Amazon

বুধবার, ১০ নভেম্বর, ২০২১

তুকভার-সিটং-সীমানা

 

প্রথম পর্ব......।।
লিখবো কি লিখবো না করে শুরু করেই ফেললাম। এবারের তুকভার - সিটং - সীমানা ভ্রমণ। সত্যি বলতে কি এই ট্যুর প্ল্যানিং থেকে এই লিখতে বসে লেখার শুরু পর্যন্ত সব কিছুই বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। এর আগে দুবার জায়গা পরিবর্তন করি। প্রথমে কুমায়ুন যাব ঠিক করলাম। খরচে পোষাতে না পেরে সিকিমের ছায়াতাল ঠিক করলাম। কিন্তু করোনা নিয়ে সিকিম সরকারের কড়াকড়ি শুনে শেষপর্যন্ত ঠিক করলাম দুদিন তুকভারে থাকবো আর দুদিন সিটং। সেইমত টিকিট কেটে ফেললাম আমার পরিবার ও শ্বশুর মহাশয়ের পরিবারের। অবসর নেওয়ার পর প্রায় সত্তর ছুই ছুই শ্বশুর মশাইকে আমি যদি বলি যাবেন তো উনি সাধারণত না করেন না। ফিটনেস চূড়ান্ত। শাশুড়ি মাতার একটু আপত্তি ছিল, বারবার বাংলার পাহাড়ে গিয়ে গিয়ে ক্লান্ত। কিন্তু বাংলার বাইরে যাওয়ার সাহস কারো হয় নি এই পরিস্থিতিতে। তাছাড়া এবার কালিম্পং এর দিকের নেশা ছেড়ে একটু পশ্চিমে যাবো বলতে আর আপত্তি করেন নি। টিকিট কাটার পরপর হটাত না না করতে থাকা সৌরভ দাসের মনে হল, ট্যুরটা করেই ফেলি। বেচারা খুব একটা ছুটি পায় না। তাছাড়া কিছু শারীরিক সমস্যা আছে। তবে ফিটনেস সবার চূড়ান্ত। একমাত্র আমি ছাড়া।
ইতিমধ্যে আবার পরিকল্পনা পরিবর্তন হয়েছে। আমার আয়োজক ফ্যান্টাসির সৌরভ মুখারজি আমাকে তাদের নতুন লিজ নেওয়া সীমানার হোম স্টের ছবি দেখাতে আমি সাথে সাথে সেখানে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করি এবং প্ল্যান আবার পরিবর্তন হয়ে সিটং একদিন কমে যায় ও সীমানা ঢুকে পরে। আমার দলের লোকেরা শুধু তুকভারের নামটাই জানত। সিটং ও জানত, কিন্তু শেষে ঢুকে পরা সীমানা বোধয় আমি আর ফ্যান্টাসির সৌরভ ছাড়া কেউ জানতাম না। এমন কি ড্রাইভার সাহেব ও না।
দেখতে দেখতে ২২ তারিখ এসে পরল প্রায়। এর মাঝে কোথা থেকে দক্ষিন বিহারে নিম্ন চাপের উদয় হল। আর পাহাড়ে চলল কয়েকদিন বৃষ্টির তাণ্ডব। সারা বর্ষায় যা ধ্বস নামে নি, দুদিনের বৃষ্টিতে সব তছনছ। প্রায় প্রত্যেক রাস্থা বন্ধ। ট্যুর কি পিছবে না ক্যান্সেল হবে? ভয়ানক চিন্তা নিয়ে, বার বার আই এম ডি র ওয়েব সাইট চেক করে করে দেখলাম আমরা যাওয়ার একদিন আগে ঝকঝকে না হলেও প্রায় পুরো আবহাওয়া ভালো হয়ে যাবে। এবং দুদিন আগেই বৃষ্টি বন্ধ হবে। আশা করা যায় ভরা মরসুমে রাস্তা চটজলদি ঠিক করে ফেলবে প্রশাসন। তাই যাবই।
ব্যাগ গুছিয়ে ২২ তারিখ চেপে বসলাম নব্য নামে পরিচিত এন জে পি- বিশেষ ভাড়া স্পেশাল ট্রেনে। যা আদতে দার্জিলিং মেল। অন্যদের থেকে একটু দাম বাড়িয়েছে, এবং নাম বাড়িয়েছে। যথারীতি এসিতে জানলা থেকে শুরু করে কোথাও কভার নেই। নেই বেডিং। তাই একটা অতিরিক্ত ব্যাগ নিতে হল শুধু ট্রেনে ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকার জন্য। আমার নিজের জন্য কিছু নি নি। কারন আমার ওসব লাগে না। ট্রেনে ওঠার আগেই সারথি তেঞ্জিং ভাই ফোন করে জানিয়ে দিল সে থাকবে আমাদের বাহন নিয়ে। নেমেই উঠে পরব তার বাহনে।
ট্রেন ঢুকল এন জে পি প্রায় দেড় ঘণ্টা দেরিতে। পথে লাইনে কাজ হচ্ছে। তো এটাই স্বাভাবিক। পেছনে পেছনে পদাতিকও এসে পরল। তারপর ট্রেন ঢুকল ৩ নম্বরে। অর্থাৎ ভারী লাগেজ টেনে টেনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে অনেকটা হেঁটে তবেই বাইরে আসতে পারলাম। না লিফট না চলমান সিঁড়ি। সবই খারাপ। শুধু ভাড়াটাই ভালো লাগে নিতে। বাইরে আসতেই তেঞ্জিং ভাই একগাল হাসি সহ আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। সুঠাম চেহারার সুদর্শন যুবক। ধীরে ধীরে এনার আরও পরিচয় দেব। যাই হোক, গাড়ি জ্যাম ঠেলে এগোতে লাগল। মাঝে একবার মহানন্দার পারে একটু দাঁড়িয়েছিল। তেঞ্জিং ভাইয়ের কিছু ব্যাক্তিগত কাজ ছিল। মিটিয়ে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে মহানন্দার সেই পারে নিয়ে গেল যেখানে আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে, বাবা মায়ের কোলে শুয়ে বাসে করে প্রথমবার দার্জিলিং যাবার সময় আমাদের বাস পরিবর্তন করতে হয়েছিল এবং প্রায় একবেলা খাওয়া, স্নান ইত্যাদি সারতে হয়েছিল। একদম সেই জায়গা কিনা জানি না। তবে স্মৃতিতে ভেসে উঠল সেই ছবি, যা আবছা এখনও মনে আছে।
এর পর আবার সমস্যা। প্রাতরাশ সারার সময় তেঞ্জিং ভাই জানাল যে তার কাছে যা খবর আছে সেখানে প্রথম দুদিন তুকভার ও শেষ দুদিন সিটং। সীমানার খবর নেই। কলকাতায় ফোন করে আবার পথ পরিবর্তন করা হল। আজ মিরিক ইত্যাদি দেখে তুকভার যাওয়ার কোথা থাকলেও সেটা শেষ দিন চলে গেল এবং আজ আমরা সোজা কার্শিয়ং হয়ে দার্জিলিং শহর হয়ে তুকভার যাবো ঠিক হল। ইতিমধ্যে আমরা খানিকটা এগিয়ে আসায় আমাদের এবার পঙ্খাবাড়ি রাস্তা ধরে যেতে হবে। এই রাস্তা একটু বিপদ জনক। বেশ খাড়াই। একসময় দুর্ঘটনার ঘনঘটায় কুখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু ভারি সুন্দর। মনের মধ্যে একটা চাপা উদ্যেগ ছিল। কিন্তু বাকিদের জানতে দি নি। তেঞ্জিং ভাই পাক্কা চালক। একবারও কোন সমস্যায় পরেন নি। এই পথেই দেখা হল সেই মকাইবারি চা বাগানের সাথে। বছর ৫-৬ আগে একদলের সাথে আমার ঘুরে যাওয়া এবং খুব সুন্দর একটি ট্যুরের স্মৃতি জুড়ে আছে মকাইবারি। তবে এখানে থামি নি। দেরি হয়ে গেছিল। এই রাস্তা ধরে সোজা কার্শিয়ং হয়ে দার্জিলিং শহরে প্রবেশ করলাম ঘন্টা ২-৩ এর মধ্যেই। তারপর আর এক ঘন্টার রাস্তা। যে রাস্তা দার্জিলিং বাস স্ট্যান্ড হয়ে লেবং এর দিকে গিয়ে একটু পরে বিজনবাড়ি-পাতলেবাস হয়ে সিক্কিম এর জোরথাং যায় সেই রাস্তা দিয়ে একের পর এক ছবির মত সাজানো চা বাগান পেরিয়ে আমরা চলে এলাম তুকভার চা বাগানে। পথে গলে গলে পরে থাকা পাহাড়ের অংশ এবং গাছপালা জানান দিচ্ছে যে ধ্বস এখানেও হয়েছে। সাবধান।
তুকভার চা বাগান সম্ভবত জয়শ্রী টি এর। এর একদম গা ঘেঁষে আমাদের পরবর্তী দু রাতের ঠিকানা কইলি হোমস্টিড। পৌঁছলাম সেখানে। কইলি পৌঁছে মনে হল আহা কোথায় এসে পৌঁছেছি। চারিদিকে সবুজে সবুজ। এক নিমিষে পথের ক্লান্তি অনেকটা অমে গেল। ঝকঝকে পরিবেশ, কাঠের তৈরি বাড়ি, পরিষ্কার। সুন্দর গরম গরম ভাত মাংস সহযোগে তৈরি দুপুরের খাবার। সে যতই ৪ টে বাজুক। অমৃত। 
 



 
দ্বিতীয় পর্ব......।।
অত বেলায় খাবার পর শুধু বারান্দায় বসে থাকা। বারান্দাটা ভারী সুন্দর। দুদিকে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া চা বাগান। সবুজের মেলা। খানিক নিচে এঁকে বেঁকে চলে গেছে জরথাং যাবার রাস্তা। জীবনে এটা প্রথম চা বাগানে থাকা নয়। আগের পর্বে লিখেছি, পঙ্খাবারি রোডে মকাইবারি এর আগে আমাদের দুদিনের ঠিকানা ছিল। কিন্তু সেখানে থাকার ঘর থেকে বাগান ১০০ মিটার মত দূরে। এ একদম চা বাগানের মধ্যে। বাড়ির সীমানা শেষেই চা বাগান। সঙ্গে এক নাগারে ডেকে চলা ঝি ঝি পোকা। ইচ্ছা ছিল চাঁদনী রাতে, চা বাগানে বসে চাঁদের আলোয় প্রিয় পানীয় হাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে পর্দায় ফেলে একটু দু দন্ড মনের সব গ্লানি দূর করে আসব। বলা যায় না আবার কবে আসব। কিন্তু প্রকৃতি বাদ সাধল। ব্যাবস্থা ছিলই। বসার জায়গাও ছিল। কিন্তু চাঁদ ঢেকে গেছিল মেঘে এবং কাঞ্চন দেখা দেন নি। তাই আবছা হোম স্টের আলোতে বারান্দায় বসেই চলল আড্ডা। ঠাণ্ডা কিন্তু দার্জিলিং সুলভ ছিল না। হয়ত অনেকটা নিচে বলে। হয়ত পাশেই বাগান বলে। তবে মনোরম পরিবেশ ছিল। পরের দিন তাড়াতাড়ি ওঠার তাড়া ছিল না। তাই একটু বেশী রাত অবধি আড্ডা মারার ইচ্ছা থাকলেও ৯টার মধ্যেই খেয়ে শুয়ে পরতে হল। সকালের খাবারে স্থানীয় শাক ছিল, রাতে সেভাবে কিছু ছিল না। তবে সুস্বাদু।
পরের দিন ঘুম ভেঙ্গে প্রাতরাশ সারতে একটু দেরি হল। তার আর একটা কারন ছিল আমরা মাঝে মধ্যেই বাগানে ঢুকে পরছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম চা চাষ। কিছু মানুষ আগাছা পরিষ্কার করছেন। ঢালু জমিতে ধাপে ধাপে ছবির মত কেউ যেন সাজিয়ে রেখে গেছে। বিশেষ কোন বাধা নিষেধ নেই। গাছ ধরতেও কেউ বারন করে নি। তবে আমরা ধরি নি। তোলা একদমই উচিত নয়। আর আমাদের সকাল থেকে গান শুনিয়ে এসেছে একটি পাহাড়ি কলচুরা পাখি। তার ছবি আগের পর্বে দিয়েছি। শুধু এ নয়, আর অনেকে অনেক ভোর থেকেই গান শুনিয়ে চলেছে। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে সাদা সাদা চূড়া উঁকি দিচ্ছেন। এরপর এল প্রাতরাশ ও চায়ের পালা। পাহাড়ি মানুষের জীবন অনেক সহজ সরল। তাড়াহুড়া তাদের ধাতে নেই। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠলেও আমাদের দেখভাল করা সচিন বাবু প্রাতরাশ দিলেন প্রায় ৯ টায়। তাই দেরি হতই। বেরতে বেরতে ১০ টা বেজে গেল। তেঞ্জিং সাহেব বোধয় জানতেন দেরি হবে। তাই চট জলদি না এসে তিনিও ধীরে সুস্থে এলেন আমাদের নেবার জন্য। আজ স্থানীয় অঞ্চল ঘুরে দেখবো কথা থাকলেও আদপে চা বাগান ছাড়া এখানে সেভাবে কিছু নেই বলে আমাদের তিনি দার্জিলিং শহরে নিয়ে গেলেন। কোন সময় প্রতিবন্ধকতা কখনো দেন নি। শুধু ম্যালের নিচে নামিয়ে বললেন ফিরে এসে এখানে দাঁড়িয়ে তাকে ফোন করতে।
বাঙালীর দার্জিলিং। চির নতুন চির পুরাতন। সেই গ্লেনারিজ, সেই কাঞ্চন, সেই বসার জায়গা আর সঙ্গে ভুটিয়া মার্কেট। দলে ৩ জন মহিলা থাকলে ও তাদের সামনে সস্থার বাজার খুলে দিলে, যা হবার তাই হল। ঝাঁপিয়ে পরল সবাই বাজারে। তবে ছেলেদের কম ভাবার কারন নেই। সোয়েটার থেকে চা, সৌরভ বা কিশোরদা, কিনতে কার্পণ্য করেন নি একটুকুও। যারা কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন, তাদের বলি, বেশিরভাগ জিনিস কলকাতায় পাওয়া যায়। দাম খুব বেশী হেরফের হয় না। কিন্তু জানিয়ে রাখি, এবার নজরে পরল, আর একটি নতুন মার্কেট হয়েছে। মহাকাল মার্কেট নাম দিয়ে। সেখানে জিনিস বেশ ভালো এবং সস্থা। তাই এবার দার্জিলিং গেলে একটা ফাঁকা ব্যাগ নেবেন, নয়ত আমাদের মত ওখানে গিয়ে ব্যাগ কিনতে হবে। কে কি কত দামে কিনেছে সেটা কৌশিকিজ কে জিজ্ঞাসা করে নেবেন প্রয়োজনে। তবে চাইলে ৫০০ বলবেন ২৫০। নাহলে ঠকবেন। আমি এসবের মধ্যে থাকি নি। আমি ম্যালে বসে ছিলাম। ফ্ল্যাস ব্যাকে এর আগের দার্জিলিং ট্যুর গুলি মনে পরছিল। কি আশ্চর্য, বেশ মনে আছে সেই ৩৪ বছর আগেকার ভ্রমনের কথা। তখন এই মঞ্ছ, বসার জায়গা ইত্যাদি সেভাবে ছিল না। লোক সমাগম অনেক বেশী ছিল। মনে আছে মায়ের কোলে চেপে পেছনে কাঞ্চনকে রেখে ছবি তুলেছিলাম। আর সেই সময় থেকে আজ অবধি ম্যালের ওপরে একটি হোটেল এখনও আছে। তার নিচে এখন ঝকঝকে দোকান হয়েছে। শুনেছি এখনও সেই হোটেলে থাকতে দেয়। সম্ভবত ম্যালের ওপরে একমাত্র হোটেল।
কেনাকাটা করে ট্রিপ্ট তে বসে চা খেয়ে কাঞ্চন না দেখেই ফেরার জন্য গাড়ি ধরলাম। কালকের পথেই ফিরলাম। ফেরার পথে এক অপূর্ব সুন্দর বাঁকে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। ছবির মত সাজানো একটি চা বাগান। নেমে ছবি তোলা হল। এখানে দুপুরের খাবারের পর আবার এসেছিল সৌরভরা। আমি বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিলাম বাকি সময়। বাঁশের তৈরি ঘর আর কাঠের বারান্দা। সেখানে কাঠের লন্ঠনে বৈদ্যুতিক আলো এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। হোমেস্টে টাতে প্রধান রাস্তা থেকে নামতে উঠতে একটু কষ্ট। একটু বেশী খাড়াই। সাবধানে নামতে উঠতে হয়। তবে এত সুন্দর পরিবেশ, এত আতিথেয়তা, এত প্রাকৃতিক আহ্বান, মন প্রান জুড়িয়ে যায়। তবে আজ রাতে হাল্কা চাঁদের আলো ছিল। মহোময় চা বাগান ছিল। কাঞ্চন হাল্কা ছিল। কিন্তু চা বাগানে বসি নি। তার কারন পরিবেশ দূষণ করে, তারস্বরে মাইক চালিয়ে নিচের চা বাগান বস্তিতে মেলা হয়েছে, অনুষ্ঠান হয়েছে অনেক রাত পর্যন্ত। তাই আবার আসতে হবে এখানে। অপূর্ণ স্বাদ পূর্ণ করতেই হবে।
তৃতীয় দিন ঘুমটা একটু ভোরেই ভেঙেছে। উঠেই দেখি পশ্চিম আকাশে লাল কাঞ্চন। হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ। প্রায় এক বছর বাদে দেখা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সৌরভকে ডেকে তুললাম। সবাই কে ডেকে তুললাম। অনেকেই প্রথমে বিশ্বাস করে নি। ঘুম ভাঙ্গা চোখে লাল থেকে সোনালী হয়ে সাদা হয়ে যাওয়া কাঞ্চন দেখার পর মনে হল, যাক ভ্রমণ স্বার্থক।
 






তৃতীয় পর্ব......।।
তৃতীয়দিন আমাদের তুকভার কে টাটা বলার পালা। আজ একটু জলদি যাত্রা শুরু করবো ঠিক করেছিলাম। সেই মত প্রাতরাশে টোস্ট এবং সানি সাইড আপ ৮ টার মধ্যেই টেবিলে এসে গেল। আগে একবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে এক কাপ দার্জিলিং চা খেয়েছি। আর এক কাপ খেতে ইচ্ছা করল এবং খেলাম। একটু একটু করে মেঘে ঢেকে ফেলছে পশ্চিম আকাশ। অর্থাৎ কাঞ্চন আমাদের আজকের মত বাই বাই করে লেপ মুড়ি দিয়েছে। চা বাগানের সবুজ প্রান্তরকে চোখ জুড়ে দেখে নিলাম। এবং ওপরে উঠে গাড়িতে বসলাম। দার্জিলিং এর ছেলে তেঞ্জিং আজকে দেরি করে নি। ফলে ৯ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু জায়গা ঘুরে আজ সিটং যাবো। তাঁর আগে বলে নি, দুটি দিন থাকার জন্য তুকভারে কইলি হোমস্টিড খুব ভালো জায়গা। হোমস্টে বদলে নামটা হোমস্টিড। আমার বানান ভুল নয়। রুচিশীল এক ব্যাক্তির নিখুত বুননে তৈরি যে টা দেখলেই বোঝা যায়। বাঁশ ও কাঠের ব্যাবহার খুব বেশী। জায়গাটা এমন যে আপনি চাইলে দুইবার নেমেও গাড়ির সামনে পৌঁছতে পারেন আবার উঠেও পৌঁছতে পারেন। অর্থাৎ এক রাস্তাই পাক খেয়ে একবার ওপরে একবার নিচে। তবে ওঠা নামা একটু সাবধানে। খাড়াই। কইলি শব্দ নেপালি। এর বাংলা অর্থ কোয়েল। মালিক একজন পক্ষিপ্রেমী। তাই এই নাম প্রদান। বেশ ভালো লেগেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে দার্জিলিং থেকে রোপওয়ে চাপলে যে চা বাগান দেখা যায় সেটি হল এই তুকভার চা বাগান। যা আসলে জয়শ্রী টি এর সম্পত্তি সম্ভবত।
আবার সেই দার্জিলিং শহর হয়ে আমাদের প্রথম স্টপেজ বাতাসিয়া লুপ। নতুন পুরনো হিন্দি সিনেমা হোক বা বাংলা, রাজেশ খান্না - শাম্মি কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর-কল্পনা মোহন হোক বা হালের নায়ক নায়িকা, বাতাসিয়া তে ট্রেনে এক চক্কর কাটেন নি এমন নয়। এই সব সিনেমার কল্যানে দিনের পর দিন কি ভাবে বাতাসিয়া পরিবর্তিত হয়েছে তা বুঝতে পারা যায়। তবে সেই গোল হয়ে এক চক্কর কেটে যাওয়া লাইন এখনও অপরিবর্তিত। এখন অনেক আধুনিক হয়েছে আশপাশ। তৈরি হয়েছে গোর্খা ওয়ার মেমোরিয়াল। যেখানে লেখা আছে সকল বীরদের নাম। বাগান তৈরি হয়েছে। 'I love Darjeeling' লেখা বড় ঢালাই করা স্লোগান লাগিয়েছে। সাড়ি দিয়ে বসে থাকা টেলি লেন্স লাগানো দূরবীন চোখে দিলেই মেঘের মধ্যেও কি করে কাঞ্চনের দেয়াল বা লতসে দেখতে পাওয়া যায় আমার মাথায় ঢোকে না। তবে লোকে দেখে। আমার মেয়েও দেখেছে। আর সব থেকে মজার হল, বেড়ে যাওয়া ট্রেনের সংখ্যা। আগে অনেক পরে পরে একটা কি দুটো টয় ট্রেন আসত দু বগির। এখন আমাদের থাকাকালীন কম করে ৩ টে দেখলাম। যার একটি জয় রাইড। জয় রাইড বহু বছর আগে করেছিলাম। দার্জিলিং থেকে ঘুম হয়ে আবার দার্জিলিং। এখনও অবশিষ্ট কিছু ষ্টীম ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যায় দুটি প্রথম শ্রেণীর বগি। তবে বড্ড ধোঁয়া। আর সঙ্গে ছিটকে আসে কয়লার গুঁড়ো। আমার ভালো লাগে নি। বাইরে থেকে কু ঝিক ঝিক দেখতেই ভালো।
বাতাসিয়া লুপের পর্ব মিটতে আমরা গেলাম কাছেই ঘুম মনেস্ট্রি দেখতে। শান্ত পরিবেশে পাহাড়ের কোলে বুদ্ধ মন্দির। একটু নিচুতে, আমার ওপর থেকেই দেখতে সুন্দর লাগলো। দলের বাকিরা ভেতরে গেছিল। তারা ভেতরটা দেখে খুব খুশি। সম্ভবত সৌরভ প্রথম মনেস্ট্রি দেখল? মনেস্ট্রি ঢুকতে গেলে ছোট্ট টয় ট্রেনের লাইন পেরতে হয়। আর এখানেও আছে পসার নিয়ে বসে থাকা মার্কেট। দেখা গেল এটি দার্জিলিং এর থেকে সস্থা।
ঘুম মনেস্ট্রি থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটল নামথিং পোখরি লেকের দিকে। এই রাস্থা বাগোড়া হয়ে সিটং চলে যাবে। এই নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার এই রাস্তায় যাওয়া। প্রতিবার ঘন কুয়াশা আবার পরিষ্কার ঝকঝকে পরিবেশ যেন লুকোচুরি খেলেছে আমার সঙ্গে। এইবার একটু যেতে ভয় করছিল। একদম সামনে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পাকা ড্রাইভার তেঞ্জিং ভাই একটুও বিচলিত নন। অবশেষে এসে পৌঁছলাম লেকে। বড় বড় ঝাউ গাছ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর লেক। চারিপাশ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। আশে পাশে ঘন জঙ্গল। এই অঞ্চলটি সেলফু খাস মহল নামেও পরিচিত, যা কিনা লাটপাঞ্চারের একটি অংশ। এই ঘন জঙ্গল আসলে মহানন্দা অভয়ারণ্যের অংশ। এত ওপরে হাতি আসে কিনা জানি না। তবে চিতা থাকার সম্ভবনা প্রবল। ইচ্ছা করলেই লেকের পাশ দিয়ে খানিক ঘুরে আসা যায়। তবে লেকে নামা বারন। তাঁর প্রধান কারন স্যালামেন্ডার। পাহাড়ি স্যালামেন্ডারদের রাজত্ব এখানে। তাদের বংশ প্রায় শেষের পথে। আর তাই প্রয়োজন হয়েছে সংরক্ষণের। দেখতে টিকটিকির মত হলেও চলে ব্যাঙের মত। লেকের পাশ দিয়ে ঘন অরন্যে চাইলে হারিয়ে যান। কেউ মানা করবে না। এক আদিম পরিবেশ আপনাকে ডেকে নেবে। তবে জন্তু জানোয়ার থাকায় একটু সাবধানে।
এর আগে যখন সান্দাখফু থেকে ফিরেছিলাম, ২০১৮ সম্ভবত, তখন এই রাস্তা দিয়েই অহল দারা গেছিলাম। সম্ভবত চালকের অচেনা হওয়ায় তখন দেখা হয় নি। কিন্তু ওই যে, তেঞ্জিং ভাই, সব দিক থেকে সেরা। রাস্তা তাঁর চেনা নয়। কিন্তু ঠিক জিজ্ঞাসা করে করে পৌঁছে গেলেন। না, এখানে স্যালামেন্ডার আমায় দেখা দেয় নি। দিয়েছিল পরের দিন। সেটা পরের পর্বে বলব। সেই সঙ্গে জঙ্গলের পথে গাইড নিয়ে দেখতে যেতে পারেন ধনেশ পাখি। এখানে মানে লাটপাঞ্চারে ধনেশ/Hornbil পাখির সঙ্গে সঙ্গে অনেক পাখির বসবাস।
এবারে পৌঁছলাম আহল দারা। এটিও একটি চা বাগান। পরিষ্কার দিনে একসঙ্গে নিচে তিস্তা ও মাথায় কাঞ্চন দেখা যায়। আগেরবার আমারা কোনটাই পাই নি। এবার তিস্তার বাঁক দেখতে পেলাম। কাঞ্চন লুকিয়ে আছেন বা লেপ মুড়ি দিয়েছেন। অনেক বেলা হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর এই অহলে ধাপে ধাপে চা গাছ লাগানো। সুন্দর সাজানো। পর্যটকদের ভিড় ভালই। সঙ্গে জমে উঠেছে চা ও মোমর ব্যাবসা। সেই সঙ্গে পরিবেশ নষ্ট করে বাগানে প্লেট থেকে শুরু করে প্যাকেট ও প্লাস্টিক ফেলার ধুম জানান দিচ্ছে আর কিছুদিন, তারপর অহলের অবস্থা খারাপ হবে। এখানে ছবির মত সাজানো কিছু ঘর আছে। হোমস্টে বা গেস্টহাউস। আগেরবার ছিলাম। এবার শুধুই দেখলাম।
অহল থেকে বেরিয়ে একটু পিছিয়ে নামতে লাগলাম সিটং। ৩ টে সিটং আছে। আমরা ছিলাম ফ্যান্টাসি অনুগ্রহ হোমস্টে তে। পৌঁছলাম প্রায় ৩ টে। একটু দেরি হল দুপুরের খাবারে। তবে অমায়িক ব্যাবহার এদের সব্বার। আমরা ছিলাম অনুগ্রহ হোমস্টের থেকে ওপরে তাদের বর্ধিত অংশ। যা আসলে অনেকটা কটেজের মত। বিশাল বিশাল ঘর ও তার মধ্যে সুসজ্জিত ফার্নিচার। একটা রাজকীয় অনুভুতি। ঢোকার মুখে একটা ছোট্ট পুকুর। সেখানে মাছ চাষ হচ্ছে। ফুলের বাগান দিয়ে সুসজ্জিত বাইরেটা। ঘর গুলির বাইরে থেকেই ওপরের দিকে ঘন জঙ্গল। একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ। এক দুদিন থাকার জন্য আদর্শ। অনুগ্রহর নিচের অংশটুকুও সুন্দর সজ্জিত। এখানে খাবার দাবার অত্যন্ত সুন্দর। ভালো লাগলো। পরিষ্কার দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘাও এই ওপর থেকে দৃশ্যমান হয়। এখানে এসে আর একটা জিনিস নজরে এল। এরা সৌরভ মুখারজির ফ্যান্টাসি হলিডে কে উচ্চারন করে ফ্যান্টাস্টিক হলিডে। আর সৌরভ কে বলে সোরব। আসলে এই মানুষ গুলির জীবনে ফ্যান্টাসি শব্দটি সেভাবে জায়গা পায় নি। এরা সবাই ফ্যান্টাস্টিক। সব কিছুকে ফ্যান্টাস্টিক দেখতেই পছন্দ করে। তাই ফ্যান্টাসি শব্দের সঙ্গে এদের পরিচয় নেই। সিটং আমার বেশ লেগেছে। আজ এই অবধি থাক। আবার পরে ফিরব সীমানা নিয়ে।
 





 
 
চতুর্থ পর্ব......।।
সিটং এ রাত চাঁদনী ছিল। সাদা থালার মত ঠিক মাথার ওপরে চাঁদ ছিল। কিন্তু কাঞ্চন ছিল না। এক প্রস্থ আড্ডা মেরে, রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম। কিন্তু আজ বেশ ঠাণ্ডা লাগছে রাতের দিকে। আর এই হটাত ঠান্ডায় ফিট বডির সৌরভ বা শ্বশুর মশাই, দুজনেই দেখলাম কাহিল। নাক দিয়ে জল ঝরতে লাগল। আমার কিছু হয় নি, আমি আন্দাজ করেছিলাম, অভিজ্ঞতায়। ওদের সাবধান করেছিলাম। কিন্তু আজকাল কেই বা আমার কথা শোনে। গায়ে সোয়েটার তুলতে বলেছিলাম। তুলল, তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বেশ কিছু তাজা ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে গেছে।
পরের দিন সকালে দেখলাম স্থানীয় কিছু বাচ্চা এসে খেলতে লেগেছে। যেন এক একটা গোলাপ ফুল। কি ভালই না লাগছিল। এই বাড়িতে একটা ছেলে আছে বাচ্চা। সেও জড়তা কাটিয়ে মিশতে শুরু করেছে। একটা সপ্তাহ এদের সঙ্গে থাকলে বোধয় ভালো হত। কিন্তু সময় কোথায়? ভোর বেলা উঠে সব্বাই স্নান করে তৈরি হতে ব্যাস্ত। আমি জানি আমার নাম্বার শেষে আসবে। ক্যামেরায় বড় লেন্স লাগিয়ে ঢুকে পরলাম জঙ্গলে। একটা পাখি অনেক্ষন ধরে আমাকে ডেকে চলেছে। দেখাও দিচ্ছে। কিন্তু ছবি তুলতে দিল না একবারও। তার পিছু ধাওয়া করে খানিকটা গিয়ে দেখলাম আর পাকামি করা উচিত নয়। এমনিতে হাঁপানো ঠিক আছে, কিন্তু পথ ভুলে গেলে বিপদ। ফিরে এলাম। মাঝে এক স্থানীয় কিশোরের সঙ্গে দেখা। সে জঙ্গলে ঘাস কাটতে যাচ্ছে। এ কথা সে কথার পর এক মোক্ষম প্রশ্ন করলো। 'আপ দার্জিলিং মে কিউ আতে হ্যায়।' প্রস্তুত ছিলাম না এ প্রশ্নের। এত সহজে একে কি বোঝাই? আচ্ছা লাগতা হ্যায় বলে পাশ কাটিয়ে নিলাম। তবে মনে হল না যে সে আমাদের এখানে আগমনে খুব একটা খুশি হয়েছে।
সিটং ছেড়ে বেরিয়ে মালকিনের সঙ্গে দেখা করে একটু নিচে নামতেই সামনে এল কমলা লেবুর বাগান। লেবু গুলো এখন সবুজ। দুদিন বাদে পাকবে। তখন খাবার উপযুক্ত হলে পেরে বাজারে আসবে। দাঁড়িয়ে একটু ছবি তুলে এগোতে এগোতে হটাত কৌষিকীর চোখে ধরা পরল ময়ূর। একটি ময়ূর দম্পতি গাছের আড়ালে আড়ালে ঘুরে বেরাচ্ছে। ধীরে ধীরে সবার চোখে পরলেও এবং ছবি তোলার চেস্টা হলেও ছবিতে আসে নি। সিটং এ ময়ূর খুব একটা কমন নয়। বরং চাষ আবাদ বেশী হয় বলে ময়ূর থাকা বিপদজনক। ফসল নষ্ট করবেই করবে। একটি ময়ূর মনে হল আহত। তেঞ্জিং ভাই বলল।
এগিয়ে চলতে লাগলাম। পাহাড়ি পথে মাঝে মধ্যেই কমলা লেবুর বাগান। আবার কোথাও ভ্যালি টাইপ সমতল। প্রথম থামলাম এক ঝুলন্ত সেতুরে সামনে এসে। এখানে খানিকটা ঝর্নার মত ধারায় পাহাড় চিরে সম্ভবত রেলি নদী নেমে এসেছে। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরা। অঞ্চলের নাম যোগীঘাট। এর আগে দুবার আসেপাসে এসেছি। বাগড়া - অহল দারা এসেছি। কিন্তু এখানে আসি নি। অনেক ধন্যবাদ তেঞ্জিং ভাই ও সুব্রত দা। এরা পাহাড়টা কোনায় কোনায় চসে ফেলেছে। যোগীঘাটে ছবি তুলে, পানকৌড়ি পাখির সাথে হাই হ্যালো করে এগিয়ে চললাম রবি ঠাকুরের বাড়ি মংপু তে।
মংপু পৌঁছে রবি ঠাকুরের বাড়ি ঢুকতে টিকিট কাটতে লাগল। টিকিট ভারি সুন্দর। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই চেক করবে বলে ছিঁড়ে দিচ্ছে। আমি অনুরোধ করে একটা বাঁচিয়েছিলাম। সেটা সৌরভ দখল করেছে। ওকে অনুরোধ করবো ছবি দেবার জন্য। ঠাকুরের বাড়ির পাশে এক কারখানা আছে। এখানে বোধয় সিঙ্কনা প্রসেস হয়। ঢুকতে দেয় না। শুধু ঠাকুরের বাড়ি ঢুকতে পারবেন। বাড়িতে নতুন রঙ হয়েছে। ঘর গুলি সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবুও দেখলাম কেউ কেউ রক্ষণাবেক্ষণ কেন হচ্ছে না ইত্যাদি বলে সরকারের পিন্ডি চটকাচ্ছে। বাংলা বলা গান করা নেপালি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। তিনি দেখালাম নিজেকে কেয়ারটেকার বলতে চাইলেন। কয়েকজন কে বোঝাচ্ছেন যে সংরক্ষণ হচ্ছে না ইত্যাদি। আমি এসব বিতর্কে যাই নি। দেখে ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম।
মংপু থেকে জোরবাংলা হয়ে ঘুম। এই রাস্তা ভারি মিস্টি। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাইন ফার গাছ। ছায়া দিয়ে চলেছে। এই প্রথম এই রাস্তায়। কেমন একটা আবছা হাতছানি। পাহাড় যেন নিজের করে নিচ্ছে আমাদের। গান শুনতে শুনতে এই রাস্তা কখন পেরিয়ে গেলো। বুঝতেই পারলাম না। ধীরে ধীরে এসে পৌঁছলাম ঘুম থেকে মিরিক যাবার সড়কে। রাস্তায় ভিড় খুব বেশী নেই। একবার লেপচাজগতের ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিল। সৌরভ কৌশিকী নামলেও তারা ভিউ পয়েন্ট অবধি যায় নি।
পৌঁছলাম জরেপখরি। খুব সুন্দর একটা ছোট বাঁধান পুকুরের আশেপাশে পার্ক বানিয়েছে। এখানে আমার এটা দ্বিতীয়বার আসা। এর আগে সান্ডাখফু যাবার সময় এসেছিলাম। কুয়াশা তখনো ছিল এখনও আছে। খুব কম সময়ের জন্য এখানে বোধয় পরিষ্কার আকাশ থাকে। তবে কাঞ্চন খুব সুন্দর দেখা যায় এখান থেকে। আমার ভাগ্যে এবারো নেই। সবাই লেকের আসে পাসে ঘুরে এল। এখানে একটা জিটিএ বাংলো আছে। আর একটা হোম স্টে আছে। সান্দখফু যেতে অনেকে এখানে একরাত থেকে যান।
দেখতে দেখতে এসে পৌছলাম নেপাল সীমান্তে। জরপখরি থেকে মাত্র ১৫ মিনিট। নাম সীমানা বস্তি। সাকিন সিকদেন তামাং বাবুর বাড়ি। একটা সরকারি নোংরা মোটেলের পেছনে। একটু উঁচুতে। মটেল যতটা জঘন্য দেখতে ঠিক ততটাই ঝাঁ চকচকে সীমানার এই সিকদেন বাবুর বাড়ি। যা কিনা এই ফ্যান্টাস্টিক হলিডে বা ফ্যান্টাসি হলিডে ভাড়া নিয়েছে সম্পূর্ণ। অমায়িক ব্যাবহার। ভদ্রলোকের বয়েস প্রায় ৬০+। ফরেস্টে কাজ করেন এখনও। সম্ভবত ৬৫ তে অবসর। একটি ভিউ এবং একটি নন ভিউ রুম দিলেন। কি হাওয়া। কি ঠাণ্ডা। ঠক ঠক করে কাঁপছি সব্বাই। বাকিটা কাল বলব। এনাদের সম্পর্কে এক কথায় বলা সম্ভব নয়। 









 
শেষ পর্ব ৫......।।
সিকদেন বাবুর বাড়িতে ঢোকার সময়, জোরপোখরি ছাড়ার পরেই চারিদিক একদম ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। মন খারাপের কুয়াশা। সীমানা এমন একটা জায়গা যেখানে খুব সুন্দর কাঞ্চন জঙ্ঘা ভিউ পাওয়ার কথা। এবং উচ্চতা অনেক বেশী হওয়ায় আরও পশ্চিমে এভারেস্ট গ্রুপ বা আরও পশ্চিমে অন্নপূর্ণা দেখতে পাওয়া উচিত। কারন পশ্চিম পুরো খোলা। একদম খোলা। কিন্তু হায়। বিধি বাম। পশ্চিমী জঞ্ঝা এসে সামনের কাঞ্চনকেও ঢেকে রেখেছে। হাল্কা দূরে সান্ডাখফুর রাস্তা দেখা যাচ্ছে। নিচে মানেভঞ্জন পর্যন্ত দেখা মিলছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে একটা লোকালয়ে এসে পৌঁছেছি। আর সব থেকে যেটা গুরুত্ব পূর্ণ, একবুক ভালোবাসা দিয়ে সিকদেন সাহেবের আমাদের কাছে ডেকে নেওয়া। ছেলে বউ, বউমা, মেয়ে নাতি, নাতনি নিয়ে ভরা সংসার সাহেবের। খুব মিশুকে সব্বাই। বাচ্চা মেয়েটা আমার নধর মধ্যপ্রদেশ নিয়ে তবলা বাজিয়ে যাচ্ছে। ওর ধারনা আমি একটি ডল।
ঘর গুলি বেশ খাসা, খুব বড় নয়, তিনজন করে থাকতে পারে। তবে, গিজার আছে। এত ঠাণ্ডায় বড্ড দরকারি। সদ্য চালু করেছেন। বছর খানেক। একদম নতুন ঘর। নতুন রঙ। ঘর থেকে বেরলেই একটা রাস্তা উঁচু হয়ে স্তানীয় এক স্কুলের দিকে চলে গেছে। সেখানে কয়েকটি সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আছে। এছাড়া সীমানা ভিউ পয়েন্ট বলে যে অঞ্চল, সেটাও কাছে। হেঁটেই ঘুরে এল আমি বাদে আমার দলের বাকিরা। আমি সিকদেন সাহেবের সঙ্গে গপ্প গুজব করে ছাদে গেলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন সবে হাল্কা পরিষ্কার হচ্ছে। পরের দিন দেখা দেবে। ইতিমধ্যে বলে রাখি, এনারা দুপুরে এবং রাতে যা খাবার দিলেন, অমৃত। এখন অবধি সব থেকে ভালো। স্থানীয় ভাবে তৈরি ঘি দিয়েই বেশীরভাগ ভাত খেয়ে ফেলল।
ছাদ থেকে চারিদিক একঝলক দেখেই বুঝলাম বেশ সুন্দর। লেপচাজগতের বাজার মেরে দেবে খুব শিগগিরি। আর যেহেতু মাত্র একটি হোমস্টে, এই মুহূর্তে নেই কোন হুড়োহুড়ি। দুটি রুম থেকেই অপূর্ব কাঞ্চন দেখা যায়। পশ্চিম বলে অনেকটা বড় দেখায়। উচ্চতাও কম কিছু নয়। সান্দাখফু না হলেও খুব একটা খারাপ না। এবং আমি নিশ্চিত, সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়রাও বললেন যে বেশ কিছু নেপাল হিমালয়ের শৃঙ্গ দেখতে পাওয়ার সুযোগ আছে। ডিসেম্বর জানুয়ারিতে যারা যাবেন, আমার মনে হয় তারা দেখতে পেতেও পারেন। এতটা পশ্চিম খোলা অঞ্চল আমি সান্দাখফু ছাড়া পাই নি। একখান থেকে তুম্লিং, টুলুং প্রভৃতি দেখা যায়। মানেভঞ্জন দেখা যায়। অর্থাৎ নেপাল এবং সান্দাখফু যাবার রাস্তা, দুটোই পরিষ্কার। সেখানেই দেখলাম কি পরিমান ধ্বস নেমেছে। যেন পাহাড়ের গা থেকে এক গামলা মাটি কেউ খুলে নিয়েছে।
কাছেই বর্ডার পিলার। খুবই কাছে। হেঁটে ২ মিনিট। তারপরেই নেপাল। সান্দাখফু যাবার রাস্তা আসলে নেপাল ভারতের সীমান্ত ঘেঁসে। তাই কখনো যাবেন নেপাল আবার ফিরে আসবেন ভারতে। এখানেও তাই। একটু এগলেই রাস্তার একদিকে নেপাল, অন্য দিকে ভারত। সেই কারনে ফোনের খুব সমস্যা। বি এস এন এল এবং জিও পাওয়া যায়। অন্য কিছু নেই।
পরদিন ফেরার তাড়া আছে। তাই সব্বাইকে বলে দিয়েছি, ৯ টায় গাড়ি চালু করবো। পাহাড়ের রাস্তা, কোথায় কখন আটকে যাবো ঠিক নেই। তায় মিরিক, গোপালধারা চা বাগান দেখেই যাবো। সব্বাই ওই থান্ডায় উঠে তৈরি হয়ে নিলেন। একটা ঘরে জলের সমস্যা ছিল। এই উচ্চতায় জলের সমস্যা স্বাভাবিক। তাতেও আমাদের ঘর ও পাশের আর একটি ঘর খুলে দেওয়ায় সেই ঘরে টয়লেট ব্যাবহার করে তৈরি হয়ে আমাদের খাবারের টেবিলে পৌছতে দেরি হয় নি। দেরি হয় নি গাড়ি চালু করতেও। সিকদেন সাহেবের এবং তাঁর পরিবারের আপ্যায়ন, ভুলব না। এনারা সবাই ভালো। লেকপাজীর মত অনেকেই আমার বন্ধু। কিন্তু লেপকাজীর ভুটিয়া হোমস্টের বাইরে আর এরকম ভালোবাসা, আপ্যায়ন খুব কম পেয়েছি। সৌরভের লাক খুব ভালো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশ পরিষ্কার। সাধারনত তাই হয় এই সময়। বেলা বাড়লেই মেঘ এসে কুয়াশা নিয়ে একদম সব তছনছ করে। কাল দুপুরে আসার জন্য আমরা এরকম পরিবেশ পেয়েছিলাম। ঝকঝকে সকালে সাদা কাঞ্চন আমাদের যেন বিদায় দিল। এবং ঠিক। পশ্চিম আকাশে হাল্কা আবছা পর্বতের একটা রেখা আছে। হয়তো মেঘ আরও পরিষ্কার থাকলে কিছু দেখা যেত। দু একটি গাড়ির শব্দে পরিবেশ নষ্ট হয়তো হচ্ছে না। সকালের সে মুরগির ডাক, আর সঙ্গে পাহাড়ি মন ভালো করা আকাশ। ঘন নীলের নীলিমায় হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। শেষ দিন, সময় কম। যেটুকু রস পেলাম, শুষে নিলাম। তারপর প্রাতরাশ সেরে বাড়ি ফেরার তাড়া।
রাস্তায় প্রথম থামা, গোপালধারা চা বাগান। সম্ভবত এই শেষ এখানে আসা। তার কারন চা বাগানের কর্মচারীদের অসভ্য ব্যাবহার। সেই সঙ্গে ভ্রমণের জন্য অনুপযুক্ত কিছু দল। যারা গিয়েই চা বাগানের ভেতরে ঢুকে চা গাছ ছিঁড়তে শুরু করেছেন। স্থানীয়দের ভাষা এবং ব্যাবহার ততটাই পাত্রে দেবার মত নয়। বাইরের আউটলেট থেকে চা কিনে গাড়ি নিয়ে এলাম মিরিক। সেই পুরনো মিরিক। রোদ কুয়াশার লুকোচুরি খেলা মিরিক। তবে আজ কুয়াশা নেই। আছে নতুন তৈরি পার্ক, জলে বোটিং করার ব্যাবস্থা আর সামনে তৈরি করে রাখা বসার জায়গা। এখানে এসে ভালো গরম লাগছে। সোয়েটার খুলে ফেললাম। মিরিক অনেক ব্যাবসায়িক হয়ে গেছে। তবে ব্রিজের অন্যপাশে দেখলাম ঘোড়াদের নিয়ে যাওয়া বন্ধ। ফলে ওই জঙ্গল ট্রেকে যারা যান তাদের এখন অনেকটাই নিসছিন্তে হাঁটার ব্যাবস্থা হয়েছে। আগেই দেখেছি ৪ তারা রেস্তোরাঁ আছে। এবার সেখানে দুপুরের খাবার সারলাম। তারপর নেমে আসা। আসতে আসতে অনেক চা বাগানের সঙ্গে দেখা হল। দেখা হল সুন্দর দুধিয়া ব্রিজের সঙ্গেও।
এই পর্যন্তই। এরপর দার্জিলিং মেলে রাত কাটিয়ে আবার এই জীবন। ।
--------------------কেমন লাগল আপনারা জানিয়েছেন। কোন তথ্য লাগলে জানাবেন। তিনটে জায়গায় ছিলাম, আমার মনে হয়েছে তিনটেই নিজ গুনে সেরা। ড্রাইভার তেঞ্জিং ভাই সম্পর্কে বলি। অতি সুন্দর ব্যাবহারের, কোন তাড়াহুড়ো নেই। মুখে না নেই। বলা যায় একজন সম্পদ। ফ্যান্টাস্টিক হলিডে খুবই ফ্যান্টাস্টিক। আমাকে বলেছিল ছবি ভিডিও তুলে ওদের দিতে। দিয়েছি কিছু, আরও লাগলে নিতে পারো। এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ সব্বাই কে। আমার লেখা পড়ে সময় নষ্ট করার জন্য।








 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন