবেন ধুপঝোরা হাতি শিবিরে আর আমরা একদম জঙ্গল দিয়ে চলে যাবো চাপড়ামারি জঙ্গলের অপর প্রান্তে। পাঞ্জরা রিসর্ট। সেই মত খুনিয়া মোরে পেরিয়ে বাতাবেড়ে মোরে এসে দাঁড়ালাম। এখানে অল্প বিস্তর আর এক প্রস্ত টিফিন খেলাম। আমার ধূমপান সামগ্রী রিফিল করে নিলাম। সোব্যদা এক বাক্স মিষ্টি নিলেন। এখানেই শুনলাম আগের রাতে হাতি আক্রমণ করেছিলো লোকালয়ে। একজন মারা গেছেন। শীতকালে খাদ্যভাস বদল না করতে পারায়, জঙ্গলে খাদ্যের অভাব হাতিদের লোকালয়ে নিয়ে আসে। প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের। দুর্ভাগ্য ক্রমে আমাদের গাড়ি সেই নিহতের বাড়ির পাস দিয়েই ধুপঝোরা চললো।
বেস খানিকটা উন্মুক্ত প্রান্তর নিয়ে ধুপঝোরা হাতি শিবির। এখানে হাতিচড়ে পশু দর্শনে যাওয়া যায়। মামা মামিদের নামিয়ে দিয়ে হাতিশাল ও হাতির গোবর দেখে আমরা চললাম পাঞ্জরা। পাঞ্জরা যেতে গেলে চাপড়ামারি জঙ্গল আরাআরি অতিক্রম করতে হয়। আমাদের থাকার কথা ছিলো চাপড়ামারি ফরেস্টবাংলোতে। কিন্তু বিশেষ সরকারী অথিতি আগমন ঘটায় আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছে পাঞ্জরা। ডুয়ার্স ঘোরায় এই একটি অসুবিধা থাকবেই আপনার সঙ্গী।
চাপড়ামারি ফরেস্টবাংলোরপাস দিয়েই চললাম। কাছেই ফাকা মাঠে নুন ঢিপি করে রাখা। বন্য পশুদের শরীরে নুনের প্রয়োজন মেটাতে তারা এই নুনের ঢিপিতে আসে নুন খেতে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দর্শন হয়ে যায়। ভ্রমনার্থীদের সুবিধার জন্যই এই ব্যবস্থা। সকালে আমরা সেরকম কিছু দেখতে পেলাম না। পাঞ্জরা রিসর্ট পৌছলাম, একদম ঘন জঙ্গল পেরিয়ে। আলদা করে সাফারি করতে হলো না। রিসর্টটি মূর্তি নদীর অনেকটা ওপরে। জঙ্গল প্রান্তে। এর পরে লোকালয়। অপূর্ব ৩০০ ডিগ্রী ভিউ। এখন অবধি কোনও জন্তু কাছে আসে নি। শুধু সুনতালেখোলায় একটি জোঁক দংশন ছাড়া সেভাবে কোনও বন্যপ্রানের দর্শন হয় নি। রিসর্টের একপ্রান্তে একটু দূরে রেল লাইন ও রেল ব্রিজ।
রিসর্টথেকে খাওয়াদাওয়া করে বেরিয়ে পরলাম ওই সল্ট পিটের সামনে যেতে। গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে থাকলো। হটাত্‍ সুগতদা সামনের সিট থেকে বলে উঠলো, "বাইসন বাইসন"। জঙ্গল থেকে এক ধুসর বাদামি বাইসন প্রায় ১০০ মিটার দূরে আমাদের গাড়ির সামনে। ইয়া মোটা।









পর্ব ৫।
শায়ীদ গাড়িটা একটু থামাতে দেরি করে ফেলেছিলো। তাই বাইসন আবার জঙ্গলে লুকিয়ে পরলো। কিন্তু গাড়ি থেমে গেলো। একটু পিছিয়ে। ও সাহস পেলো না। ওর কথা মত বাইসন গাড়ি উল্টে দিতে পারে। কিছু সময় অপেক্ষা, আবার ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে চাপড়ামারি টাওয়ার এ । দূরে সল্টপিট। এখন দেখছি কিছু ময়ুর ও বকের আমদানি। আর কিছু বকবক করা মহিলাদল। কার বাড়ি কবে কে কটুকথা বলেছিলো সেই নিয়ে আলোচনা। এমনি জন্তু দেখতে চুপচাপ থাকতে হয়। কিন্তু এদের বক বকানির বিরাম নেই। জন্তু না দেখে সংসার দেখতেই যেনো এসেছেন। এদিকে মাঝে মধ্যে ময়ুর বাবাজী ডাক ছাড়ছেন। একদল ময়ুরী এসেও হাজির। এদিকে সূর্য ডুবে গেছে। চাপড়ামারি জঙ্গল সাফারি করতে আসা একদল লোক এখন পাঞ্জরা রিসর্ট এর দিকে। সেখানে স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আমাদের সাফারি না করেও এমনি নিমন্ত্রণ। কিন্তু আমরা টাওয়ার এ থাকতেই পছন্দ করলাম। যথারীতি একটু আলো কমতেই বাইসন সাহেব হাজির। কিছু বন্য বরাহ। ময়ূরের দল সরে গেছে। তবে হাতী নেই। আলো কম। ফ্লাশ দিয়ে কিছু করা যাবে না। শুধু মোরলের ক্যামেরায় ভিডিও হচ্ছে। আমার ক্যামেরা অচল। আরও ক্ষণিক থেকে পাঞ্জরা ফেরার পথ ধরলাম। জঙ্গলে ঘন অন্ধকার। গাড়ির সামনের আলো পথ দেখাচ্ছে। অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই প্রায় ২ বার চক্কর কেটে নিলাম। এবার ফেরার পথেও আশাহত হই নি। দেখলাম দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া বেবুন ও একটি হরিণ। অর্থাত্‍ বন্যপ্রাণ দেখা দিতে শুরু করেছে। জঙ্গল রাস্তায় নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কাঁচা মাংসের গন্ধ পাচ্ছিলাম। কিন্তু চিতা জাতীয় কিছু দেখা হয় নি।
রাতের বাকি অংশ সংখিপ্ত। সেখানে আমরা সবাই বসে আড্ডা দিলাম। মামা মামি কে মিস করছিলাম। তাঁরা শুনলাম হাতির পিঠে চেপে গন্ডার দেখেছেন। তাদের ওখানেই পাটজাত দ্রব্যের কারখানা। মামি শুনলাম মন ভরে কেনাকাটা করেছেন। আমরা পাঞ্জরার খাবার খেয়ে, সব্যসাচীদার কেনা মিষ্টি শেষ করে ঘুম।
পরের দিন সকাল উঠেই বেরিয়ে পরা। আজকে আবার চাপড়ামারি জঙ্গল পেরিয়ে যাবো নেওরাক্যাম্প বা কলাখাওয়া। ফেরার পথে একবার টাওয়ার ঘুরে এলাম। জন্তু নেই কিন্তু ধনেশ পাখির আগমন ঘটেছে। বেশ বড় চেহারার ধনেশ।
ধুপঝোরা থেকে বাকীদের তুলে এগিয়ে চললাম। আমিও কিছু চটের জিনিস কিনে নিলাম। আবার বেতবেড়ে হয়ে মূর্তি পেরিয়ে লাটাগুড়ি। এখানে থাকবেন মামারা। আমরা ঢুকবো জঙ্গলে। মামারা চাপড়ামারি সাফারি করবেন, আমরা কলাখাওয়া পৌছলাম। কলাখাওয়া বা নেওরাক্যাম্প আবার একটি জঙ্গল। এখানেও বন্যপ্রাণ প্রতুল। তবে সবুজ একটু কম। ক্যাম্প সংলগ্ন অঞ্চলে একটি নদী আছে। আমরা থাকবো টাওয়ারের ওপরে তৈরি ৪ টে রুমে। খাওয়াদাওয়া অত্যন্ত ভালো। ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পরলাম নদীর ধার ধরে। আমি নদী অবধি গিয়ে ফিরে এলাম। পায়ে ব্যাথা ছিলো। বাকিরা নদী পেরিয়ে চললেন ওপারে গ্রাম দর্শনে। নদীতে পেলাম এক বিশেষ সাপ। সাপ টি সৈকত ক্যামেরা বন্দী করেছিলো। সম্ভবত বোরা বা বিশেষ জাতের।
এখানে ঘন জঙ্গলে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে দেয়নি। কিছুতেই দিলো না। আশা ছিলো বাইসন দেখবো। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু পেলাম না। ময়ূর ও বেশ কিছু রঙ বেরং পাখি দেখলাম। রাতে আমাদের ঘরের তলায় খস খস শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। এসেছিলো নিশ্চয় কোনও পশু। কিন্তু বেরিয়ে দেখার সাহস কারো হয় নি। এই অঞ্চলেও সাফারি হয়। এখানেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও এদিন কিছু দেখলাম না।
রাত শেষ। নতুন যায়গা হাতছানি। আজকে যাবো মূর্তি। সেখানে অপেখ্যা করে আছে রোমাঞ্চ নিয়ে গরুমারা।











পর্ব ৬।
নেওরা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসার পথে একদম গাড়ির পাশেই ময়ুর। যেনো আমাদের বিদায় জানালো।
আজকে যাবো মূর্তি। বেশি দূর নয়। ফেরার পথে আবার মামা মামিকে তুলে নিলাম লাটাগুড়ি মোর থেকে। এখানে গরুমারার সাফারি সিট বুক করতে হবে কিন্তু মোড়ল জানতে পারলো মূর্তি লজ থেকেই ভাড়া করা যায়। গাড়ি একদম লজ থেকে তুলে নিয়ে আসবে। তাই দীর্ঘ লাইন না দিয়ে আমরা পৌছে গেলাম মূর্তিতে। সেখানে বনানী লজ হলো ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট নিগমের বাংলো। সেখানে আমাদের ৫ টি ঘর বুকিং আছে। ৪ টি দ্বিশয্যা বিশিষ্ঠ, একটি ৪ শয্যার dormitory। সুকু, আমি একটি গাছ বাড়িতে উঠে পরলাম। নাম ডায়না। খাবারের জন্য বলে আমরা বেরিয়ে পরলাম মূর্তি নদী দেখতে। বনানীর একদম পাশেই নদী। নদীতে মাত্র একটি স্থানে সামান্য জলের স্রোত। বাকি একদম খটখটে শুকনো। ওই অঞ্চল একটু সাবধানে পেরিয়ে এগোতেই আবার জঙ্গল। এখানেও হাতির গুয়ের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন তেনারা আসেন। জঙ্গল ভেদ করে ক্ষণিক এগিয়ে কিছু না দেখে ফিরে এলাম। স্থানীয় কিছু মানুষ দেখলাম কাঠ সংগ্রহ করছেন। তারা ভয় দেখালো সামনে হাতি থাকতে পারে। যদিও সৈকত ও সমর্জীত এগিয়ে প্রধান সড়কে উঠলেও কোনও হাতির দর্শন পায় নি।
ফিরে এসেই লোভনীয় খাবার। আমাদের পাতে ছিলো মূর্তি নদীর মাছ। সেটা নিয়ে মোরলের ফাজলামি ও এক সদস্যের সশব্দে আপত্তি বেশ জমিয়ে দিয়েছিলো খাবার টেবল।
খেয়ে নিয়ে একটু রেস্ট নিতে না নিতে এসে গেলো সাফারির ছাদ বিহীন জিপ। খরচ এক একটি গাড়ি হিসেবে হয়। সেটি জনপ্রতি হিসেবে ৪00 টাকার কিছু বেশি। এক একটি গাড়ি ৬ জন নিতে পারে। গাড়িতে উঠে পরলাম। আমি পেছনে বসে জাতীয় সড়ক ধরে এগোলাম। গরুমারা গেট থেকে আবার উঠেই দাঁড়িয়ে পরলাম, এবার বসে থাকা যায় না। হাতে ক্যামেরা বন্দুকের মত তাক করা।
গাড়ি এগিয়ে গরুমারা ফরেস্ট বাংলো পেরিয়ে ভিউ পয়েন্ট "যাত্রাপ্রসাদ" এ এসে থামলো। এখানে যেনো হরেক পশুর মেলা। একটু বেশি ওপর থেকেই দেখতে হলো। তাই আমার ক্যামেরা খানিকটা "উকুন" সদৃশ ছবি তুলে শান্ত। একপাল বাইসন, একপাল হরিণ, একপাল বন্য বরাহ, দুটি গন্ডার। সব একটি নদীর ওপারে সল্ট পিট ঘিরে। যেনো সব সাজিয়ে রাখা। এই সব মন ভরে দেখে আবার এগিয়ে চললাম ফরেস্ট বাংলয়ে। এখানে অপেখ্যা করছে আর এক উত্তেজনা।
ফরেস্ট বাংলো পৌছে দেখতে পাচ্ছি কিছু হাতি রাখা আছে। ২-৩ টি। এদের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা ও কুনকি হাতি বানানোর প্রক্রিয়া চলছে। একটা বৈদ্যুতিক বেড়ার মধ্যে। একটু দূরে একটি গন্ডার ও ময়ুর। আমরা ভাবলাম গন্ডারটি পোষা। এগিয়ে যেতে থাকলাম। প্রায় ৩০-৪০ মিটার দূরে থাকাকালীন স্থানীয় ফরেস্ট গার্ডরা চিত্কার করে ওঠে। ওটা পোষা নয়, বন্য। দলছুট। অর্থাত্‍ আরও ভয়ংকর। শুনেই সবার পিছিয়ে আশা শুরু। তবে ক্যামেরা বন্দী সবার।
এবার গাড়ি ছুটল জাতীয় সড়ক ধরে। গন্তব্য স্থানীয় একটি লজ। সেখানে হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একটু এগিয়ে হটাত্‍ গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো। উল্টো দিকের গাড়ির সারিও দাঁড়িয়ে। আলো জেলে। কিছু একটা সংকেত দিলো। আমাদের সাফারির ড্রাইভার সাহেব চেচিয়ে উঠলো "হাতি হাতি"। এক দল হাতি জাতীয় সড়ক অতিক্রম করছে।












পর্ব ৭।
খানিক দূরে হাতি রাস্তা পেরচ্ছে। উল্টোদিকের গাড়ির আলোয় বোঝা যাচ্ছে। যেনো কিছু ছোটো ছোটো পাহাড় এদিক ওদিক করছে। সব থেকে বড় পরিবারের প্রধান হাতি মাঝে দাঁড়িয়ে। বাকিরা তার তত্যাবধানে রাস্তা পেরচ্ছে। দুই দিকের ড্রাইভার ব্যাক গিয়ার এ হাত লাগিয়ে বসে আছে। ৪-৫ টি হাতি রাস্তা পেরলো। মাঝে একবার বড় হাতিটি এদিক ওদিক এগিয়ে পিছিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেলো। মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে সামনের গাড়ি আমাদের পাস দিয়ে হওয়ার বেগে পেরিয়ে গেলো। আমাদের জিপের স্পীড হটাত্‍ বেড়ে গেলো। হওয়ায় উড়িয়ে যায়গা পেরিয়ে গেলো। এদিকে ঠিক ওই অঞ্চলে এসে মোরলের মাথার সাধের পুলিস টুপি উড়ে রাস্তায়। মোরল থামাও থামাও বলে চিত্কার করে উঠলো। কিন্তু ড্রাইভারের থামানোর সাহস নেই। এই নিয়ে এক প্রস্ত বাকবিতণ্ডা। শুনলাম দেশপ্রিয় পার্ক থেকে যাওয়া কোনও ভ্রমণদল এরকম কোনও সাহস দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এদিকে মোরল টুপির দুখে কাতর। ঠিক হলো ফেরার পথে তুলে নেওয়া হবে।
সাফারি জিপ নিয়ে দাঁড় করলো একটি লজে। এখনে চা বিস্কুট সহযোগে আদিবাসী নৃত্য দেখলাম। ভালই লাগলো। ফেরার সময় তুলে নেওয়া গেলো টুপি টা। এখন বাকি আমার ক্যামেরার লেন্সের গার্ড টা। ওটা হারিয়েছে। বোধয় বনানী রিসর্ট এর পার্কে পড়ে আছে। ঠান্ডা ভালই। গাড়ি এখন ঢাকা। বেশ জোরেই গাড়ি চালিয়ে ফিরে এলো বনানীতে। এসেই পার্কে খোঁজ করতেই আমিও পেয়ে গেলাম আমার হারানো জিনিসটা। কল্যাণী বৌদি চলে গেলেন পায়েস রন্ধনে। মালমসলা সৈকত এনে রেখেছে। আজকে অনিতা ম্যাডাম এর জন্মদিন পালন। যদিও জন্মদিন পরের দিন।
পায়েস রান্না শেষে ঘর সাজিয়ে আবার সবাই এক যায়গায়। হ্যাপি বার্থডে গানের সঙ্গে কেক কাটা ও একটু আনন্দ ফুর্তি ঠান্ডা পানিও সহযোগে। রাতে খাবারের পাতে আবার পায়েস সঙ্গে স্থানীয় মূর্তিনদীর মাছ। হাত চেটে চেটে খেলাম।
সকালে বেরিয়ে পরলাম। আজকে একটু দুরেই যাব। কোচবিহার জেলায় ঢুকে পরবো। সেই মত আজকেও সবাই একসঙ্গে থাকতে পারবো না। মোরল, কল্যাণী বৌদির সঙ্গে দুই নন্দী, ভৃঙ্গী থাকবো হলং। বাকিরা থাকবেন জলদাপারা টুরিস্ট লজ।
এই টুরিস্ট লজ রাস্তার ওপরেই। এখানেই বাকীদের সাফারির বন্দোবস্ত হলো। আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। ভালই ছিলো। প্রথমেই খাদা পরিয়ে অভর্থনা জানানো হলো। খাবার ভালই ছিলো। মোরলের ফেসবুক তুতো বন্ধুর লজ।
জলদাপারা যাওয়ার পথে দক্ষিণ খৈরবাড়ি বাঘ ও চিতা উদ্ধার কেন্দ্র ঘুরে গেলাম। এখানে বন্য ও সার্কাস থেকে উদ্ধার করা বাঘ ও চিতা রাখা আছে। কেউ কেউ একটু বৃদ্ধ, কেউ চনমনে। অনেকটা হেঁটে গিয়ে খাঁচায় বন্দীদের দেখা খুব একটা ভালো লাগেনি।
আমরা ৪ জন আবার এগিয়ে গেলাম, গভীর জঙ্গল দিয়ে ঢুকে পরলাম হলং। এই বাংলো সরকারী। এখানে বুকিং ভাগ্যের ব্যাপার। সকল মন্ত্রী ও ভিআইপিগণ এখানেই থাকেন। ভাগ্যক্রমে মোরলের দিদির সাহায্যে ও সিসিএফ বিমল দেবনাথ বাবুর আথিথেয়তায় আমাদের ৪ জনের একটি ঘর জুটে গেলো। আর ডুয়ার্স নামক জায়গার যে মাধুর্য সেই রস আস্বাদনে একটা অন্য মাত্রা জুটে গেলো।
পৌছেই একটু ফ্রেশ হয়েই ছুটলাম হাতি স্নান দেখতে। হলং এর নদীতে একপাল পোষা হাতি স্নান করছে। মাহুত কুল ঘষে মেজে পরিষ্কার করছে। বাচ্চা হাতিটি স্নানে অনীহা। তাকে ধরে বেঁধে স্নান করান হলো। সব দেখলাম একটু ওপরে দাঁড়িয়ে। এদিকে সাফারি দল হাজির। আমাদের বাকিরা।
হাতি স্নানের অতীব দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দর্শনের পরে এগিয়ে গেলাম সল্টপিটের কাছে। এখানে এত কাছে সল্ট পিট কল্পনা করা যায় না। আর অদ্ভুত হলো এই বাংলোতে কোনও বেরা নেই। বাংলোর বাইরে ছোট্ট খাল। খাল পেরলেই সল্ট পিট। সেখানে সব রকম পশুর আনাগোনা। দু একটি এদিকে চলে এলেও অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু প্রায় অন্ধকার হতে চলল। কোনও পশুর দেখা নেই। কী বিপদ। মন খারাপ। সবে ঘরে ফিরতে যাব, বাংলোর গার্ডরা চেচিয়ে উঠলেন। বাইসন বাইসন। ওই ১০০-২০০ মিটার দূরে বাইসন। এখন ১-২ জন। এর পরে শুরু আসল শো।

পর্ব ৮।
এর পরে চোখের সামনে যেনো বিভীন্ন টিভিতে দেখা পশুদের চ্যানেল গুলির জীবন্ত দৃশ্য উপস্থিত। বাইসন সাহেব একটু নুন খেয়েছেন কী খান নি, এক বন্য বরাহ উপস্থিত। এদিকে ময়ুরের দল ক্রমাগত চিত্কার করছে। বরাহ দেখেই হোক বা অন্য কারণে, হটাত্‍ বাইসন পাই পাই করে ছুটে একটু দূরে চলে গেলো। এখন আর সূর্যের একটুও আলো নেই। ঘন অন্ধকার। কিন্তু চাঁদের আলো আছে। আর আছে ইয়া বড় ঝলমলে সার্চ লাইট। ওখানকার গার্ড গণ লাইট নিয়ে আমাদের দেখাতে থাকলেন। কালো কালো পাহাড়ের মত কম করে 16-17 টি বন্য হাতি উপস্থিত। দলে যেমন দাঁতাল আছে তেমন ক্ষুদে বিচ্ছুও আছে। এরা সবাই নদী পেরিয়ে এসেছে। সবার পায়ে জল এমন ভাবে লেগেছে যেনো মোজা পরা। আর বিশ্বাস করা মুশকিল, এদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব খুব বেশি হলে 20 ফুট। মাঝে ছোট্ট খাল সদৃশ্য নদী। গার্ড মহাশয় একটু হুমকি সুরে সবাইকে পিছিয়ে যেতে বললেন। একটি বড় দাঁতাল হাতি রেগে আছে। ছুটে এলে মুশকিল। আমরা গুটি গুটি 3 তলায় উঠে দেখতে লাগলাম। সার্চ লাইট ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। আলো অংধারীতে দেখছি দুটি গন্ডার উপস্থিত। আমার ক্যামেরা নিরুপায়। কিন্তু সুগত মোড়লের ক্যামেরা খুব সুন্দর ভিডিও তুলছে।
গন্ডার গণ কোনও রাখঢাক না করে একজন সোজা সল্ট পিটে ঢুকে খেতে লাগলেন। হাতিকুল একটু পিছিয়ে গেলো। একজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে খেয়াল রাখছিলেন। একটু ছোটো একটা হাতি গণ্ডারের দিকে এগতেই গন্ডার ধাওয়া করলো খানিকটা। হাতিরা পিছিয়ে গেলো। এই ছবি ক্রমাগত চলতেই থাকলো। প্রথম আসা বাইসন ও বরাহটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। কখন সুযোগ আসবে।
ইতি মধ্যে এলেন সিসিএফ সাহেব, বিমল দেবনাথ বাবু। অতি অমায়িক ভদ্রলোক। ইনি জঙ্গল ভালোবাসেন। তার সঙ্গে গল্প হলো। তাঁর অভিজ্ঞতা শোনা একরোমাঞ্চ। কোনদিন তিনি লিখবেন। তিনি সার্চ লাইট আমাদের দিতে বলে গেলেন। যেনো হাতে চাঁদ পেলাম।
বিমল বাবু চলে যেতেই সার্চ লাইট চলে এলো। আমরাও মনের সুখে দেখতে লাগলাম। একবার হাতির পাল তো গন্ডার। কিছু পরে এলেন একদল বাইসন। চোখ জলজল করছে। সবাই পেট পুরে নুন খেয়ে চলে যাচ্ছেন। সব শেষে হরিণের পাল। spotted ডিয়ার। এক পাল। এই শো সারা রাত ব্যাপী। বেশি উপভোগ করেছে সৈকত। তার আমাদের নাসিকা গর্জনে ঘুম আসছিলো না। তাই সারা রাত জেগে সার্চ লাইট নিয়ে দেখে গেছে মাঝেমদ্ধে। আমাদের দর্শন ভরে মনের শেষ কোনা পর্যন্ত স্মৃতিতে ভরে তো নিলাম, কিন্তু কেউ লেখা পড়ে বিশ্বাস করবেন কিনা সন্দেহ। সবাইকে বলব অন্তত একবার হলং থাকুন 2 রাত।
পর দিন ভোর 6 টায় তৈরি হয়ে নিলাম হাতির পিঠে চড়ব। নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে হেলতে দুলতে গজরাজ আগমন ঘটালেন। এনার নাম বোধয় রণবীর ছিলো। দুদিক করে মোট 4 জন আমরা একসঙ্গে উঠে পড়লাম একটু উঁচু প্লাটফর্ম থেকে। হেলতে দুলতে সল্টপিটের পাস দিয়ে চললেন জঙ্গল দর্শনে। সে এক অনুভুতি। আমার প্রথম হাতি চড়া। প্রথমে গজরাজ মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দিয়েই এগিয়ে একটু বড় ঘাসের মাঠে এনে ফেললেন। পেরলেন দুটি ছোটো নদী। সেখানে চকিতে একটি শম্বর দেখলাম। এদের ছবি তোলা খুব মুশকিল। অত্যন্ত দ্রুতগামী। বেশ খানিখন ঘোরাঘুরি করে কিছু না পেয়ে ফিরতে লাগলাম। হটাত্‍ এক অন্য হাতির মাহুত পাখির ডাক দিতে থাকলেন। বাকি সব হাতিগুলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাছপালা ভেঙে সেইদিকে এগিয়ে গেলো। জঙ্গলের খোচা ভালই লাগলো আমাদের গায়ে ও পায়ে। তবে গিয়ে দেখলাম একটি বিশাল গন্ডার। একদম আমাদের হাতিগুলির পাশেই। গাছের পাতা খাচ্ছে। আমাদের দিকে হেলদোল নেই। ক্যামেরা গর্জে উঠল। মন ভরে সামনে থেকে দেখে ফিরে এলাম। পয়সা উসুল কাল রাতেই হয়েছিলো। আজকে সুদ পাচ্ছি। সুগত মোড়লকে ধন্যবাদ। কিন্তু সেতো হাতির পিঠ থেকে নামবেই না। আটকে গেলো। প্লাটফর্ম থেকে এক রক্ষী, সুকু, মাহুত, তিন জনে টেনে নামাতে পারে না। এদিকে আমি আর বৌদি নিচে দাঁড়িয়ে হেসেই চলেছি।













পর্ব ৯।
হাতির পিঠ থেকে মোড়লকে নামান গেলো। এদিকে এক বিপদ। ঠিক ছিলো আজকে একদল থাকবেন নীলপাড়া ফরেস্ট বাংলো, একদল বরদাবাড়ি মালঙ্গী লজ ও আমরা চার জন মানে নন্দী ভৃঙ্গী সহ অন্নপূর্ণা থাকবো মেন্দাবাড়ি। সব গুলো কাছা কাছি।
কিন্তু বিপদ হলো মেন্দাবাড়ি বুকিং আমার ও মোড়লের ভুল বসত একদিন পড়ে। অর্থাত্‍ যেদিন সবাই একসঙ্গে রায়মাতাঙ্গ থাকবো সেদিন। এদিকে রায়মাতাঙ্গ অনেক দূর। প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। একটা চাপা চিন্তা খেলে গেলো মোড়লের সঙ্গে আমাদের। কিন্তু মোড়ল যেনো ক্যাপ্টেন কুল। আগে বাকীদের পৌছে তবেই ভাবতে বসবেন, আগে একদম নয়। সেই মত জলদাপারা টুরিস্ট লজ থেকে বাকীদের গাড়িতে তোলা হলো। চললাম টোটোপারা দেখতে। একদম খটখটে শুখনো দুটি নদী পেরিয়ে, প্রচুর ধুলো উড়িয়ে অনেক সময় নস্ট করে ভুটান বর্ডার পেরিয়ে প্রায় ১ কিমি ভুটানে ঢুকে গেলাম। সায়ীদ এদিক ভালো চেনে না। জিজ্ঞাসা করতে করতে অনেকদুর পৌছে জানতে পারলাম যতই পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তর এই টোটো উপজাতির গ্রাম একটি ভ্রমণ কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরুক আসলে তারা তাদের গ্রাম, জীবন যাত্রা সব পরিবর্তণ করে ফেলেছে। অর্থনৈতিক সহায়তা প্রচুর পেয়ে সাদা নীল বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। অনেকটা হেঁটে ওঠা যাবে একটা গ্রামে, তবে সে নতুন কিছু নয়।
ডুয়ার্স হলো রাভা , টোটো, সন্তাল প্রভৃতি উপজাতির বাসস্থান। এর মদ্ধে টোটো উপজাতির ৭০% লোক এই জলপাইগুড়ি-কোচবিহার অঞ্চলে বসবাস করেন বলে এনাদের অঞ্চলটি টোটোপারা নামে পরিচিত। পার্বত্য ডুয়ার্স ও ভুটান সংলগ্ন অঞ্চলে এদের বাস। এরা ইন্দো-মংগোলয়েড গোষ্ঠীর। সাধারণত চাষ ও শিকার এদের প্রধান জীবিকা। সভ্যতা থেকে একটু দুরেই স্বকিয়তায় এদের ঘর তৈরি হয়। এদের গান ও নাচ অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। কিন্তু প্রচুর ধুলো খেয়ে ও গায়ে মেখে, আমরা আলাদা কিছু দেখতে পেলাম না। বিফল মনোরথে অনেক সময় নস্ট করে ফিরে এলাম। কারণ টোটোদের মুলস্রোতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এর মদ্ধে শুনলাম সব্যসাচীদা রা আগের দিন সাফারিতে হলং এর দিকে গিয়ে গন্ডার ও হাতির দর্শন পেয়েছেন।
বেশ কিছু রাস্তা পেরিয়ে তোর্ষা নদী পার করলাম। পাশে কাকার দোকানে চা খেলাম। দোকানটি নদীর ব্রিজের পাশেই। চা খেয়ে পেটে বেশ খিদে নিয়ে হাসিমারা পেরিয়ে ছুটলাম নীলপাড়া। সেখানে মামা ও সব্যদা কে নামিয়ে এগিয়ে চললাম মালঙ্গী লজ। এখানে সমরজিত্‍ দের নামান হলো। ওরা এখান থেকে চিলাপাতা জঙ্গল সাফারি করবে। কিন্তু আমরা?
এবার শুরু আমাদের থাকার যায়গা অনুসন্ধান। এত রাস্তা সায়ীদ যেতে চাইছে না। আমাদের উপায় নেই। এদিকে ক্রমাগত মেন্দাবাড়িতে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা ও বিফল হওয়া। অগত্যা কালিচিনি হয়ে সায়ীদকে রাজি করিয়ে চললাম রায়মাতঙ্গ। পথে হ্যামিলটনগঞ্জ বাজারে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারলাম তখন ৩ টে। সেভাবে কিছু পেলাম না। সায়ীদ সহ ৪ জনের ভাত জুটলেও সুকু কে ম্যাগী খেতে হলো।
আবার একরাশ ধুলো গায়ে মেখে প্রায় বিকেলে পৌছলাম রায়মাতাঙ্গ। ছবির মত সুন্দর একটি গ্রাম। একটি বুজে যাওয়া নদী পেরিয়ে যেতে হয় ঠিক কিন্তু পাস দিয়ে রায়মাতাঙ্গ নদী বয়ে চলেছে। অঞ্চলটি পার্বত্য। আমাদের আবার পাহাড় চড়তে হয়েছে। এখানে ফরেস্ট বাংলো আছে। কিন্তু আমাদের থাকার ঘর নেই। ফরেস্ট বাংলোতে কেউ থাকার পার্মিশন দিতে পারলো না। যে হোমস্টেতে কয়েকজন থাকার কথা, তারাও সেদিন ভর্তি। পরিস্থিতি এমন যে গাড়িতেই না থাকতে হয়। আমাদের সমস্যা নেই, কিন্তু সঙ্গে বৌদি আছে যে। সূর্য ডুবতে চলেছে। এদিকে রাতে হাতির উপদ্রব আছে।


পর্ব ১০।
রায়মাতাঙ্গ ধীরে ধীরে সূর্যাস্ত দেখছে। আমরা গাড়ি নিয়ে এ গলি ও গলি ঘুরে সুনাখারে বলে একটি সুবিশাল লজ পেয়ে গেলাম। সুইমিংপুল থেকে শুরু করে লজ, লন সব আছে। ঘর মধ্য মানের। কিন্তু কিছু করার নেই। দুটি রুম ১০০০ টাকা করে নিয়ে নিলাম। গরম গরম চা চলে এলো। ঠান্ডা ঠান্ডা জলেই ঘষে ঘষে গায়ের নোংরা তুললাম। শান্তিতে হাত পা ছড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। অপূর্ব সুন্দর। দূরে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে সূর্য নেমে গেলো। সামান্য বিদ্যুত্‍ বিভ্রাট হয়েছিলো। অন্ধকার রায়মাতাঙ্গ ঘিরে তখন চন্দ্রদয়। পাহাড়ের মাথা থেকে জঙ্গল ভেদ করে চাঁদমামা সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে উঠে পড়লেন।
মোড়ল সুকু গেছিলো পরের দিনের বাকীদের থাকার কথা পাকা করতে। প্রথমে ঠিক ছিলো ৪ জন ফরেস্ট বাংলো আর ৪ জন গুরাস বলে একটি বাংলোতে থাকবেন। কিন্তু বলা যায় আমার ইচ্ছাতেই ফরেস্ট বাংলোতে কাউকে না রেখে সরযূ কারকির সুনাখারেতেই রাখা মনস্থির করলেন। আমার কাছে ওই বাংলো একটি ভূত বাংলো ছাড়া কিছু লাগে নি। বরং দৃশ্য এখানে অনেক ভালো।
সকালে মোড়ল সুকু একটু এগিয়ে নদীপাড়ের জঙ্গলে গেছিলো। কিছু পাখি ধরে নিয়ে এসেছে ক্যামেরায়। আমি যাই নি। তৈরি হয়ে খুব সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথম তুলে নিলাম সব্যদা ও মামাদের। যদিও ফরেস্টবাংলো তবে অতিরিক্ত বিমান ও ট্রেনের শব্দ ছাড়া আর কিছুই পান নি ওনারা। বাংলো খুব সুন্দর ছিলো। পুরোনো ব্রিটিশ স্থাপত্তে তৈরি। এনারা কোথাও সাফারি করেন নি। কিন্তু করেছে সমর্জীতরা। এরা চিলাপাতা জঙ্গল সাফারি করেছে ও হাতিসাফারি করেছে। গাড়িতে যাওয়ার সময় একপাল হাতিও দেখেছে। হাতির তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে।
এদের সবাইকে তুলেনিয়ে চললাম সোজা ফুণ্টসেলিঙ্গ। এটি ভুটান ঢোকার এক মাত্র পথ। প্রথমে কুমির সংগ্রহশালা, এখানে আমি আগে গেছি বলে ঢুকিনি, তার পরে বৌদ্ধ বিহার। বিহারের মাথা থেকে শেষ ভারতীয় ভূখণ্ড জয়গাও সম্পুর্নরূপে দেখা যায়। পাশে বয়ে চলেছে নদী। তোর্ষা।
ফুণ্টসেলিঙ্গ সম্পুর্নরূপে ভুটানের অংশ। এই একটি দ্জংখা বা রাজ্যে ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বিনাবাধায় ঢোকা যায়। জয়গা থেকে ভুটান গেট পেরিয়ে ঢুকতে হয়। বৌদ্ধ বিহারটিতে মন্দির যেমন আছে, তেমন বিলাসিতার অঙ্গ হিসেবে ক্যাফেটেরিয়াও আছে।
ফুণ্টসেলিঙ্গ থেকে ফিরে জয়গাতে দাঁড়ানো হলো। সমরজিত্‍ পরিবার, মামা মামি ও বৌদিদের আর এক প্রস্থ কেনা কাটা শুরু।
আধ ঘণ্টা সময় দিলেও এক ঘন্টার আগে শেষ হলো না।







পর্ব ১১।
মার্কেটিং শেষে দেখা গেলো সমরজিত্‍ প্রায় পুরো জয়গা কিনে ফেলেছে। আমার নিজের এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ঘোরা। আমার মতামত হলো, এই অঞ্চল এমনকি সল্টলেক থেকেও দামী। তার প্রমাণ আমি পেলাম এক পেকেট গোল্ড ফ্লেক 38 এর বদলে 50 টাকায় কিনতে হয়েছিলো। এর আগে ভুটান ভ্রমণের সময় একটি 100 টাকার ব্যাগ 160 টাকায় কিনে আমি বুঝেছিলাম এখানে কিছু কেনা বোকামি। এখান থেকে ভুটানী জনগণ দ্রব্য কিনে নিয়ে যায়। তাদের দেশে আরও দাম হওয়ায় এখানে তাদের পছন্দ। স্থানিয় দোকানিরা সেই সুযোগ নেন।
তবে অন্নপূর্ণার দাবিতে মোড়ল মহাদেব আমাদের সব্বাইকে আইসক্রিম খাওয়াল। মুখ চললো, কেউ কমলালেবু তো কেউ মাজা ম্যাংগো। গাড়ি চলতে শুরু করলো রায়মাতাঙ্গ, আমাদের দ্বিতীয়বারের জন্য চক্কর শুরু। রাস্তায় আজ হ্যামিলটনগঞ্জ এ অন্য হোটেলে কব্জি ডুবিয়ে খাসি খেলাম। পেট ভালো নয়, হোটেল খুব একটা পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু খাসি পেয়েই পেট যেনো ঠিক হতে শুরু করলো। খাওয়া দাওয়া শেষে আবার ভাটপারা চা বাগান হয়ে রায়মাতাঙ্গ। এই রাস্তাটি খুব সুন্দর। দুই দিকে চা বাগান। মাঝে রাস্তা বয়ে চলেছে। মাঝে বর্ডার গার্ডরা করা পাহারায় রেখেছেন। সব্যদা দের লালিগুরাস, সমরজিত্‍ দের আমাদের হোমস্টে টায় ছেড়ে আমরা আবার ফিরলাম এক পথে। মালঙ্গী লজ পেরিয়ে আসামের দিকে যাত্রা শুরু। কী বিপদ। অনেক কষ্টে প্রায় 4 টে নাগাদ মেন্দাবাড়ি পৌছে শুনি রেঞ্জার সাহেব আমরা আসি নি বলে রুম ক্যান্সেল করে দিয়েছেন। কেউ নেই সেখানে। চুড়ান্ত অসভ্য আচরণ। এই রকম আচরণ করলে অচিরেই মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বিশ্ব বাংলা থেকে বিশ্ব বাদ হয়ে যাবে। সুকু রেগে যেতে ও মোড়ল এগিয়ে যেতে শান্ত হলো। দেখাসোনা করার লোকটিকে ডেকে আনলো। ইনি ভদ্রলোক মানুষ। আমাদের যত্ন করেই সুন্দর একটি অ্যাপার্টমেন্ট দিয়ে দিলেন। একটি বসার ঘর সহ দুটি লগোয়া ঘর। সেখানে একটি আমরা ও একটি বৌদিরা নিলেন। বসার ঘরে ভূরিভোজ হলো মুড়ি ও পকড়া দিয়ে। সায়ীদকে পাশের সাধারণ শয্যা বিশিষ্ট একটি রুম এ রাখা হলো। সামনেই হাতিশাল আছে। দুটি সরকারী হাতির গাছ খাওয়া দেখে এলাম। রাত কাটতে লাগলো। এরকম ঘর আমরা মূর্তিতে পেলেও মোড়ল এই প্রথম পেলো। খুব খুশি।
তখন 7 টা বাজে, বাংলোর লোকজন ডেকে নিয়ে গেলো। একদম পাশেই বাইসন (গৌড়) এসেছে। বাংলোতে ভাঙ্গাচোরা বেড়া আছে। তার ঠিক ওপাশে স্টাইল করে বাইসন বাবু ঘাস খাচ্ছেন। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। ক্ষণিক দেখে কেউ কেউ অত্যাধুনিক ক্যামেরায় ছবি তুলে ঘরে চলে এলেন। পরের দিন সকালে সাফারি করবো। চিলাপাতা জঙ্গল। বাইরের দুই পশ্চিমবঙ্গ সরকারী কর্মী ঘুরতে এসেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের। তারা আমাদের সঙ্গী হওয়াতে গাড়ি ভাড়া দাঁড়াল ৩২০ টাকা মত প্রতিজনের।
সকাল নয়, ভোর। প্রচণ্ড ঠান্ডা, আমি সোয়েটার পড়েছি কিন্তু মাফলার নিতে ভুলেছি। ফলে ড্রাইভার সাহেবের পাশে বসে। কিন্তু বৌদি ঠান্ডায় কস্ট পাচ্ছেন। আমি অনেকবার বলতেও কিছুতেই সামনে এলেন না। আমাদের গাড়ি জঙ্গলে চললো। প্রাথমিক একটু জঙ্গলে থাকার পরেই সোজা প্রধান রাস্তা। এই জঙ্গলে ঘোরা খুব একটা ভালো লাগে নি। বেশিরভাগটাই প্রধান সড়ক ধরে। কিছুটা জঙ্গলে। তবে আমার সঙ্গে জন্তু জানওয়ারের একটা হার্দিক সম্পর্ক থাকতে পারে। আমি লেপচা জগতে প্যানথার দেখেছি একা, চটকপুরের রাস্তায় লাল হরিণের মত বিরল প্রাণী দেখেছি। তাই এই ঠান্ডায় ও কপালে যুটে গেলো বার্কিং ডিয়ার। অপ্রত্যাশিত। এবং ক্যামেরা তৈরি করতে করতে ছুটে জঙ্গলে। তবে সামান্য হলেও ক্যামেরা বন্দী।
মল্ল রাজার ভাঙ্গা গড় দেখে এগিয়ে গেলাম ভিউ পয়েন্টএ । প্রচুর পাখি ও চোখ জুড়ান তৃণভূমি। চোখে এলো একটি গন্ডার। পাঠক ভাবতে পারেন, প্রায় প্রতি পর্বে আমি লিখছি হয় বাইসন নয় গন্ডার দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্ যনয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার সঙ্গেই এরকম হয়। আমি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বেশ কিছু গন্ডার, বাইসন, ২-৩ রকমের হরিণ, ১৫-১৬ টি জংলি হাতি, রাস্তা পার করা হাতিপাল, বেবুন, ময়ুর, গরুমারা সাফারি শেষে রাস্তা পারকরা বন্য শিয়াল, বন্যমোষ, বন্য বরাহ দর্শন করে ফেলেছি। অনেকবার ডুয়ার্স এসেও অনেকের ভাগ্যে এর ছিটেফোটাও জোটে না।
সাফারি শেষে তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে আমরা কালচিনিতে পৌছে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। সব্যদাদের প্রথমে ৭ টা বললেও পরে ৮ টা বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ি পৌছল ৯ টা। আমরা কালিচিনিতে অপেখ্যমান। স্থানিয় দোকানে জিলিপি খেটেই ব্যস্ত। মিষ্টি কিনলাম। এই অঞ্চলগুলি নেপালী, সাওতালি, বাঙালি ইত্যাদি গোষ্ঠীর মানুষের অদ্ভুত মিশ্রণে এক নতুন সভ্যতা পরিলক্ষিত হয়। এখানে ডুয়ার্স চিরে, পশুদের বিপদ ঘটিয়ে দ্রুতগামী ট্রেন চলছে। বিশেষ করে কাঞ্চনকন্যার মত এক্সপ্রেস ট্রেন ও কিছু লোকাল।
সমরজিত্‍রা চলে এলো। ৮ টা বলে ৯ টায় গাড়ি পৌছনয় এরা একটু বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভোগ শুনে সহমর্মি হলেন। বিশেষ করে সব্যদা। ইনি নিজের সমস্যা থেকে অন্যের সমস্যায় বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন। এবং সেটি মোটেই তথাকতিত লোক দেখানো নয়। মামা মামিও চিন্তিত ছিলেন। তাদের অনেক পরে বলা হয়েছিলো এই কারনেই।
সবাই একত্রিত হয়ে চললাম জয়ন্তী।
পর্ব ১২।
জয়ন্তী যাওয়ার আগে রাজাভাতখাওয়া স্টেশন সামনে দাঁড়াল গাড়ি। নেমে একটু চা খাওয়া হলো। রাজাভাতখাওয়া জঙ্গল বেশ ঘন, কিন্তু আমরা বক্সার দিকে এগিয়ে গেলাম। রাজাভাতখাওয়া জাদুঘর ঘোরা হয় নি। মোড়ল নির্ঘাত কারণ বলতে পারবেন।
বক্সা ঢোকার মুখে পার্মিশন করাতে হয়। জয়ন্তী যেতে গেলেও তাই। মোড়ল পার্মিশন করলো। আমরা বক্সা ফোর্ট যেখান থেকে ট্রেক হয় সেই অবধি গেলাম। ট্রেক কেউ করে নি। তাই এই অঞ্চলে বিশেষ কিছু ঘটে নি। তবে এই রাস্তা ধরে ওপরে উঠলে বক্সাফোর্ট। এই ফোর্ট সম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের সাক্ষী। একটু কস্টকর ট্রেক। তবে রাস্তা খুব সুন্দর। আমাদের গাড়ি চললো জয়ন্তীতে।
জয়ন্তী অপূর্ব এক যায়গা। এখান থেকে কয়েকটি ট্রেক করা যায়, খানিকটা সাফারি গাড়ি গিয়ে খানিকটা হেটে উঠতে হয়। ভুটানঘাট, মহাকাল, পক্ষরি লেকএর মদ্ধে উল্লেখযোগ্য। পক্ষরি লেক অনেকটাই গাড়ি যায়। তারপরে 1 কিলোমিটার হেঁটে উঠতে হয়। এটাই আমরা যাব। তার আগে বনান্তে হোটেলে আমাদের 6 জনের ও সায়ীদের ব্যবস্থা হলো। রায়মাতাঙ্গ এর মত সায়ীদ শুকুর সঙ্গে থাকবে। আমি অন্য খাটে। ভালই ঘরগুলি। তবে হোটেল স্টাফদের ব্যবহার ভালো না। আমি অদ্ভুত লক্ষ করেছি, হোটেল ব্যবসায় বং সন্তান মালিক হলেই একটা অং বং চোং মনোভাব হয়ে যায়। সামান্য সুবিধা দিতেও যেনো গায়ে লাগে। অতিরিক্ত সুবিধা নৈব নৈব চ। অথচ অবাঙ্গালি নেপালী ও ভূটিয়া বিশেষ করে মালিকরা অনেক সময় অতিরিক্ত সুবিধাও বিনাপয়সায় দিয়ে থাকেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আর একজনের এই সভাব খুব খারাপ লাগে।
জয়ন্তী এমন একটি যায়গা যেখানে সমতল, নদী ও পর্বত পর পর। যেনো তুলিতে অঙ্কণ শেখানোর পাঠশালা। জয়ন্তী নদী এখন একদম জল নেই। তার একদিকে হোটেল, একদিকে পাহাড়। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। এখানেই প্রথম সুন্দর সূর্যোদয় দেখেছি ডুয়ার্স ভ্রমণে।
আমরা খেয়ে নিয়ে সামান্য রেস্ট নিয়ে চললাম পোখড়ি লেক। চেকপোস্ট এ স্থানীয় সাফারি করানো লোকেদের সঙ্গে মনমালীন্য হলো। তাদের গাড়ি না নিয়ে আমরা আমাদের গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি বলে তাদের আপত্তি ছিলো। কিন্তু আমরা আপত্তি গায়ে না মেখে এগিয়ে গেলাম। গাড়ি একটি অঞ্চলে গিয়ে থেমে গেলো।
আমি না উঠলেও বাকি 2-3 জন বাদে সবাই ওপরে উঠতে লাগলেন। আমি দাঁড়িয়ে আসে পাশের দৃশ্য দেখছিলাম। ঘটে গেলো টূরের সব থেকে রোমহর্ষক পালা। খাদের দিকে মুখ করে জমিয়ে ধুম্রপানে ব্যস্ত। কল্পনাও করতে পারিনি এখানে কিছু নীচেই কম করে দুটি লেপার্ড জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। বেশ কিছু বাদর গাছে গাছে ঝুলছে ও কিচির মিচির করছে। এদিকটা একটু ফাঁকা। অন্য গাড়ির ড্রাইভাররা সায়ীদের সঙ্গে গল্পে মত্ত একটু দূরে। হটাত্‍ ভাম বেড়ালের প্রায় দুগুন চেহারার লেপার্ড সাহেব চকিতে ছুটে গিয়ে একটি বাদরের বাচ্চা তুলে নিয়ে জঙ্গলে দৌড়েগেলো। সাপে ব্যাং ধরলে যেমন শব্দ হয় তার থেকে তীব্র শব্দ জঙ্গলে গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতে ঢুকে গেলো ভেতরে। সায়ীদ দৌড়ে এলো। তবে দেখতে পায় নি। আর একটি লেপার্ড আর বাইরে বেরোয় নি। সেটিও জঙ্গল ভাঙতে ভাঙতে ওই দিকেই চলে গেলো। আমি এটিকে দেখতে পাই নি। খায়েরবাড়িতে দেখে আসা লেপার্ড থেকে খানিকটা বড়ই। একটু পরেই ট্রেক থেকে বাকিরা ফিরে এলেন। ওপরে একটি ছোট লেক ও তাতে প্রচুর মাছ দেখে এসেছেন। গাড়ি নেমে এলো। সন্ধে পড়ে গেলো। রাতে সবাই আইএসএল এ খেলা দেখতে ও গল্প করতে করতে কাটিয়ে দিলাম।
পরেরদিন সকলেই নদীর পারে হাজির আমরা। অপূর্ব সুন্দর সূর্য উদয় দেখলাম। ভোরের জয়ন্তী যেনো এক রুপসী অস্টাদশী। ভরা বর্ষায় একবার আসার ইচ্ছা রইলো। ধুলো উড়িয়ে সাফারি গাড়িগুলি চলেছে মহাকাল ও ভুটান ঘাটের দিকে। আমরা তৈরি হয়ে নিলাম কোচবিহার হয়ে রসিকবিল যাব বলে। সায়ীদ গাড়ি ধুয়ে নিলো। ছেলেটি খুব কর্মঠ। তবে বাঁধা ছখের থেকে বাইরে আস্তে চায় না। এওদিনের ভ্রমণে আমরা এবার ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আজকে শেষ দিন। গ্রুপ ভেঙে যাবে। হয়তো আবার কোনও ভ্রমণে একসাথে যাব। কিন্তু 12 জনের মধ্যে 10 জনের একটা যেনো পরিবার তৈরি হয়ে গেছে। আজকে দশম দিন। আগের দিন রাতে শুকনো ডাঙ্গায় আছাড় খেয়ে আমার পায়ে টনটনে ব্যাথা।


পর্ব ১৩ ।
চলেছি রসিকবিল। এটা পক্ষীরালয়। বলা হয় ভারতের বৃহত্‍ পক্ষীরালয় গুলির একটি। কিন্তু আমরা আগে কোচবিহার গেলাম। আলিপুরদুয়ার হয়ে। আলিপুরদুয়ার স্টেশন সংলঙ্গ দোকানে প্রাথমিক ভোজন সম্পন্ন হলে গাড়ি চললো কোচবিহার রাজবাড়িতে। এই রাজবাড়ি পশ্চিমবঙ্গে ভালো রক্ষণ ছোয়া পাওয়া খুব কম রাজবাড়ির একটি। কোচবিহারের রাজারা আসেপাশের ভূটিয়া ও নেপালী রাজাদের পরাক্রম সহযোগে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। কোচ নৃপতি মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ১৮৮৭ সালে এই রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। ১২০x৯০ মিটার আয়তন বিশিষ্ঠ এই প্রাসাদ প্রথমে ত্রিতল হলেও ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াতে বর্তমানে দ্বিতল বিশিষ্ঠ। রাজবাড়ি বর্তমানে সংগ্রহশালা। আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে রাজ পরিবারের ইতিহাস ও ছবি। আছে সংগৃহীত উপজাতির ইতিহাস। ভালই লাগলো।
এর পরে মদনমোহন মন্দির গেলাম। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এই মন্দিরটিও নির্মাণ করান। ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৯ এর মদ্ধে। এখানে মদনমোহন, মা কালী, মা ভবানী ও মা তারা বিরাজমান। শুনলাম এখানে রাশমেলা ও রাশযাত্রা হয় ধুমধাম করে। এখানে আমি একটি বই কিনলাম ও মদনমোহনের ছবি কিনলাম। মামীও সামান্য কেনাকাটা করলেন। তবে মন্দিরে ক্যামেরা নিয়ে ঢুকতে টাকা লাগবে শুনে আমি ঢুকি নি। তারপরে
১১ দিন পরে পোশাক এত পরিষ্কার ছিল না।
মন্দির দর্শন শেষে আমরা চললাম রসিকবিল। শহর কোচবিহার পেরিয়ে গাড়ির জ্যাম কাটিয়ে তুফানগঞ্জ শহর পেরিয়ে পৌছলাম একটি পার্ক এ। বাইরে মেলা। ভেতরে একটা বিল ও তার পাশে চিড়িয়াখানা। বিলে বালিহাঁস ও কিছু দোয়েল জাতীয় পাখি ছাড়া সেভাবে চোখে পরার মত কিছু নেই। শুনলাম চিড়িয়াখানায় লেপার্ড আছে। যাব, আগে খেয়ে নিলাম। কল্যাণী বৌদি গেলেন পায়েস রান্না করতে। আজকে মামার জন্মদিন পালন হবে।
আজকে দুটি dormitory রুম নেওয়া হয়েছে। একটিতে ছেলেরা যাদের প্রায় ৮০%
এর ঘুমনোর পর 'এটিকেট' থাকে না । বলা চলে নাকডাকার প্রদর্শনী শুরু করে দেয়। আর একটি ঘরে নারী বাহিনী। আজকে ঘরে ধুম্রপান নিষিদ্ধ।
বিকেলে চললাম চিড়িয়াখানা দেখতে। একটি ঝুলন্ত ব্রীজ পেরিয়ে চললাম। এখানে হরিণ আছে, চিতা আছে। সব ই খাঁচাবন্দী। অনেকেই বেশি হাটতে পারলেন না বলে পরের দিন সকালে ঘড়িয়াল ও পাইথন দেখবো বলে ঘরে ফিরে এলাম। সন্ধায় মামার জন্মদিন পালন হলো। একদিন আগেই। কারণ কালকে ট্রেন। সেখানে সবাই থাকবে না। রাতে একটু উঁচু ওয়াচটাওয়ার মত একটা স্থানে বসে আড্ডা চললো।
এদিকে রাতের খাওয়া শেষ করেই যে যার বিছানায় শুতেই প্রথম নাসিকা গর্জন শুরু করলেন সমরজিত্‍ ও সঙ্গতে মোড়ল, সব্যদা। আমি ইন্টারনেট পাচ্ছিলাম বলে একটু দেরিতে ঘুমিয়েছি। আমি ঘুমোতে যাওয়ার আগে অবধি নাসিকা গর্জন প্রদর্শনী পুরোদমে চালু। ঘুমনোর পর 'এটিকেট' প্রদর্শনীতে মনে হয় আমিও যোগ দিয়েছিলাম। এমনিতে ওই শব্দটির সঙ্গে আমার খুব একটা যোগাযোগ নেই।
[পরের পর্বে সমাপ্ত]


পর্ব ১৪ ও শেষ ।
শেষ দিনের সূর্য উঠে গেলো। সকাল সকাল উঠে আমি সব্যদা ও সুকু গেছিলাম অন্যপ্রান্তে। সেখানে কিছু বন মুরগি, একটি মৃতপ্রায় পাইথন ও সাদাবুক মাছরাঙ্গার দেখা পেলাম। দেখা পেলাম কিছু ঘড়িয়াল। সব খাঁচায়। ঘড়িয়াল ছোট ছোট দুটি পুকুরে। আমরা ফিরে আসছিলাম। এক ভদ্রলোক বাইক নিয়ে আসছিলেন। তিনি ডেকে নিলেন, ঘড়িয়ালকে খাওয়ান দেখতে। আমরা গিয়ে দেখি বস্তা থেকে মাছ ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে আর একদম যুবরাজ সিংহের মত নিখুত হাতে (পড়ুন মুখে), এক একটি মাছ লুফে নিচ্ছে ঘড়িয়াল গুলি। প্রায় ২৫-৩০ টি ঘড়িয়াল। ভয়ংকর সুন্দর। আমরা একটি খাঁচার ধাপ অতিক্রম করে এগিয়ে গেলাম। তবে বেশিখন দাঁড়াই নি। ঘড়িয়ালগণ আমাদের সামনে খেতে লজ্জা পাচ্ছে। যিনি মাছ দিচ্ছিলেন তিনি এক একটি নামে ডাকছিলেন। কাউকে মনা, কেউ খোকা। এই দৃশ্য যেনো শেষ পাতে সন্দেশ।
ফিরে এসেই চটপট রেডি হয়েই গাড়ি ছাড়তে হলো। সমরজিত্‍দের তিস্তাতর্শা এক্সপ্রেস এ টিকিট ছিলো। সেই মত বেরিয়ে কোচবিহার ঢুকে বিশাল জ্যাম। একসময় ট্রেন পাওয়া নিয়ে সংশয় ছিলো। সঙ্গে বাচ্চা আছে। যাই হোক, মোড়ল নেমে জ্যাম ঠিক করলেন, ওরাও নিউকোচবিহার থেকে সময় মতই ট্রেন পেলো।
সমরজিত্‍রা নেমে যেতে আমাদের হাতে অনেক সময় ছিলো। আমরা কোচবিহার শহরে প্রবেশ করলাম। একটি জামাকাপড়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো। থামতেই গাড়ির ভদ্রমহিলাকুল ঝাঁপিয়ে পরলেন। আশেপাশের দোকানগুলি ফাঁকা হতে লাগলো। আমাদের গাড়ি ভর্তি হতে থাকলো। টূর শেষ। বাকি টাকা শেষ করা প্রয়োজন। সব থেকে বেশি কেনাকাটা করলেন মামি। এতটাই যে আলাদা ২-৩ টি ব্যাগ করতে হয়েছিলো। প্রায় ২ ঘণ্টা এত্ত কেনাকাটা হয়েছে যে দোকানদার গাড়ির ভেতরে চা পাঠিয়ে দিলেন আমাদের জন্যও। কেনাকাটা শেষে খাওয়া দাওয়া। মোড়ল ও অন্নপূর্ণা একটি হোটেল খুঁজে বার করেছিলেন। অন্নপূর্ণার খোঁজ, তাই সারা টূরের সব থেকে ভালো বোধয় এখানেই খেলাম। জমিয়ে পাঠার মাংস। কেউ কেউ স্থানীয় মাছ খেলেন। হোটেল টি একজন বাঙালি ভদ্রলোক চালান। সম্পুর্ন ঘড়য়া রান্না। খাওয়া শেষে সবাই স্টেশনের পথ ধরলাম। সেখানেও জ্যাম, সেখানেও মোড়লের স্কিল কাজে এলো। আমরা একটু আগেই পৌছলাম। সায়ীদকে বিদায় জানিয়ে, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস এ চেপে বসলাম। আমাদের এসিতে থাকলেও, কিছু ভুল সিদ্ধান্তে সব্যদাদের ৪ জনকে স্লীপারএ ফিরতে হলো।
ট্রেনেও মামীর কেনা কাটা চালু ছিলো। এখানে আমিও কিনলাম। কিছু খেলনা, এক দুটো স্কর্ফ। টূর শেষ। টাকা পয়সায় সেভাবে টানাটনি নেই। রাতে আমার একটু সমস্যা হয়েছিলো। মিডল টা বড্ড ছোট ছিলো। ঢুকতে পারছিলাম না। যাই হোক, ট্রেন ভোগায় নি। সঠিক সময় পৌছে দিয়েছিলো বাড়ি। যেনো এক স্বপ্ন শেষ হলো।
কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি ও কিছু মানুষকে মনে থাকবে। প্রথমদিন মোড়লের ভূত বা চোর বা পশুর থাবা দর্শন তার মধ্যে অন্যতম। সুনতালেখোলায় হটাত্‍ প্রচণ্ড পেটে চাপ পরায় দিকজ্ঞান শূন্য হয়ে মোড়ল সব্যদার ঘরেই ঢুকে গেছিলেন কম্ম সারতে। সেখানে পেছনের জানলায় কেউ হাতের থাবা দিয়ে খচর খচর করেছেন। তাতে মোড়ল বেশ চিন্তিত। এটা মনে থাকবে। মনে থাকবে কল্যাণী বৌদি ও অনিতা ম্যাডামের কথা। সারা টূরে প্রত্যেক যাত্রীর সঙ্গে সঙ্গে সায়ীদ এর ও খবর নিয়ে যাওয়া ও প্রয়োজনে সাহায্যে ঝাপিয়ে পরা। যেনো মায়ের মত। কল্যাণী বৌদি নিজের সুবিধা না দেখে অন্যকে সুবিধা করে দেওয়ায় সিদ্ধহস্ত। বাকি দের মধ্যে মামা মামি এত বিখ্যাত লোক হয়েও আমাদের সঙ্গে যেভাবে মিসেছেন ও প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছেন তাতে আমি অভিভূত। সমরজিত্‍, সুকু এরা সহযাত্রী হিসেবে খুব ই ভালো সবসময়। সব্যদা নিখুত ভালো মানুষ। তিনি যেকোনো টূরের সম্পদ। এখানেও ব্যাতিক্রম হয় নি। সব শেষে মোড়ল। মোড়লের সমগ্র পরিকল্পনা তারীফ এ কাবিল। ব্যবস্থাপনাও অসাধারণ। টূরটি একটু বেশি ছোটাছুটি হলেও এত্ত অঞ্চল আমরা ঘুরেছি ও এত্ত কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি যে লিখে শেষ হবে না। তবে অলাভজনক (আমি নিজে হিসেব দেখেছি) ভাবে, কেউ যে এত্ত ভূতের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে ঘুরতে পারে, পাশে থেকে দেখে অবাক হয়েছি। এত জটিল ও প্রায় নিখুত এবং সম্পুর্ন ভ্রমণ করানোর জন্য ধন্যবাদ মোড়ল ওরফে সুগত বসু। অনেকেই মোড়ল মানে জিজ্ঞাসা করেছেন, এটি সাধারণত ব্যাঙ্গ করতেই ব্যবহার হয়, আমি কেনো ব্যবহার করছি জাতীয় প্রশ্ন করেছেন। সাধারণত আমি শব্দ নিয়ে খেলতে ভালবাসি। মোড়ল শব্দের অর্থ মাতব্বর বা মাথা বা প্রধান। এই টূরটির আক্ষরিক অর্থেই মাথা ছিলেন আমাদের মোড়ল।
যান, যদি ডুয়ার্স না ঘুরে আসেন, একবার দেখে আসুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন