একটা
অভিজ্ঞতা নিয়ে আজ লিখতে বসলাম। ২০ সালের ঘটনা। সদ্য হোটেল খুলতে থাকায়
দীঘা যাবো প্ল্যান করি। ঘরে বসে থাকলে চুলকানি রোগ যাদের হয় তাদের মধ্যে
আমি একজন। সাধারণত লোকজন ওই সময় দিঘা দূর দই কিনতে যেতেও ভয় পাচ্ছে। কিন্তু
ওই যে বললাম, আমার এবং আমার পরিবারের বেশিদিন ঘরে থাকলেই চুলকানি হয়, তাই
স্থানীয় এক ভ্রমণসংস্থা থেকে গাড়িটা ভাড়া করে সোজা দীঘা চলে গেলাম। পথে
অনেক সমস্যা হচ্ছে শুনে ঠিক করলাম গিয়েই বুক করবো হোটেল। কিন্তু কথা বলে
রেখেছি কলকাতা থেকেই। শ্বশুর শাশুড়ি বউ মেয়ে আর আমি। পাঁচ জনে। ড্রাইভার
সাহেব কিছুতেই হোটেলে থাকবেন না। অনেকবার বললেন যে পেটের দায়, নাহলে গাড়ি
চালিয়ে আসতেন না। কিন্তু কি করবে, আসতেই হল।
যাই
হোক, পৌঁছে এক নামি হোটেলের সমুদ্রের ধারে ঘর নিলাম। পাঁচজনের একসঙ্গে।
একটা এপার্টমেন্ট টাইপ। সেটায় আরামসে সাতজন হয়ে যায়। আড় ঘরটা একদম সমুদ্রের
ওপরে। বারান্দায় বসলে সারাদিন আরামসে সমুদ্র দেখা যায়। সমুদ্রের হাওয়া ও
জলবায়ু উপভোগ করতে করতে গপ্প গুজব করে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেল।
নিম্নচাপের সঙ্গে ভরা কোটাল ছিল। তাই সমুদ্রে নামতে দেয় নি। তাল কাটল
বিকেলে। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে দেখলাম সামনের তটে একটা বস্তা মত পরে
আছে, খানিক বাদে আবিষ্কার হল ওটি ভেসে যাওয়া কোন মানুষের মৃতদেহ। সঙ্গে
সঙ্গে পুলিশ এলো, পলিথিনে প্যাক করে নিয়ে গেলো। মাথায় একটা খিচড়ে যাওয়া ভাব
এলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
যাই
হোক, রাতটা গপ্প গুজব করে শুতে চলে গেলাম প্রায় ১২টায়। আশেপাশে ঘর গুলতে
তখনও আড্ডা ফুর্তি চলছে। তবে সারাদিনের ধকল ও মনের মধ্যে শেষ বেলার ঘটনার
একটা নিম্নচাপ ছিল। ঘুম আসতে দেরি হয় নি। এই অবধি ঠিক ছিল। রাতের দিকে হটাত
তিনটের একটু আগে সারা হোটেলে লোডশেডিং হচ্ছে আবার আলো চলে আসছে এমন হচ্ছে।
ফলে ঘুমটা হালকা হয়ে যেতেই কানে এলো একটা চাপা মহিলা কণ্ঠে চিৎকার। খুবই
সামান্য কিন্তু বোঝা গেলো। ধরমর করে উঠে বসতে এক দুমিনিট ভালো করে শুনলাম।
হ্যাঁ, ঠিক শুনছি। এবার বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে যেতে গেলেই দেখলাম থেমে
গেলো। এই প্রথমবার কি আমি ভুতের মুখমুখি হচ্ছি? কে চিৎকার করছে? এই সব
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এসে শুয়ে পড়লাম আবার। যা হবে কাল দেখা যাবে।
আমি
যেখানে শুয়েছিলাম, সেটা একটা সিঙ্গেল খাট। পায়ের দিকে জামাকাপড় রাখার
আলনা। খালি মনে হচ্ছে আলনাটার ভেতরে খশখশ শব্দে কেউ হাঁটছে। আমি উঠে যতবার
টোকা দিচ্ছি থেমে যাচ্ছে। এই ভাবে প্রায় চারটে বাজে বাজে। এবার পায়ের শব্দ
আসছে কমন বাথরুমের সামনে থেকে। বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।আর উঠে টোকা দেওয়া বা
দেখার ক্ষমতা নেই। এই ঘরেই বউ মেয়ে আছে অন্য খাটে। তাদের ডাকলাম না। পাছে
ভয় পায়। নিজের ওপরে রাগ হতে লাগল। এই ভাবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাহীন ঘটনা এর
আগে আমি মুখমুখি খুব কম হয়েছি বা কম সময়ের জন্য অনুভব করেছি। রাগটা আরও হল
কেন এরকম নিরিবিলি সময়ে দিঘা এলাম। দুদিন বাদেই আসতে পারতাম। রাগ থেকেই মনে
হটাত সাহস পেলাম। এবার কোন পায়ের শব্দ পেলে হাতের সামনের লাগেজ ব্যাগ সোজা
ছুঁড়ে দেবো। তারপর যা হয় হবে। অন্য ভাগে আমার শ্বশুর শাশুড়ি আছেন। তারা
নিশ্চয়ই শব্দ শুনে উঠে আসবেন । আর কাল সকালেই হোটেলের সঙ্গে একটা
হেস্তনেস্ত করবো। আমি এদের এখানে এসেই উঠি। অন্যদিকে। এদিক ভালো হবে বলে
এমন বিপদে কেন ফেলল?
আর
দুচোখের পাতা এক করতে পারি নি। তবে খশখশ শব্দ আর হয় নি।
পরদিন ভোরে আমি
উঠে বারান্দায় বসতেই সারারাতের ক্লান্তি কেটে গেল, মোহিনী সমুদ্রের রুপ
দেখে। এই দীঘা চেনা দীঘা নয়। যেন নববধূ। নিল রঙের সমুদ্রের জল যেন
আন্দামানের বিচ। আহা। তেমনি ভালো এক কাপ চা নিয়ে বসলাম। ইচ্ছা ছিল, মোহনা
যাব, মাছ কিনবো। হল না। এদিকে দেখি বউ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। উঠেই "জানত
ঘরটা না হন্টেড"
আমি
চমকে উঠলাম। তার মানে সেও কিছু দেখেছে। হয় তো চাপা নারীকন্ঠে চিৎকার বা
পায়ের শব্দ। " হ্যাঁ মনে হচ্ছে, তা তোমার কি দেখে মনে হল?"
"কাল বারান্দার দরজায় কেউ ধাক্কা মারছিল, আর মাঝে মধ্যেই আলো চলে যাচ্ছিল।"
"ধুস, সেটা কখনই সম্ভব নয়। আমি জেগে যেতাম। আলো যাচ্ছিল লোডশেডিং"
"তাহলে আমি হয়তো স্বপ্ন দেখেছি, আচ্ছা তুমি কি আমার গলায় কোন শব্দ শুনেছ?"
"মানে? তুমি চিৎকার করছিলে নাকি?"
"হ্যাঁ, ভয়ে মাঝরাতে মনে হয় আমাকে বোবায় ধরেছিল"
এতক্ষনে চাপা নারীকণ্ঠে শব্দের রহস্যভেদ হল। ওটা আমার স্ত্রীর গোঙ্গানি ছিল।
তাহলে
পায়ের শব্দ। সেই রহস্য ভেদ হল শ্বশুরমশাই ওঠার পর। মাঝ রাতে এসি টা বড্ড
ঠাণ্ডা করে দিয়েছিল। এদিকে এসির রিমট না পেয়ে ঘুম চোখে ওই অ্যাপার্টমেন্টের
আঁতিপাঁতি করে দেয়াল খুঁজে বেড়িয়েছেন দুজন মিলে। অন্তত সুইচটা যদি পাওয়া
যায়। আলো জালান নি। মাঝের দরজা খোলা ছিল। যদি আলোতে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়
তো? একবার দুবার বাথরুম এসেছেন আলো না জ্বালিয়ে। ফলে যত পায়ের শব্দ আসছিল
ওনাদের থেকেই। নিজের ওপরে একটু বিরক্ত হলাম। যদি আর একবার বাথরুমের দিকে
আসতেন ও আমি লাগেজ ব্যাগ ছুঁড়ে দিতাম, মহা বিপদে পড়তে হত।
মোটামুটি
সব রহস্যের সমাধান হল। বিকেলে দেখা দুর্ঘটনা মানসিকভাবে দুর্বল করে
অনেককিছু ভাবিয়ে নিয়েছে আমাদের দুজনকে দিয়েই। কিন্তু আলমারির ভেতরের খশখশ
শব্দ সমাধান হল এর খানিক বাদে। পাশের ঘরের উতসব ক্লান্ত জনগণ সারারাত
হাঁটাহাঁটি করেছেন। মাঝে মধ্যে তাদের আলমারির পাশে আসতে হয়েছে কোন কারনে।
সেখানে পায়ের শব্দ হয়েছে। সেটা স্পষ্ট এই ঘর থেকে শোনা গেছে। দুপুরে ঠিক এক
শব্দ আসতে ভালো করে লক্ষ করতে বুঝতে পারলাম। তবে যাই হোক বাকি সময় নষ্ট
করি নি। বাকি সময় হই হই করে, সমুদ্রের পাশে বসে আড্ডা দিয়ে, মানসিক চাপ দূর
করে বাড়িতে ফিরেছি।