Amazon

বুধবার, ১০ নভেম্বর, ২০২১

তুকভার-সিটং-সীমানা

 

প্রথম পর্ব......।।
লিখবো কি লিখবো না করে শুরু করেই ফেললাম। এবারের তুকভার - সিটং - সীমানা ভ্রমণ। সত্যি বলতে কি এই ট্যুর প্ল্যানিং থেকে এই লিখতে বসে লেখার শুরু পর্যন্ত সব কিছুই বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। এর আগে দুবার জায়গা পরিবর্তন করি। প্রথমে কুমায়ুন যাব ঠিক করলাম। খরচে পোষাতে না পেরে সিকিমের ছায়াতাল ঠিক করলাম। কিন্তু করোনা নিয়ে সিকিম সরকারের কড়াকড়ি শুনে শেষপর্যন্ত ঠিক করলাম দুদিন তুকভারে থাকবো আর দুদিন সিটং। সেইমত টিকিট কেটে ফেললাম আমার পরিবার ও শ্বশুর মহাশয়ের পরিবারের। অবসর নেওয়ার পর প্রায় সত্তর ছুই ছুই শ্বশুর মশাইকে আমি যদি বলি যাবেন তো উনি সাধারণত না করেন না। ফিটনেস চূড়ান্ত। শাশুড়ি মাতার একটু আপত্তি ছিল, বারবার বাংলার পাহাড়ে গিয়ে গিয়ে ক্লান্ত। কিন্তু বাংলার বাইরে যাওয়ার সাহস কারো হয় নি এই পরিস্থিতিতে। তাছাড়া এবার কালিম্পং এর দিকের নেশা ছেড়ে একটু পশ্চিমে যাবো বলতে আর আপত্তি করেন নি। টিকিট কাটার পরপর হটাত না না করতে থাকা সৌরভ দাসের মনে হল, ট্যুরটা করেই ফেলি। বেচারা খুব একটা ছুটি পায় না। তাছাড়া কিছু শারীরিক সমস্যা আছে। তবে ফিটনেস সবার চূড়ান্ত। একমাত্র আমি ছাড়া।
ইতিমধ্যে আবার পরিকল্পনা পরিবর্তন হয়েছে। আমার আয়োজক ফ্যান্টাসির সৌরভ মুখারজি আমাকে তাদের নতুন লিজ নেওয়া সীমানার হোম স্টের ছবি দেখাতে আমি সাথে সাথে সেখানে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করি এবং প্ল্যান আবার পরিবর্তন হয়ে সিটং একদিন কমে যায় ও সীমানা ঢুকে পরে। আমার দলের লোকেরা শুধু তুকভারের নামটাই জানত। সিটং ও জানত, কিন্তু শেষে ঢুকে পরা সীমানা বোধয় আমি আর ফ্যান্টাসির সৌরভ ছাড়া কেউ জানতাম না। এমন কি ড্রাইভার সাহেব ও না।
দেখতে দেখতে ২২ তারিখ এসে পরল প্রায়। এর মাঝে কোথা থেকে দক্ষিন বিহারে নিম্ন চাপের উদয় হল। আর পাহাড়ে চলল কয়েকদিন বৃষ্টির তাণ্ডব। সারা বর্ষায় যা ধ্বস নামে নি, দুদিনের বৃষ্টিতে সব তছনছ। প্রায় প্রত্যেক রাস্থা বন্ধ। ট্যুর কি পিছবে না ক্যান্সেল হবে? ভয়ানক চিন্তা নিয়ে, বার বার আই এম ডি র ওয়েব সাইট চেক করে করে দেখলাম আমরা যাওয়ার একদিন আগে ঝকঝকে না হলেও প্রায় পুরো আবহাওয়া ভালো হয়ে যাবে। এবং দুদিন আগেই বৃষ্টি বন্ধ হবে। আশা করা যায় ভরা মরসুমে রাস্তা চটজলদি ঠিক করে ফেলবে প্রশাসন। তাই যাবই।
ব্যাগ গুছিয়ে ২২ তারিখ চেপে বসলাম নব্য নামে পরিচিত এন জে পি- বিশেষ ভাড়া স্পেশাল ট্রেনে। যা আদতে দার্জিলিং মেল। অন্যদের থেকে একটু দাম বাড়িয়েছে, এবং নাম বাড়িয়েছে। যথারীতি এসিতে জানলা থেকে শুরু করে কোথাও কভার নেই। নেই বেডিং। তাই একটা অতিরিক্ত ব্যাগ নিতে হল শুধু ট্রেনে ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকার জন্য। আমার নিজের জন্য কিছু নি নি। কারন আমার ওসব লাগে না। ট্রেনে ওঠার আগেই সারথি তেঞ্জিং ভাই ফোন করে জানিয়ে দিল সে থাকবে আমাদের বাহন নিয়ে। নেমেই উঠে পরব তার বাহনে।
ট্রেন ঢুকল এন জে পি প্রায় দেড় ঘণ্টা দেরিতে। পথে লাইনে কাজ হচ্ছে। তো এটাই স্বাভাবিক। পেছনে পেছনে পদাতিকও এসে পরল। তারপর ট্রেন ঢুকল ৩ নম্বরে। অর্থাৎ ভারী লাগেজ টেনে টেনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে অনেকটা হেঁটে তবেই বাইরে আসতে পারলাম। না লিফট না চলমান সিঁড়ি। সবই খারাপ। শুধু ভাড়াটাই ভালো লাগে নিতে। বাইরে আসতেই তেঞ্জিং ভাই একগাল হাসি সহ আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। সুঠাম চেহারার সুদর্শন যুবক। ধীরে ধীরে এনার আরও পরিচয় দেব। যাই হোক, গাড়ি জ্যাম ঠেলে এগোতে লাগল। মাঝে একবার মহানন্দার পারে একটু দাঁড়িয়েছিল। তেঞ্জিং ভাইয়ের কিছু ব্যাক্তিগত কাজ ছিল। মিটিয়ে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে মহানন্দার সেই পারে নিয়ে গেল যেখানে আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে, বাবা মায়ের কোলে শুয়ে বাসে করে প্রথমবার দার্জিলিং যাবার সময় আমাদের বাস পরিবর্তন করতে হয়েছিল এবং প্রায় একবেলা খাওয়া, স্নান ইত্যাদি সারতে হয়েছিল। একদম সেই জায়গা কিনা জানি না। তবে স্মৃতিতে ভেসে উঠল সেই ছবি, যা আবছা এখনও মনে আছে।
এর পর আবার সমস্যা। প্রাতরাশ সারার সময় তেঞ্জিং ভাই জানাল যে তার কাছে যা খবর আছে সেখানে প্রথম দুদিন তুকভার ও শেষ দুদিন সিটং। সীমানার খবর নেই। কলকাতায় ফোন করে আবার পথ পরিবর্তন করা হল। আজ মিরিক ইত্যাদি দেখে তুকভার যাওয়ার কোথা থাকলেও সেটা শেষ দিন চলে গেল এবং আজ আমরা সোজা কার্শিয়ং হয়ে দার্জিলিং শহর হয়ে তুকভার যাবো ঠিক হল। ইতিমধ্যে আমরা খানিকটা এগিয়ে আসায় আমাদের এবার পঙ্খাবাড়ি রাস্তা ধরে যেতে হবে। এই রাস্তা একটু বিপদ জনক। বেশ খাড়াই। একসময় দুর্ঘটনার ঘনঘটায় কুখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু ভারি সুন্দর। মনের মধ্যে একটা চাপা উদ্যেগ ছিল। কিন্তু বাকিদের জানতে দি নি। তেঞ্জিং ভাই পাক্কা চালক। একবারও কোন সমস্যায় পরেন নি। এই পথেই দেখা হল সেই মকাইবারি চা বাগানের সাথে। বছর ৫-৬ আগে একদলের সাথে আমার ঘুরে যাওয়া এবং খুব সুন্দর একটি ট্যুরের স্মৃতি জুড়ে আছে মকাইবারি। তবে এখানে থামি নি। দেরি হয়ে গেছিল। এই রাস্তা ধরে সোজা কার্শিয়ং হয়ে দার্জিলিং শহরে প্রবেশ করলাম ঘন্টা ২-৩ এর মধ্যেই। তারপর আর এক ঘন্টার রাস্তা। যে রাস্তা দার্জিলিং বাস স্ট্যান্ড হয়ে লেবং এর দিকে গিয়ে একটু পরে বিজনবাড়ি-পাতলেবাস হয়ে সিক্কিম এর জোরথাং যায় সেই রাস্তা দিয়ে একের পর এক ছবির মত সাজানো চা বাগান পেরিয়ে আমরা চলে এলাম তুকভার চা বাগানে। পথে গলে গলে পরে থাকা পাহাড়ের অংশ এবং গাছপালা জানান দিচ্ছে যে ধ্বস এখানেও হয়েছে। সাবধান।
তুকভার চা বাগান সম্ভবত জয়শ্রী টি এর। এর একদম গা ঘেঁষে আমাদের পরবর্তী দু রাতের ঠিকানা কইলি হোমস্টিড। পৌঁছলাম সেখানে। কইলি পৌঁছে মনে হল আহা কোথায় এসে পৌঁছেছি। চারিদিকে সবুজে সবুজ। এক নিমিষে পথের ক্লান্তি অনেকটা অমে গেল। ঝকঝকে পরিবেশ, কাঠের তৈরি বাড়ি, পরিষ্কার। সুন্দর গরম গরম ভাত মাংস সহযোগে তৈরি দুপুরের খাবার। সে যতই ৪ টে বাজুক। অমৃত। 
 



 
দ্বিতীয় পর্ব......।।
অত বেলায় খাবার পর শুধু বারান্দায় বসে থাকা। বারান্দাটা ভারী সুন্দর। দুদিকে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া চা বাগান। সবুজের মেলা। খানিক নিচে এঁকে বেঁকে চলে গেছে জরথাং যাবার রাস্তা। জীবনে এটা প্রথম চা বাগানে থাকা নয়। আগের পর্বে লিখেছি, পঙ্খাবারি রোডে মকাইবারি এর আগে আমাদের দুদিনের ঠিকানা ছিল। কিন্তু সেখানে থাকার ঘর থেকে বাগান ১০০ মিটার মত দূরে। এ একদম চা বাগানের মধ্যে। বাড়ির সীমানা শেষেই চা বাগান। সঙ্গে এক নাগারে ডেকে চলা ঝি ঝি পোকা। ইচ্ছা ছিল চাঁদনী রাতে, চা বাগানে বসে চাঁদের আলোয় প্রিয় পানীয় হাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে পর্দায় ফেলে একটু দু দন্ড মনের সব গ্লানি দূর করে আসব। বলা যায় না আবার কবে আসব। কিন্তু প্রকৃতি বাদ সাধল। ব্যাবস্থা ছিলই। বসার জায়গাও ছিল। কিন্তু চাঁদ ঢেকে গেছিল মেঘে এবং কাঞ্চন দেখা দেন নি। তাই আবছা হোম স্টের আলোতে বারান্দায় বসেই চলল আড্ডা। ঠাণ্ডা কিন্তু দার্জিলিং সুলভ ছিল না। হয়ত অনেকটা নিচে বলে। হয়ত পাশেই বাগান বলে। তবে মনোরম পরিবেশ ছিল। পরের দিন তাড়াতাড়ি ওঠার তাড়া ছিল না। তাই একটু বেশী রাত অবধি আড্ডা মারার ইচ্ছা থাকলেও ৯টার মধ্যেই খেয়ে শুয়ে পরতে হল। সকালের খাবারে স্থানীয় শাক ছিল, রাতে সেভাবে কিছু ছিল না। তবে সুস্বাদু।
পরের দিন ঘুম ভেঙ্গে প্রাতরাশ সারতে একটু দেরি হল। তার আর একটা কারন ছিল আমরা মাঝে মধ্যেই বাগানে ঢুকে পরছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম চা চাষ। কিছু মানুষ আগাছা পরিষ্কার করছেন। ঢালু জমিতে ধাপে ধাপে ছবির মত কেউ যেন সাজিয়ে রেখে গেছে। বিশেষ কোন বাধা নিষেধ নেই। গাছ ধরতেও কেউ বারন করে নি। তবে আমরা ধরি নি। তোলা একদমই উচিত নয়। আর আমাদের সকাল থেকে গান শুনিয়ে এসেছে একটি পাহাড়ি কলচুরা পাখি। তার ছবি আগের পর্বে দিয়েছি। শুধু এ নয়, আর অনেকে অনেক ভোর থেকেই গান শুনিয়ে চলেছে। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে সাদা সাদা চূড়া উঁকি দিচ্ছেন। এরপর এল প্রাতরাশ ও চায়ের পালা। পাহাড়ি মানুষের জীবন অনেক সহজ সরল। তাড়াহুড়া তাদের ধাতে নেই। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠলেও আমাদের দেখভাল করা সচিন বাবু প্রাতরাশ দিলেন প্রায় ৯ টায়। তাই দেরি হতই। বেরতে বেরতে ১০ টা বেজে গেল। তেঞ্জিং সাহেব বোধয় জানতেন দেরি হবে। তাই চট জলদি না এসে তিনিও ধীরে সুস্থে এলেন আমাদের নেবার জন্য। আজ স্থানীয় অঞ্চল ঘুরে দেখবো কথা থাকলেও আদপে চা বাগান ছাড়া এখানে সেভাবে কিছু নেই বলে আমাদের তিনি দার্জিলিং শহরে নিয়ে গেলেন। কোন সময় প্রতিবন্ধকতা কখনো দেন নি। শুধু ম্যালের নিচে নামিয়ে বললেন ফিরে এসে এখানে দাঁড়িয়ে তাকে ফোন করতে।
বাঙালীর দার্জিলিং। চির নতুন চির পুরাতন। সেই গ্লেনারিজ, সেই কাঞ্চন, সেই বসার জায়গা আর সঙ্গে ভুটিয়া মার্কেট। দলে ৩ জন মহিলা থাকলে ও তাদের সামনে সস্থার বাজার খুলে দিলে, যা হবার তাই হল। ঝাঁপিয়ে পরল সবাই বাজারে। তবে ছেলেদের কম ভাবার কারন নেই। সোয়েটার থেকে চা, সৌরভ বা কিশোরদা, কিনতে কার্পণ্য করেন নি একটুকুও। যারা কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন, তাদের বলি, বেশিরভাগ জিনিস কলকাতায় পাওয়া যায়। দাম খুব বেশী হেরফের হয় না। কিন্তু জানিয়ে রাখি, এবার নজরে পরল, আর একটি নতুন মার্কেট হয়েছে। মহাকাল মার্কেট নাম দিয়ে। সেখানে জিনিস বেশ ভালো এবং সস্থা। তাই এবার দার্জিলিং গেলে একটা ফাঁকা ব্যাগ নেবেন, নয়ত আমাদের মত ওখানে গিয়ে ব্যাগ কিনতে হবে। কে কি কত দামে কিনেছে সেটা কৌশিকিজ কে জিজ্ঞাসা করে নেবেন প্রয়োজনে। তবে চাইলে ৫০০ বলবেন ২৫০। নাহলে ঠকবেন। আমি এসবের মধ্যে থাকি নি। আমি ম্যালে বসে ছিলাম। ফ্ল্যাস ব্যাকে এর আগের দার্জিলিং ট্যুর গুলি মনে পরছিল। কি আশ্চর্য, বেশ মনে আছে সেই ৩৪ বছর আগেকার ভ্রমনের কথা। তখন এই মঞ্ছ, বসার জায়গা ইত্যাদি সেভাবে ছিল না। লোক সমাগম অনেক বেশী ছিল। মনে আছে মায়ের কোলে চেপে পেছনে কাঞ্চনকে রেখে ছবি তুলেছিলাম। আর সেই সময় থেকে আজ অবধি ম্যালের ওপরে একটি হোটেল এখনও আছে। তার নিচে এখন ঝকঝকে দোকান হয়েছে। শুনেছি এখনও সেই হোটেলে থাকতে দেয়। সম্ভবত ম্যালের ওপরে একমাত্র হোটেল।
কেনাকাটা করে ট্রিপ্ট তে বসে চা খেয়ে কাঞ্চন না দেখেই ফেরার জন্য গাড়ি ধরলাম। কালকের পথেই ফিরলাম। ফেরার পথে এক অপূর্ব সুন্দর বাঁকে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। ছবির মত সাজানো একটি চা বাগান। নেমে ছবি তোলা হল। এখানে দুপুরের খাবারের পর আবার এসেছিল সৌরভরা। আমি বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিলাম বাকি সময়। বাঁশের তৈরি ঘর আর কাঠের বারান্দা। সেখানে কাঠের লন্ঠনে বৈদ্যুতিক আলো এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। হোমেস্টে টাতে প্রধান রাস্তা থেকে নামতে উঠতে একটু কষ্ট। একটু বেশী খাড়াই। সাবধানে নামতে উঠতে হয়। তবে এত সুন্দর পরিবেশ, এত আতিথেয়তা, এত প্রাকৃতিক আহ্বান, মন প্রান জুড়িয়ে যায়। তবে আজ রাতে হাল্কা চাঁদের আলো ছিল। মহোময় চা বাগান ছিল। কাঞ্চন হাল্কা ছিল। কিন্তু চা বাগানে বসি নি। তার কারন পরিবেশ দূষণ করে, তারস্বরে মাইক চালিয়ে নিচের চা বাগান বস্তিতে মেলা হয়েছে, অনুষ্ঠান হয়েছে অনেক রাত পর্যন্ত। তাই আবার আসতে হবে এখানে। অপূর্ণ স্বাদ পূর্ণ করতেই হবে।
তৃতীয় দিন ঘুমটা একটু ভোরেই ভেঙেছে। উঠেই দেখি পশ্চিম আকাশে লাল কাঞ্চন। হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম বেশ কিছুক্ষণ। প্রায় এক বছর বাদে দেখা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সৌরভকে ডেকে তুললাম। সবাই কে ডেকে তুললাম। অনেকেই প্রথমে বিশ্বাস করে নি। ঘুম ভাঙ্গা চোখে লাল থেকে সোনালী হয়ে সাদা হয়ে যাওয়া কাঞ্চন দেখার পর মনে হল, যাক ভ্রমণ স্বার্থক।
 






তৃতীয় পর্ব......।।
তৃতীয়দিন আমাদের তুকভার কে টাটা বলার পালা। আজ একটু জলদি যাত্রা শুরু করবো ঠিক করেছিলাম। সেই মত প্রাতরাশে টোস্ট এবং সানি সাইড আপ ৮ টার মধ্যেই টেবিলে এসে গেল। আগে একবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে এক কাপ দার্জিলিং চা খেয়েছি। আর এক কাপ খেতে ইচ্ছা করল এবং খেলাম। একটু একটু করে মেঘে ঢেকে ফেলছে পশ্চিম আকাশ। অর্থাৎ কাঞ্চন আমাদের আজকের মত বাই বাই করে লেপ মুড়ি দিয়েছে। চা বাগানের সবুজ প্রান্তরকে চোখ জুড়ে দেখে নিলাম। এবং ওপরে উঠে গাড়িতে বসলাম। দার্জিলিং এর ছেলে তেঞ্জিং আজকে দেরি করে নি। ফলে ৯ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু জায়গা ঘুরে আজ সিটং যাবো। তাঁর আগে বলে নি, দুটি দিন থাকার জন্য তুকভারে কইলি হোমস্টিড খুব ভালো জায়গা। হোমস্টে বদলে নামটা হোমস্টিড। আমার বানান ভুল নয়। রুচিশীল এক ব্যাক্তির নিখুত বুননে তৈরি যে টা দেখলেই বোঝা যায়। বাঁশ ও কাঠের ব্যাবহার খুব বেশী। জায়গাটা এমন যে আপনি চাইলে দুইবার নেমেও গাড়ির সামনে পৌঁছতে পারেন আবার উঠেও পৌঁছতে পারেন। অর্থাৎ এক রাস্তাই পাক খেয়ে একবার ওপরে একবার নিচে। তবে ওঠা নামা একটু সাবধানে। খাড়াই। কইলি শব্দ নেপালি। এর বাংলা অর্থ কোয়েল। মালিক একজন পক্ষিপ্রেমী। তাই এই নাম প্রদান। বেশ ভালো লেগেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে দার্জিলিং থেকে রোপওয়ে চাপলে যে চা বাগান দেখা যায় সেটি হল এই তুকভার চা বাগান। যা আসলে জয়শ্রী টি এর সম্পত্তি সম্ভবত।
আবার সেই দার্জিলিং শহর হয়ে আমাদের প্রথম স্টপেজ বাতাসিয়া লুপ। নতুন পুরনো হিন্দি সিনেমা হোক বা বাংলা, রাজেশ খান্না - শাম্মি কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর-কল্পনা মোহন হোক বা হালের নায়ক নায়িকা, বাতাসিয়া তে ট্রেনে এক চক্কর কাটেন নি এমন নয়। এই সব সিনেমার কল্যানে দিনের পর দিন কি ভাবে বাতাসিয়া পরিবর্তিত হয়েছে তা বুঝতে পারা যায়। তবে সেই গোল হয়ে এক চক্কর কেটে যাওয়া লাইন এখনও অপরিবর্তিত। এখন অনেক আধুনিক হয়েছে আশপাশ। তৈরি হয়েছে গোর্খা ওয়ার মেমোরিয়াল। যেখানে লেখা আছে সকল বীরদের নাম। বাগান তৈরি হয়েছে। 'I love Darjeeling' লেখা বড় ঢালাই করা স্লোগান লাগিয়েছে। সাড়ি দিয়ে বসে থাকা টেলি লেন্স লাগানো দূরবীন চোখে দিলেই মেঘের মধ্যেও কি করে কাঞ্চনের দেয়াল বা লতসে দেখতে পাওয়া যায় আমার মাথায় ঢোকে না। তবে লোকে দেখে। আমার মেয়েও দেখেছে। আর সব থেকে মজার হল, বেড়ে যাওয়া ট্রেনের সংখ্যা। আগে অনেক পরে পরে একটা কি দুটো টয় ট্রেন আসত দু বগির। এখন আমাদের থাকাকালীন কম করে ৩ টে দেখলাম। যার একটি জয় রাইড। জয় রাইড বহু বছর আগে করেছিলাম। দার্জিলিং থেকে ঘুম হয়ে আবার দার্জিলিং। এখনও অবশিষ্ট কিছু ষ্টীম ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যায় দুটি প্রথম শ্রেণীর বগি। তবে বড্ড ধোঁয়া। আর সঙ্গে ছিটকে আসে কয়লার গুঁড়ো। আমার ভালো লাগে নি। বাইরে থেকে কু ঝিক ঝিক দেখতেই ভালো।
বাতাসিয়া লুপের পর্ব মিটতে আমরা গেলাম কাছেই ঘুম মনেস্ট্রি দেখতে। শান্ত পরিবেশে পাহাড়ের কোলে বুদ্ধ মন্দির। একটু নিচুতে, আমার ওপর থেকেই দেখতে সুন্দর লাগলো। দলের বাকিরা ভেতরে গেছিল। তারা ভেতরটা দেখে খুব খুশি। সম্ভবত সৌরভ প্রথম মনেস্ট্রি দেখল? মনেস্ট্রি ঢুকতে গেলে ছোট্ট টয় ট্রেনের লাইন পেরতে হয়। আর এখানেও আছে পসার নিয়ে বসে থাকা মার্কেট। দেখা গেল এটি দার্জিলিং এর থেকে সস্থা।
ঘুম মনেস্ট্রি থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটল নামথিং পোখরি লেকের দিকে। এই রাস্থা বাগোড়া হয়ে সিটং চলে যাবে। এই নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার এই রাস্তায় যাওয়া। প্রতিবার ঘন কুয়াশা আবার পরিষ্কার ঝকঝকে পরিবেশ যেন লুকোচুরি খেলেছে আমার সঙ্গে। এইবার একটু যেতে ভয় করছিল। একদম সামনে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পাকা ড্রাইভার তেঞ্জিং ভাই একটুও বিচলিত নন। অবশেষে এসে পৌঁছলাম লেকে। বড় বড় ঝাউ গাছ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর লেক। চারিপাশ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। আশে পাশে ঘন জঙ্গল। এই অঞ্চলটি সেলফু খাস মহল নামেও পরিচিত, যা কিনা লাটপাঞ্চারের একটি অংশ। এই ঘন জঙ্গল আসলে মহানন্দা অভয়ারণ্যের অংশ। এত ওপরে হাতি আসে কিনা জানি না। তবে চিতা থাকার সম্ভবনা প্রবল। ইচ্ছা করলেই লেকের পাশ দিয়ে খানিক ঘুরে আসা যায়। তবে লেকে নামা বারন। তাঁর প্রধান কারন স্যালামেন্ডার। পাহাড়ি স্যালামেন্ডারদের রাজত্ব এখানে। তাদের বংশ প্রায় শেষের পথে। আর তাই প্রয়োজন হয়েছে সংরক্ষণের। দেখতে টিকটিকির মত হলেও চলে ব্যাঙের মত। লেকের পাশ দিয়ে ঘন অরন্যে চাইলে হারিয়ে যান। কেউ মানা করবে না। এক আদিম পরিবেশ আপনাকে ডেকে নেবে। তবে জন্তু জানোয়ার থাকায় একটু সাবধানে।
এর আগে যখন সান্দাখফু থেকে ফিরেছিলাম, ২০১৮ সম্ভবত, তখন এই রাস্তা দিয়েই অহল দারা গেছিলাম। সম্ভবত চালকের অচেনা হওয়ায় তখন দেখা হয় নি। কিন্তু ওই যে, তেঞ্জিং ভাই, সব দিক থেকে সেরা। রাস্তা তাঁর চেনা নয়। কিন্তু ঠিক জিজ্ঞাসা করে করে পৌঁছে গেলেন। না, এখানে স্যালামেন্ডার আমায় দেখা দেয় নি। দিয়েছিল পরের দিন। সেটা পরের পর্বে বলব। সেই সঙ্গে জঙ্গলের পথে গাইড নিয়ে দেখতে যেতে পারেন ধনেশ পাখি। এখানে মানে লাটপাঞ্চারে ধনেশ/Hornbil পাখির সঙ্গে সঙ্গে অনেক পাখির বসবাস।
এবারে পৌঁছলাম আহল দারা। এটিও একটি চা বাগান। পরিষ্কার দিনে একসঙ্গে নিচে তিস্তা ও মাথায় কাঞ্চন দেখা যায়। আগেরবার আমারা কোনটাই পাই নি। এবার তিস্তার বাঁক দেখতে পেলাম। কাঞ্চন লুকিয়ে আছেন বা লেপ মুড়ি দিয়েছেন। অনেক বেলা হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর এই অহলে ধাপে ধাপে চা গাছ লাগানো। সুন্দর সাজানো। পর্যটকদের ভিড় ভালই। সঙ্গে জমে উঠেছে চা ও মোমর ব্যাবসা। সেই সঙ্গে পরিবেশ নষ্ট করে বাগানে প্লেট থেকে শুরু করে প্যাকেট ও প্লাস্টিক ফেলার ধুম জানান দিচ্ছে আর কিছুদিন, তারপর অহলের অবস্থা খারাপ হবে। এখানে ছবির মত সাজানো কিছু ঘর আছে। হোমস্টে বা গেস্টহাউস। আগেরবার ছিলাম। এবার শুধুই দেখলাম।
অহল থেকে বেরিয়ে একটু পিছিয়ে নামতে লাগলাম সিটং। ৩ টে সিটং আছে। আমরা ছিলাম ফ্যান্টাসি অনুগ্রহ হোমস্টে তে। পৌঁছলাম প্রায় ৩ টে। একটু দেরি হল দুপুরের খাবারে। তবে অমায়িক ব্যাবহার এদের সব্বার। আমরা ছিলাম অনুগ্রহ হোমস্টের থেকে ওপরে তাদের বর্ধিত অংশ। যা আসলে অনেকটা কটেজের মত। বিশাল বিশাল ঘর ও তার মধ্যে সুসজ্জিত ফার্নিচার। একটা রাজকীয় অনুভুতি। ঢোকার মুখে একটা ছোট্ট পুকুর। সেখানে মাছ চাষ হচ্ছে। ফুলের বাগান দিয়ে সুসজ্জিত বাইরেটা। ঘর গুলির বাইরে থেকেই ওপরের দিকে ঘন জঙ্গল। একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ। এক দুদিন থাকার জন্য আদর্শ। অনুগ্রহর নিচের অংশটুকুও সুন্দর সজ্জিত। এখানে খাবার দাবার অত্যন্ত সুন্দর। ভালো লাগলো। পরিষ্কার দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘাও এই ওপর থেকে দৃশ্যমান হয়। এখানে এসে আর একটা জিনিস নজরে এল। এরা সৌরভ মুখারজির ফ্যান্টাসি হলিডে কে উচ্চারন করে ফ্যান্টাস্টিক হলিডে। আর সৌরভ কে বলে সোরব। আসলে এই মানুষ গুলির জীবনে ফ্যান্টাসি শব্দটি সেভাবে জায়গা পায় নি। এরা সবাই ফ্যান্টাস্টিক। সব কিছুকে ফ্যান্টাস্টিক দেখতেই পছন্দ করে। তাই ফ্যান্টাসি শব্দের সঙ্গে এদের পরিচয় নেই। সিটং আমার বেশ লেগেছে। আজ এই অবধি থাক। আবার পরে ফিরব সীমানা নিয়ে।
 





 
 
চতুর্থ পর্ব......।।
সিটং এ রাত চাঁদনী ছিল। সাদা থালার মত ঠিক মাথার ওপরে চাঁদ ছিল। কিন্তু কাঞ্চন ছিল না। এক প্রস্থ আড্ডা মেরে, রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম। কিন্তু আজ বেশ ঠাণ্ডা লাগছে রাতের দিকে। আর এই হটাত ঠান্ডায় ফিট বডির সৌরভ বা শ্বশুর মশাই, দুজনেই দেখলাম কাহিল। নাক দিয়ে জল ঝরতে লাগল। আমার কিছু হয় নি, আমি আন্দাজ করেছিলাম, অভিজ্ঞতায়। ওদের সাবধান করেছিলাম। কিন্তু আজকাল কেই বা আমার কথা শোনে। গায়ে সোয়েটার তুলতে বলেছিলাম। তুলল, তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বেশ কিছু তাজা ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে গেছে।
পরের দিন সকালে দেখলাম স্থানীয় কিছু বাচ্চা এসে খেলতে লেগেছে। যেন এক একটা গোলাপ ফুল। কি ভালই না লাগছিল। এই বাড়িতে একটা ছেলে আছে বাচ্চা। সেও জড়তা কাটিয়ে মিশতে শুরু করেছে। একটা সপ্তাহ এদের সঙ্গে থাকলে বোধয় ভালো হত। কিন্তু সময় কোথায়? ভোর বেলা উঠে সব্বাই স্নান করে তৈরি হতে ব্যাস্ত। আমি জানি আমার নাম্বার শেষে আসবে। ক্যামেরায় বড় লেন্স লাগিয়ে ঢুকে পরলাম জঙ্গলে। একটা পাখি অনেক্ষন ধরে আমাকে ডেকে চলেছে। দেখাও দিচ্ছে। কিন্তু ছবি তুলতে দিল না একবারও। তার পিছু ধাওয়া করে খানিকটা গিয়ে দেখলাম আর পাকামি করা উচিত নয়। এমনিতে হাঁপানো ঠিক আছে, কিন্তু পথ ভুলে গেলে বিপদ। ফিরে এলাম। মাঝে এক স্থানীয় কিশোরের সঙ্গে দেখা। সে জঙ্গলে ঘাস কাটতে যাচ্ছে। এ কথা সে কথার পর এক মোক্ষম প্রশ্ন করলো। 'আপ দার্জিলিং মে কিউ আতে হ্যায়।' প্রস্তুত ছিলাম না এ প্রশ্নের। এত সহজে একে কি বোঝাই? আচ্ছা লাগতা হ্যায় বলে পাশ কাটিয়ে নিলাম। তবে মনে হল না যে সে আমাদের এখানে আগমনে খুব একটা খুশি হয়েছে।
সিটং ছেড়ে বেরিয়ে মালকিনের সঙ্গে দেখা করে একটু নিচে নামতেই সামনে এল কমলা লেবুর বাগান। লেবু গুলো এখন সবুজ। দুদিন বাদে পাকবে। তখন খাবার উপযুক্ত হলে পেরে বাজারে আসবে। দাঁড়িয়ে একটু ছবি তুলে এগোতে এগোতে হটাত কৌষিকীর চোখে ধরা পরল ময়ূর। একটি ময়ূর দম্পতি গাছের আড়ালে আড়ালে ঘুরে বেরাচ্ছে। ধীরে ধীরে সবার চোখে পরলেও এবং ছবি তোলার চেস্টা হলেও ছবিতে আসে নি। সিটং এ ময়ূর খুব একটা কমন নয়। বরং চাষ আবাদ বেশী হয় বলে ময়ূর থাকা বিপদজনক। ফসল নষ্ট করবেই করবে। একটি ময়ূর মনে হল আহত। তেঞ্জিং ভাই বলল।
এগিয়ে চলতে লাগলাম। পাহাড়ি পথে মাঝে মধ্যেই কমলা লেবুর বাগান। আবার কোথাও ভ্যালি টাইপ সমতল। প্রথম থামলাম এক ঝুলন্ত সেতুরে সামনে এসে। এখানে খানিকটা ঝর্নার মত ধারায় পাহাড় চিরে সম্ভবত রেলি নদী নেমে এসেছে। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরা। অঞ্চলের নাম যোগীঘাট। এর আগে দুবার আসেপাসে এসেছি। বাগড়া - অহল দারা এসেছি। কিন্তু এখানে আসি নি। অনেক ধন্যবাদ তেঞ্জিং ভাই ও সুব্রত দা। এরা পাহাড়টা কোনায় কোনায় চসে ফেলেছে। যোগীঘাটে ছবি তুলে, পানকৌড়ি পাখির সাথে হাই হ্যালো করে এগিয়ে চললাম রবি ঠাকুরের বাড়ি মংপু তে।
মংপু পৌঁছে রবি ঠাকুরের বাড়ি ঢুকতে টিকিট কাটতে লাগল। টিকিট ভারি সুন্দর। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই চেক করবে বলে ছিঁড়ে দিচ্ছে। আমি অনুরোধ করে একটা বাঁচিয়েছিলাম। সেটা সৌরভ দখল করেছে। ওকে অনুরোধ করবো ছবি দেবার জন্য। ঠাকুরের বাড়ির পাশে এক কারখানা আছে। এখানে বোধয় সিঙ্কনা প্রসেস হয়। ঢুকতে দেয় না। শুধু ঠাকুরের বাড়ি ঢুকতে পারবেন। বাড়িতে নতুন রঙ হয়েছে। ঘর গুলি সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবুও দেখলাম কেউ কেউ রক্ষণাবেক্ষণ কেন হচ্ছে না ইত্যাদি বলে সরকারের পিন্ডি চটকাচ্ছে। বাংলা বলা গান করা নেপালি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। তিনি দেখালাম নিজেকে কেয়ারটেকার বলতে চাইলেন। কয়েকজন কে বোঝাচ্ছেন যে সংরক্ষণ হচ্ছে না ইত্যাদি। আমি এসব বিতর্কে যাই নি। দেখে ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম।
মংপু থেকে জোরবাংলা হয়ে ঘুম। এই রাস্তা ভারি মিস্টি। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাইন ফার গাছ। ছায়া দিয়ে চলেছে। এই প্রথম এই রাস্তায়। কেমন একটা আবছা হাতছানি। পাহাড় যেন নিজের করে নিচ্ছে আমাদের। গান শুনতে শুনতে এই রাস্তা কখন পেরিয়ে গেলো। বুঝতেই পারলাম না। ধীরে ধীরে এসে পৌঁছলাম ঘুম থেকে মিরিক যাবার সড়কে। রাস্তায় ভিড় খুব বেশী নেই। একবার লেপচাজগতের ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিল। সৌরভ কৌশিকী নামলেও তারা ভিউ পয়েন্ট অবধি যায় নি।
পৌঁছলাম জরেপখরি। খুব সুন্দর একটা ছোট বাঁধান পুকুরের আশেপাশে পার্ক বানিয়েছে। এখানে আমার এটা দ্বিতীয়বার আসা। এর আগে সান্ডাখফু যাবার সময় এসেছিলাম। কুয়াশা তখনো ছিল এখনও আছে। খুব কম সময়ের জন্য এখানে বোধয় পরিষ্কার আকাশ থাকে। তবে কাঞ্চন খুব সুন্দর দেখা যায় এখান থেকে। আমার ভাগ্যে এবারো নেই। সবাই লেকের আসে পাসে ঘুরে এল। এখানে একটা জিটিএ বাংলো আছে। আর একটা হোম স্টে আছে। সান্দখফু যেতে অনেকে এখানে একরাত থেকে যান।
দেখতে দেখতে এসে পৌছলাম নেপাল সীমান্তে। জরপখরি থেকে মাত্র ১৫ মিনিট। নাম সীমানা বস্তি। সাকিন সিকদেন তামাং বাবুর বাড়ি। একটা সরকারি নোংরা মোটেলের পেছনে। একটু উঁচুতে। মটেল যতটা জঘন্য দেখতে ঠিক ততটাই ঝাঁ চকচকে সীমানার এই সিকদেন বাবুর বাড়ি। যা কিনা এই ফ্যান্টাস্টিক হলিডে বা ফ্যান্টাসি হলিডে ভাড়া নিয়েছে সম্পূর্ণ। অমায়িক ব্যাবহার। ভদ্রলোকের বয়েস প্রায় ৬০+। ফরেস্টে কাজ করেন এখনও। সম্ভবত ৬৫ তে অবসর। একটি ভিউ এবং একটি নন ভিউ রুম দিলেন। কি হাওয়া। কি ঠাণ্ডা। ঠক ঠক করে কাঁপছি সব্বাই। বাকিটা কাল বলব। এনাদের সম্পর্কে এক কথায় বলা সম্ভব নয়। 









 
শেষ পর্ব ৫......।।
সিকদেন বাবুর বাড়িতে ঢোকার সময়, জোরপোখরি ছাড়ার পরেই চারিদিক একদম ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। মন খারাপের কুয়াশা। সীমানা এমন একটা জায়গা যেখানে খুব সুন্দর কাঞ্চন জঙ্ঘা ভিউ পাওয়ার কথা। এবং উচ্চতা অনেক বেশী হওয়ায় আরও পশ্চিমে এভারেস্ট গ্রুপ বা আরও পশ্চিমে অন্নপূর্ণা দেখতে পাওয়া উচিত। কারন পশ্চিম পুরো খোলা। একদম খোলা। কিন্তু হায়। বিধি বাম। পশ্চিমী জঞ্ঝা এসে সামনের কাঞ্চনকেও ঢেকে রেখেছে। হাল্কা দূরে সান্ডাখফুর রাস্তা দেখা যাচ্ছে। নিচে মানেভঞ্জন পর্যন্ত দেখা মিলছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে একটা লোকালয়ে এসে পৌঁছেছি। আর সব থেকে যেটা গুরুত্ব পূর্ণ, একবুক ভালোবাসা দিয়ে সিকদেন সাহেবের আমাদের কাছে ডেকে নেওয়া। ছেলে বউ, বউমা, মেয়ে নাতি, নাতনি নিয়ে ভরা সংসার সাহেবের। খুব মিশুকে সব্বাই। বাচ্চা মেয়েটা আমার নধর মধ্যপ্রদেশ নিয়ে তবলা বাজিয়ে যাচ্ছে। ওর ধারনা আমি একটি ডল।
ঘর গুলি বেশ খাসা, খুব বড় নয়, তিনজন করে থাকতে পারে। তবে, গিজার আছে। এত ঠাণ্ডায় বড্ড দরকারি। সদ্য চালু করেছেন। বছর খানেক। একদম নতুন ঘর। নতুন রঙ। ঘর থেকে বেরলেই একটা রাস্তা উঁচু হয়ে স্তানীয় এক স্কুলের দিকে চলে গেছে। সেখানে কয়েকটি সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আছে। এছাড়া সীমানা ভিউ পয়েন্ট বলে যে অঞ্চল, সেটাও কাছে। হেঁটেই ঘুরে এল আমি বাদে আমার দলের বাকিরা। আমি সিকদেন সাহেবের সঙ্গে গপ্প গুজব করে ছাদে গেলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন সবে হাল্কা পরিষ্কার হচ্ছে। পরের দিন দেখা দেবে। ইতিমধ্যে বলে রাখি, এনারা দুপুরে এবং রাতে যা খাবার দিলেন, অমৃত। এখন অবধি সব থেকে ভালো। স্থানীয় ভাবে তৈরি ঘি দিয়েই বেশীরভাগ ভাত খেয়ে ফেলল।
ছাদ থেকে চারিদিক একঝলক দেখেই বুঝলাম বেশ সুন্দর। লেপচাজগতের বাজার মেরে দেবে খুব শিগগিরি। আর যেহেতু মাত্র একটি হোমস্টে, এই মুহূর্তে নেই কোন হুড়োহুড়ি। দুটি রুম থেকেই অপূর্ব কাঞ্চন দেখা যায়। পশ্চিম বলে অনেকটা বড় দেখায়। উচ্চতাও কম কিছু নয়। সান্দাখফু না হলেও খুব একটা খারাপ না। এবং আমি নিশ্চিত, সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়রাও বললেন যে বেশ কিছু নেপাল হিমালয়ের শৃঙ্গ দেখতে পাওয়ার সুযোগ আছে। ডিসেম্বর জানুয়ারিতে যারা যাবেন, আমার মনে হয় তারা দেখতে পেতেও পারেন। এতটা পশ্চিম খোলা অঞ্চল আমি সান্দাখফু ছাড়া পাই নি। একখান থেকে তুম্লিং, টুলুং প্রভৃতি দেখা যায়। মানেভঞ্জন দেখা যায়। অর্থাৎ নেপাল এবং সান্দাখফু যাবার রাস্তা, দুটোই পরিষ্কার। সেখানেই দেখলাম কি পরিমান ধ্বস নেমেছে। যেন পাহাড়ের গা থেকে এক গামলা মাটি কেউ খুলে নিয়েছে।
কাছেই বর্ডার পিলার। খুবই কাছে। হেঁটে ২ মিনিট। তারপরেই নেপাল। সান্দাখফু যাবার রাস্তা আসলে নেপাল ভারতের সীমান্ত ঘেঁসে। তাই কখনো যাবেন নেপাল আবার ফিরে আসবেন ভারতে। এখানেও তাই। একটু এগলেই রাস্তার একদিকে নেপাল, অন্য দিকে ভারত। সেই কারনে ফোনের খুব সমস্যা। বি এস এন এল এবং জিও পাওয়া যায়। অন্য কিছু নেই।
পরদিন ফেরার তাড়া আছে। তাই সব্বাইকে বলে দিয়েছি, ৯ টায় গাড়ি চালু করবো। পাহাড়ের রাস্তা, কোথায় কখন আটকে যাবো ঠিক নেই। তায় মিরিক, গোপালধারা চা বাগান দেখেই যাবো। সব্বাই ওই থান্ডায় উঠে তৈরি হয়ে নিলেন। একটা ঘরে জলের সমস্যা ছিল। এই উচ্চতায় জলের সমস্যা স্বাভাবিক। তাতেও আমাদের ঘর ও পাশের আর একটি ঘর খুলে দেওয়ায় সেই ঘরে টয়লেট ব্যাবহার করে তৈরি হয়ে আমাদের খাবারের টেবিলে পৌছতে দেরি হয় নি। দেরি হয় নি গাড়ি চালু করতেও। সিকদেন সাহেবের এবং তাঁর পরিবারের আপ্যায়ন, ভুলব না। এনারা সবাই ভালো। লেকপাজীর মত অনেকেই আমার বন্ধু। কিন্তু লেপকাজীর ভুটিয়া হোমস্টের বাইরে আর এরকম ভালোবাসা, আপ্যায়ন খুব কম পেয়েছি। সৌরভের লাক খুব ভালো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশ পরিষ্কার। সাধারনত তাই হয় এই সময়। বেলা বাড়লেই মেঘ এসে কুয়াশা নিয়ে একদম সব তছনছ করে। কাল দুপুরে আসার জন্য আমরা এরকম পরিবেশ পেয়েছিলাম। ঝকঝকে সকালে সাদা কাঞ্চন আমাদের যেন বিদায় দিল। এবং ঠিক। পশ্চিম আকাশে হাল্কা আবছা পর্বতের একটা রেখা আছে। হয়তো মেঘ আরও পরিষ্কার থাকলে কিছু দেখা যেত। দু একটি গাড়ির শব্দে পরিবেশ নষ্ট হয়তো হচ্ছে না। সকালের সে মুরগির ডাক, আর সঙ্গে পাহাড়ি মন ভালো করা আকাশ। ঘন নীলের নীলিমায় হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। শেষ দিন, সময় কম। যেটুকু রস পেলাম, শুষে নিলাম। তারপর প্রাতরাশ সেরে বাড়ি ফেরার তাড়া।
রাস্তায় প্রথম থামা, গোপালধারা চা বাগান। সম্ভবত এই শেষ এখানে আসা। তার কারন চা বাগানের কর্মচারীদের অসভ্য ব্যাবহার। সেই সঙ্গে ভ্রমণের জন্য অনুপযুক্ত কিছু দল। যারা গিয়েই চা বাগানের ভেতরে ঢুকে চা গাছ ছিঁড়তে শুরু করেছেন। স্থানীয়দের ভাষা এবং ব্যাবহার ততটাই পাত্রে দেবার মত নয়। বাইরের আউটলেট থেকে চা কিনে গাড়ি নিয়ে এলাম মিরিক। সেই পুরনো মিরিক। রোদ কুয়াশার লুকোচুরি খেলা মিরিক। তবে আজ কুয়াশা নেই। আছে নতুন তৈরি পার্ক, জলে বোটিং করার ব্যাবস্থা আর সামনে তৈরি করে রাখা বসার জায়গা। এখানে এসে ভালো গরম লাগছে। সোয়েটার খুলে ফেললাম। মিরিক অনেক ব্যাবসায়িক হয়ে গেছে। তবে ব্রিজের অন্যপাশে দেখলাম ঘোড়াদের নিয়ে যাওয়া বন্ধ। ফলে ওই জঙ্গল ট্রেকে যারা যান তাদের এখন অনেকটাই নিসছিন্তে হাঁটার ব্যাবস্থা হয়েছে। আগেই দেখেছি ৪ তারা রেস্তোরাঁ আছে। এবার সেখানে দুপুরের খাবার সারলাম। তারপর নেমে আসা। আসতে আসতে অনেক চা বাগানের সঙ্গে দেখা হল। দেখা হল সুন্দর দুধিয়া ব্রিজের সঙ্গেও।
এই পর্যন্তই। এরপর দার্জিলিং মেলে রাত কাটিয়ে আবার এই জীবন। ।
--------------------কেমন লাগল আপনারা জানিয়েছেন। কোন তথ্য লাগলে জানাবেন। তিনটে জায়গায় ছিলাম, আমার মনে হয়েছে তিনটেই নিজ গুনে সেরা। ড্রাইভার তেঞ্জিং ভাই সম্পর্কে বলি। অতি সুন্দর ব্যাবহারের, কোন তাড়াহুড়ো নেই। মুখে না নেই। বলা যায় একজন সম্পদ। ফ্যান্টাস্টিক হলিডে খুবই ফ্যান্টাস্টিক। আমাকে বলেছিল ছবি ভিডিও তুলে ওদের দিতে। দিয়েছি কিছু, আরও লাগলে নিতে পারো। এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ সব্বাই কে। আমার লেখা পড়ে সময় নষ্ট করার জন্য।








 

রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

দীঘা

 

একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে আজ লিখতে বসলাম। ২০ সালের ঘটনা। সদ্য হোটেল খুলতে থাকায় দীঘা যাবো প্ল্যান করি। ঘরে বসে থাকলে চুলকানি রোগ যাদের হয় তাদের মধ্যে আমি একজন। সাধারণত লোকজন ওই সময় দিঘা দূর দই কিনতে যেতেও ভয় পাচ্ছে। কিন্তু ওই যে বললাম, আমার এবং আমার পরিবারের বেশিদিন ঘরে থাকলেই চুলকানি হয়, তাই স্থানীয় এক ভ্রমণসংস্থা থেকে গাড়িটা ভাড়া করে সোজা দীঘা চলে গেলাম। পথে অনেক সমস্যা হচ্ছে শুনে ঠিক করলাম গিয়েই বুক করবো হোটেল। কিন্তু কথা বলে রেখেছি কলকাতা থেকেই। শ্বশুর শাশুড়ি বউ মেয়ে আর আমি। পাঁচ জনে। ড্রাইভার সাহেব কিছুতেই হোটেলে থাকবেন না। অনেকবার বললেন যে পেটের দায়, নাহলে গাড়ি চালিয়ে আসতেন না। কিন্তু কি করবে, আসতেই হল। 

 
যাই হোক, পৌঁছে এক নামি হোটেলের সমুদ্রের ধারে ঘর নিলাম। পাঁচজনের একসঙ্গে। একটা এপার্টমেন্ট টাইপ। সেটায় আরামসে সাতজন হয়ে যায়। আড় ঘরটা একদম সমুদ্রের ওপরে। বারান্দায় বসলে সারাদিন আরামসে সমুদ্র দেখা যায়। সমুদ্রের হাওয়া ও জলবায়ু উপভোগ করতে করতে গপ্প গুজব করে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেল। নিম্নচাপের সঙ্গে ভরা কোটাল ছিল। তাই সমুদ্রে নামতে দেয় নি। তাল কাটল বিকেলে। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে দেখলাম সামনের তটে একটা বস্তা মত পরে আছে, খানিক বাদে আবিষ্কার হল ওটি ভেসে যাওয়া কোন মানুষের মৃতদেহ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এলো, পলিথিনে প্যাক করে নিয়ে গেলো। মাথায় একটা খিচড়ে যাওয়া ভাব এলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। 

 
যাই হোক, রাতটা গপ্প গুজব করে শুতে চলে গেলাম প্রায় ১২টায়। আশেপাশে ঘর গুলতে তখনও আড্ডা ফুর্তি চলছে। তবে সারাদিনের ধকল ও মনের মধ্যে শেষ বেলার ঘটনার একটা নিম্নচাপ ছিল। ঘুম আসতে দেরি হয় নি। এই অবধি ঠিক ছিল। রাতের দিকে হটাত তিনটের একটু আগে সারা হোটেলে লোডশেডিং হচ্ছে আবার আলো চলে আসছে এমন হচ্ছে। ফলে ঘুমটা হালকা হয়ে যেতেই কানে এলো একটা চাপা মহিলা কণ্ঠে চিৎকার। খুবই সামান্য কিন্তু বোঝা গেলো। ধরমর করে উঠে বসতে এক দুমিনিট ভালো করে শুনলাম। হ্যাঁ, ঠিক শুনছি। এবার বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে যেতে গেলেই দেখলাম থেমে গেলো। এই প্রথমবার কি আমি ভুতের মুখমুখি হচ্ছি? কে চিৎকার করছে? এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এসে শুয়ে পড়লাম আবার। যা হবে কাল দেখা যাবে।
আমি যেখানে শুয়েছিলাম, সেটা একটা সিঙ্গেল খাট। পায়ের দিকে জামাকাপড় রাখার আলনা। খালি মনে হচ্ছে আলনাটার ভেতরে খশখশ শব্দে কেউ হাঁটছে। আমি উঠে যতবার টোকা দিচ্ছি থেমে যাচ্ছে। এই ভাবে প্রায় চারটে বাজে বাজে। এবার পায়ের শব্দ আসছে কমন বাথরুমের সামনে থেকে। বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।আর উঠে টোকা দেওয়া বা দেখার ক্ষমতা নেই। এই ঘরেই বউ মেয়ে আছে অন্য খাটে। তাদের ডাকলাম না। পাছে ভয় পায়। নিজের ওপরে রাগ হতে লাগল। এই ভাবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাহীন ঘটনা এর আগে আমি মুখমুখি খুব কম হয়েছি বা কম সময়ের জন্য অনুভব করেছি। রাগটা আরও হল কেন এরকম নিরিবিলি সময়ে দিঘা এলাম। দুদিন বাদেই আসতে পারতাম। রাগ থেকেই মনে হটাত সাহস পেলাম। এবার কোন পায়ের শব্দ পেলে হাতের সামনের লাগেজ ব্যাগ সোজা ছুঁড়ে দেবো। তারপর যা হয় হবে। অন্য ভাগে আমার শ্বশুর শাশুড়ি আছেন। তারা নিশ্চয়ই শব্দ শুনে উঠে আসবেন । আর কাল সকালেই হোটেলের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করবো। আমি এদের এখানে এসেই উঠি। অন্যদিকে। এদিক ভালো হবে বলে এমন বিপদে কেন ফেলল?
আর দুচোখের পাতা এক করতে পারি নি। তবে খশখশ শব্দ আর হয় নি। 
 

পরদিন ভোরে আমি উঠে বারান্দায় বসতেই সারারাতের ক্লান্তি কেটে গেল, মোহিনী সমুদ্রের রুপ দেখে। এই দীঘা চেনা দীঘা নয়। যেন নববধূ। নিল রঙের সমুদ্রের জল যেন আন্দামানের বিচ। আহা। তেমনি ভালো এক কাপ চা নিয়ে বসলাম। ইচ্ছা ছিল, মোহনা যাব, মাছ কিনবো। হল না। এদিকে দেখি বউ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। উঠেই "জানত ঘরটা না হন্টেড"
আমি চমকে উঠলাম। তার মানে সেও কিছু দেখেছে। হয় তো চাপা নারীকন্ঠে চিৎকার বা পায়ের শব্দ। " হ্যাঁ মনে হচ্ছে, তা তোমার কি দেখে মনে হল?"
"কাল বারান্দার দরজায় কেউ ধাক্কা মারছিল, আর মাঝে মধ্যেই আলো চলে যাচ্ছিল।"
"ধুস, সেটা কখনই সম্ভব নয়। আমি জেগে যেতাম। আলো যাচ্ছিল লোডশেডিং"
"তাহলে আমি হয়তো স্বপ্ন দেখেছি, আচ্ছা তুমি কি আমার গলায় কোন শব্দ শুনেছ?"
"মানে? তুমি চিৎকার করছিলে নাকি?"
"হ্যাঁ, ভয়ে মাঝরাতে মনে হয় আমাকে বোবায় ধরেছিল"
এতক্ষনে চাপা নারীকণ্ঠে শব্দের রহস্যভেদ হল। ওটা আমার স্ত্রীর গোঙ্গানি ছিল।
তাহলে পায়ের শব্দ। সেই রহস্য ভেদ হল শ্বশুরমশাই ওঠার পর। মাঝ রাতে এসি টা বড্ড ঠাণ্ডা করে দিয়েছিল। এদিকে এসির রিমট না পেয়ে ঘুম চোখে ওই অ্যাপার্টমেন্টের আঁতিপাঁতি করে দেয়াল খুঁজে বেড়িয়েছেন দুজন মিলে। অন্তত সুইচটা যদি পাওয়া যায়। আলো জালান নি। মাঝের দরজা খোলা ছিল। যদি আলোতে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায় তো? একবার দুবার বাথরুম এসেছেন আলো না জ্বালিয়ে। ফলে যত পায়ের শব্দ আসছিল ওনাদের থেকেই। নিজের ওপরে একটু বিরক্ত হলাম। যদি আর একবার বাথরুমের দিকে আসতেন ও আমি লাগেজ ব্যাগ ছুঁড়ে দিতাম, মহা বিপদে পড়তে হত।
মোটামুটি সব রহস্যের সমাধান হল। বিকেলে দেখা দুর্ঘটনা মানসিকভাবে দুর্বল করে অনেককিছু ভাবিয়ে নিয়েছে আমাদের দুজনকে দিয়েই। কিন্তু আলমারির ভেতরের খশখশ শব্দ সমাধান হল এর খানিক বাদে। পাশের ঘরের উতসব ক্লান্ত জনগণ সারারাত হাঁটাহাঁটি করেছেন। মাঝে মধ্যে তাদের আলমারির পাশে আসতে হয়েছে কোন কারনে। সেখানে পায়ের শব্দ হয়েছে। সেটা স্পষ্ট এই ঘর থেকে শোনা গেছে। দুপুরে ঠিক এক শব্দ আসতে ভালো করে লক্ষ করতে বুঝতে পারলাম। তবে যাই হোক বাকি সময় নষ্ট করি নি। বাকি সময় হই হই করে, সমুদ্রের পাশে বসে আড্ডা দিয়ে, মানসিক চাপ দূর করে বাড়িতে ফিরেছি।

শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৯

মে'র পাহাড় মেঘের বাহার -------------------- [পর্ব 3]



 মে'র পাহাড় মেঘের বাহার

হোটেল সানরাইস একদম উঁচু টিলাতে। অর্থাৎ সব থেকে ভালো ভিউ হওয়া উচিত। কিন্তু মেঘ আর মেঘ। প্রসঙ্গত বলে রাখি সানরাইস ছাড়াও বন্ দপ্তরের একটি বাংলো আছে। আরও কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হোটেল আছে। যেমন নম বুদ্ধ, শেরপা চ্যালেট, ইত্যাদি। সবাই প্রায় ২৭০০ থেকে ৩০০০ ভাড়া নেয় প্রতি রুম শুধু থাকার জন্য, তিন জনের। সান রাইস ২৭০০ করে নিয়েছে এক রাত ট্রিপিল বেড, শুধু থাকার। ঘর খুব একটা বড় নয়। প্রধান সমস্যা জল। পশ্চিমি টয়লেট থাকলেও জল ঘর প্রতি এক বাল্টি। ওই ঠাণ্ডায় জল লাগার কথা নয়। খাবারের দাম চড়া। রেট চার্ট ছবি নিয়েছি। দিয়ে দেবো। সকালে বেশ খিদে পাওয়ায় ভাত খেয়ে ফেললেও রাতে ম্যাগি খেয়েই কাটিয়ে দিলাম। প্রায় সব হোটেলে এক দাম। স্বাভাবিক। নীচের থেকে ওপরে নিয়ে যাওয়া কষ্ট সাধ্য, খরচা আছে।
এবার আসি কি দেখলাম। দুপুরে ঢুকলেও সন্ধার আগে পর্যন্ত ঘর বন্দী হয়ে রইলাম। তার কারন মেঘ ও সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে বয়ে চলা হাওয়া, বৃষ্টি। বৃষ্টির পাহাড় এক অন্য মাধুর্য। কিন্তু সেটা দেখার জন্য এত উচ্চতায় ওঠার দরকার পড়ে না। এখানে আসা চাম্লং থেকে এভারেস্ট, মাকালু, লতসে সহ কাঞ্চন পরিবার হয়ে চমলহরি পর্যন্ত দর্শন করতে। সন্ধে বেলা খানিকটা কাঞ্চন পরিবারের পূর্ব দিকের মাথা দেখা গেলো। লজ্জায় জড়সড় হয়ে। আর একটা প্রাকৃতিক ঘটনা দেখলাম। বেশ খানিকটা নীচে মেঘ, সেই মেঘে নীচে বৃষ্টি হচ্ছে, এমনকি বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেঘ দেখেছি নীচে। কিন্তু তাতে বৃষ্টি ও বজ্র দেখি নি। সমস্যা শুরু রাতে। আমি ভুল করে গায়ে শুধু একটা জামা পড়ে শুয়ে পড়েছিলাম। মাঝ রাতে প্রচন্ড ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাপতে থাকলাম। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। উচ্চতা জনিত একটা সমস্যা ছিলই। মাথা ধরে ছিল। সেই সঙ্গে শ্বাসকস্টে যেন প্রান বেড়িয়ে যাওয়ার যোগাড়। হাতের কাছে পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল। দুই টান মারতেই একদম ফিট। তবে ভালো ঘুম হয় নি।
পরের দিন অর্থাৎ ২২ মে ভোরে উঠে হোটেলের ছাদে গেলাম। অনেকেই উঠেছেন। কাঞ্চন পরিবারের কিছুটা দৃশ্যমান। আর দূরে ভাসা ভাসা যেন এভেরেস্ট মাকালু ইত্যাদি। ওই না দেখাই বলা যায়। নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। এই রকম বা তার থেকে ভালো পশ্চিম সিকিম থেকে দেখা যায়। টাইগার হিল থেকেও মাকালু বা লতসে দেখেছি এর থেকে ভালো। হয়তো আবার কখনো এভারেস্ট।
গাড়ি ৭ঃ৩০ এ বলা ছিল। সেই বোলেরো এসে গেলো। মালপত্র চাপিয়ে নেমে এলাম মানেভঞ্জন। সঙ্গে সেই মেঘে ঢাকা অত্যাচারি ১০ কিমি রাস্থা ও বিপদ সঙ্কুল পুরো ৩৭কিমি। মাঝে একটু টুম্লিঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রাতরাশ। মানেভঞ্জনে আবার গাড়ি বদল। এবার লেপচাজগত। সেই গল্প আবার পরের দিন।

কুয়াশা মাখা ছবি যতটা সম্ভব কম এডিট করে দিলাম।
 




Vijag to Arakku

শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০১৯

মে'র পাহাড় মেঘের বাহার -------------------- [পর্ব 2]


সকাল সকাল উঠে সূর্যোদয় দেখেই বেড়িয়ে পড়া।


 সেই মত সকাল ৭ টায় গাড়ি নিয়ে হাজির বিকাশ। আমাদের আগের দিনের সারথি। আগের দিন ও নিয়েছে ৩৫০০ টাকা, আজকে নেবে ৮০০। পৌঁছে দেবে মানেভঞ্জন। প্রাতরাশে রুটি আর তরকারি করেছিলো। মোটের ওপরে প্রেম্বা দুপকার মা রান্না খারাপ করেন নি। সেটা খেয়েই বেড়িয়ে পড়া। এখানে বলে রাখি প্রেম্বা দুর্গাপুরে পড়াশোনা করে। কোলকাতায় আসে। ওকে ফোন করে বুকিং করা যায়। ও বাড়িতে বলে রাখে। তবে একটু আগে সব কিছু বলে রাখা ভালো। কারন এখানে মোবাইল টাওয়ার প্রায় নেই বললেই চলে। সম্ভবত নেপাল-ভারত সীমান্ত হওয়ায় মোবাইল কোম্পানি গুলি গুলিয়ে ফেলেছে।
গাড়ি চালু হতে পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে অনেকখানি নেমে আসা। কারন মানেভঞ্জন অনেক নীচে। প্রায় ৪৫ মিনিট পাহাড়ি পথ অতিক্রান্ত হলে এলো মানেভঞ্জন। ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ। তবে প্রায় সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। হোটেল আছে। যারা হেঁটে উঠতে চান এখানেই থাকেন। সকাল সকাল হাঁটা শুরু করেন। এখানে গাড়ি পরিবর্তন করতে হবে। ল্যান্ড রোভার অ্যাসসিয়েশন থেকে ভাড়া নিতে হবে ল্যান্ড রোভার বা বোলের। সকাল ৮ টার কিছু আগেই পৌঁছে গেছি। কিন্তু বুকিং শুরু হতে এখনো প্রায় এক ঘন্টা বাকি। এই ফাঁকে আমার হাতে ঢুকে গেলো টেডব্যাগ ইঞ্জেকশান। আগের দিনের কেটে যাওয়ার ফল স্বরুপ। বুকিং শুরু হতেই ওদের অনুরোধ করা হল যাতে আমাদের একটি বোলের দেয়। ল্যান্ড রোভার উচ্চতায় টান দিতে ওস্তাদ। কিন্তু আমার রোগা শরীর ও প্রচুর ব্যাগপত্র দেখিয়ে একটু বড় বোলের নেওয়া হল। ৪এক্স৪ বোলের। সাধারণ গাড়ির থেকে অনেকটা বেশী ক্ষমতা সম্পন্ন। একরাত থাকা, যাওয়া আসা নিয়ে দাম নিল ৫৫০০। তবে কিছু ব্যাগ বেশী ভারি হওয়ায় রেখে যেতে হয়েছে অফিসে। এক অনুরোধে রাখতে দিয়ে দিলো। সুন্দর ব্যাবহার। গাড়ি ছাড়তেই নজরে এলো শিঙ্গলিলা জাতীয় উদ্যান। ঢোকার মুখে জনপ্রতি ৮০ টাকা করে টিকিট কেটে, গাড়ির জন্য ৮০ টাকা দিয়ে, ক্যামেরা (স্থির চিত্র) প্রতি ১০০ টাকা ও ভিডিও ক্যমেরা ৪০০ টাকা প্রতি ক্যমেরা দিয়ে তবেই ঢোকার অনুমতি মিলবে। এই রেট ভারতীয়দের জন্য। এই রাস্থা দিয়েই হেঁটে যেতে হয়। তবে হেঁটে গেলে সঙ্গে গাইড বাধ্যতামুলুক। গাড়ি উঠতে শুরু করলো।
গাড়ি উঠছে না উড়ছে? প্রায় ৪৫-৬০ ডিগ্রী এক একটি খাঁড়াই। কিন্তু রাস্থা পাকা ও ঝকঝকে। বুঝতে পারছি কেন গাড়িগুলি বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন। এই ভাবেই একে একে টুম্লিং, চিত্রে ইত্যাদি পেরিয়ে প্রথম থামা প্রায় ২ ঘন্টা পরে গইরাবাসে। এই রাস্থা অদ্ভুত সুন্দর। বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য। তেমন ভয়ংকর খাঁড়াই। একটা ভয়ংকর সুন্দর অভিজ্ঞতা।
গইরাবাসে একটু চা মোমো খেয়ে শুরু হল সংগ্রাম। সঙ্গে ঢেকে আসা মেঘ। সামান্য এক হাত দূরের রাস্থা দেখা যাচ্ছে না। আবার মেঘ কেটে গেলেই বেড়িয়ে আসছে সুন্দর রডডেন্ড্রন পাহাড় জুড়ে। না কাঞ্চন বাবুর দেখা নেই। আর রাস্থা? সে না বলাই ভালো। আসলে এখানে আদপেই কোন রাস্থা নেই। এই ভাবেই কালিপখরি পৌঁছে দেখলাম ছোট্ট সুন্দর জলাশয়। খুব বেশী কিছু দেখা গেলো না মেঘের জন্য। এর পর প্রায় প্রান হাতে নিয়ে, গাড়ি স্কিড করিয়ে সান্দাকফু পৌছতে আরও এক ঘন্টা। এই শেষ এক ঘন্টা যেন প্রান হাতে নিয়ে বসে থাকা। হয়ত মেঘ না থাকলে প্রাকৃতিক দৃশ্য মন মাতাতো। কিন্তু আজকে সম্ভব নয়। এই ভাবেই প্রায় ১২০০০ ফুটে পৌঁছে গেলাম সান্দাখফু। হোটেল সানরাইস। আবার কালকে। সঙ্গে থাকুন।

মে'র পাহাড় মেঘের বাহার Part- 1




পর্ব ১

একটা ছোট দল, ৬ জন, এর বেশী লোক নিয়েই পাহাড়ে যেতে অভ্যস্ত সুগত বসুর এটা প্ল্যান্ড ট্যুর ছিল না। কারন এই ট্যুর নভেম্বরে তৈরি করা ছিল। 

হটাত আমার কাজের খানিকটা অবকাশ মিলতেই মাস খানেক আগে আমি ধরলাম চলুন কোথাও যাই। কল্যাণী বৌদি এই সময় খুবই ব্যস্থ থাকে। কিন্তু আমার অনুরোধ ফেলতে পারলো না। রাজি হয়ে গেলো । ফলে এক পা এগিয়ে থাকা সুগত দা চটপট নভেম্বরের ট্যুর এখনি করতে তৈরি হয়ে গেলেন। প্ল্যান করাই ছিল, জোরেপোখরি, সান্দাখফু, লেপচাজগত, লাটপাঞ্চার হয়ে শেষ পাতে মহানন্দা বনপ্রান বীক্ষণ শেষ করে ফিরব। এত দেরি করে প্ল্যান করলে যা হয়, টিকিট দুজনের অপেক্ষমান। বাকিদের কোটায় উঠলেও আমার টিকিট শেষ পর্যন্ত অনেক ঝামেলা করে একটা সাইড লোয়ার, তাও স্লিপারে। অর্থাৎ গরমে ঘামতে ঘামতে ট্রেনে ওঠা। তবে জানলার ধারে হওয়াতে রাতে ঘুমের অভাব হয় নি। ভোট দিয়েই ব্যাগ পত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। রাতের কষ্ট অতটা না হলেও এন যে পি তে নামার পরেই ভয়ানক গরম বলে দিলো যাও কয়েকদিন ঘুরে এসো। রাতে ট্রেনে আনন্দদা (ঘোষ হাজরা) চিকেন রোল এনেছিলেন। কিছুই খাবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু জোর করায় খেয়ে নিলাম। কল্যাণী বৌদি দারুন পনিরের তরকারি এনেছিল। কিন্তু গরমে পেট ঠিক থাকবে কিনা ভেবে খেলাম না। লেপচা জগতের রবিন তামাঙ্গের ব্যাবস্থা করা গাড়ি (সুমো গোল্ড) তৈরি ছিল স্টেশনের ঠিক বাইরেই। আমরা বেড়িয়ে তাতে উঠে রওনা দিলাম জোরপোখরির দিকে। জোরপোখরি দুই ভাবেই যাওয়া যায়। মিরিক হয়ে বা ঘুম হয়ে। মিরিক হয়ে গেলে পথে কার্শিয়ং পড়বে না। আমরা ওই দিক দিয়েই এগলাম। ভাড়া এদিক দিয়ে গেলে বেশী। আপনি নেমে দেখে নিতে পারবেন মিরিক লেক। অনেকবার এই রাস্থায় আসার সুবাদে জানি যে এই রাস্থায় প্রচুর কমলালেবু চাষ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এখন সময় নয়। আমরা এগিয়ে চললাম। পথে সুখনার আগেই আমাদের জল খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। এর মাঝে এসেছে সীমানা, পশুপতি গেট প্রভৃতি নেপাল যাওয়ার বা নেপালের সঙ্গে লেপ্টে থাকা সীমানার অংশ গুলি। এখানে কাঁটাতার নেই। তাই বর্ডার পিলার দেখেই বুঝে নিতে হবে কখন ভারতে কখন নেপালে। কিন্তু মিরিক পেরতেই বউদির শরীর খারাপ লাগায় আমরা গোপালধারা চা বাগানে দাঁড়ালাম না। এই চা বাগানের অতুলনীয় সৌন্দর্য একবার আমার মন কেরেছিল। এই বাগানে চা গাছের মধ্যে দিয়ে হেটে যাওয়া যায়। এবার নামলাম না। আরও ঘন্টা খানেক বাদে এসে পৌঁছলাম জোরপোখরি। বেশ খানিকটা উঁচুতে। উচ্চতা প্রায় ৭০০০ ফুটের একটু বেশী। এখানে জি টি এ নিয়ন্ত্রিত একটা সুন্দর বাংলো আছে। কলকাতার সল্টলেক গোর্খা ভবন থেকে বুকিং হয়। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে জোটে নি। ফলে পাশেই একটা একদম নতুন হোমস্টে তে থাকার বন্দবস্ত করেছিলো সুগতদা। সেখানেই মালপত্র রেখে বাইরেটা দেখতে বেরলাম। বাইরে ঠাণ্ডা ভালই। কিন্তু হটাত হটাত মেঘে সব ঢেকে দিচ্ছে। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। একটা বড় লেক আছে। তাতে কালিয়া দমনের সাপের ফনা। আর আছে বাহারি ফুলের মেলা। খানিকবাদে দর্শকদের মনরঞ্জনে ছেড়ে দেওয়া হল বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। আজ মেঘে ঢেকে আছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। নাহলে আগের ছবি অনুসারে এই লেকের সামনে হাঁসের সারির সঙ্গে সঙ্গে শান্ত স্নিগ্ধ কাঞ্চন একটা অপরুপ মায়া সৃষ্টি করে। কিন্তু আমার বিধি বাম। আমার পায়ে লেগে গেলো লোহার আঁচড়। উঠে থাকা খোঁচার মত একটূকরো লোহার রডে আমার পা কেটে রক্তারক্তি। সেরকম জ্বালা নেই কিন্তু টেডব্যাগ ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণা সহ্য করার প্রতিশ্রুতি নিয়েই বাকি দিনটা মেঘ দেখে আর ঘিরে থাকা উঁচু উঁচু গাছের সাড়ি দেখেই কাটিয়ে দিলাম। খাবার সকালে নিরমিশ দিলো। রাতে চিকেন। খুব একটা সেদ্ধ নয়। তবে খেতেও খারাপ লাগে নি। জনপ্রতি ১০০০ টাকা। দাম বেড়ে গেছে। রাতের দিকে জমিয়ে পড়বে ঠাণ্ডা। তবে বৃষ্টিও হল। যা কিনা পরের দিনের সূর্যোদয় আমাদের দেখিয়ে দিলো। কিন্তু কাঞ্চন এলেন না। ২২ তারিখ যাবো সান্দখফু। সে লেখা নিয়ে আসছি পরের পর্বে।

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

Garhwall as story


শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮

গাড়োয়ালের আলিগলি


প্রথম পর্ব

হরিদ্বার

গাড়োয়াল শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে উঁচু উঁচু বরফাবৃত গাড়োয়াল হিমালয়ের শৃঙ্গ সঙ্গে নীচে দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী গঙ্গার বা যমুনার উপনদীগুলি। স্বপ্নের কাছাকাছি এই অঞ্চলে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিকল্পনা প্রায় ১ বছরের। সুগত বসুর নেতৃত্বে আমাদের ১৯ জনের দল ১৮ সালের অষ্টমীর দিন ১৭ই অক্টোবর হরিদ্বারে মিলিত হব। হরিদ্বার গাড়োয়ালের প্রবেশদ্বার বলা যায়। এখান থেকে শুরু করা যায় গাড়োয়াল হিমালয় ভ্রমন। সেই মত বিমানে দমদম থেকে দিল্লী, সেখানে রাতে পৌঁছে পরের দিন ভোরে দেরাদুন শতাব্দী ট্রেনে সাড়েএগারটা নাগাদ হরিদ্বারে পৌঁছলাম। হরির দ্বার মানেই সেখানে ধর্মীয় ভাব থাকবেই। হর কি পউরি ঘাট এর প্রানকেন্দ্র। আমাদের হোটেলের নামও হোটেল হরকিপউরি। একদম ঘাটের পাশে। এছারা আরও অনেক হোটেল ঘাটের আশেপাশে আছে, যেমন "গঙ্গা বেসিন"। শহর এবং হোটেল পরিষ্কার নয় খুব একটা। এখানে সেখানে নোংরা। গঙ্গা লাগোয়া হোটেলগুলির দাম খুব চড়া। স্টেশন থেকে পৌছতে অটো বা টোটো ভরসা। নো এন্ট্রি ভয় দেখিয়ে প্রথমেই অনেক দাম চাইবে, দামাদামিতে কমবে। নিরমিষ খাবার। তবে হৃষীকেশের দিকে রাস্থায় কিছু আমিষ পাওয়া যায়। খাবারের মান খারাপ নয়, দাম বেশী, বেশীরভাগ খাবারের হোটেল পরিষ্কার নয় তবে আমাদের হোটেল পরিষ্কার। জনপ্রতি ১০০-১২০ টাকা লাগবেই এক এক বেলা খেতে। আমরা পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেড়িয়ে পরলাম ঘাট দেখতে। ঘাটে পৌছনোর জন্য ব্রিজ আছে, ব্রিজ থেকে দূরে ঘড়িঘর দেখা যায়। ঘাটে পৌঁছে একটু মাথায় গঙ্গা জল দিলাম। গঙ্গা এখানে স্রোতস্বিনী, কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে চ্যানেল দিয়ে দ্রুত বয়ে চলেছে। দূরে মহাদেবের সুউচ্চ মন্দির। এখানেই বিকেলে আরতি ও পুজাপাঠ হবে। ইচ্ছা হোল "কঙ্খল" যাওয়ার। ২৫০ টাকা অটো ভাড়া করে আমরা ৫ জন চলে গেলাম সেখানে। "কঙ্খল" শহরের দক্ষিণে অবস্থিতঅঞ্চল। এখানে দক্ষেশ্বর মহাদেব মন্দির, সতী কুণ্ড, মা মনসা মন্দির, আনন্দময়ী মায়ের মন্দির। দক্ষেশ্বর আমাদের প্রথম গন্তব্য। এই মন্দিরের পাশদিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এখানে পুজাপাঠের পর বলা হয় স্ত্রী স্বামীর পা ধুয়ে পুণ্য অর্জন করতে। দক্ষযজ্ঞ ঘটনার উল্লেখে নিবেদিত এই মন্দির। পাশেই সতিকুন্ড (বলা হয় এখানেই সতীমা জীবন ত্যাগ করেন) ও মামনসা মন্দির। সেখান থেকে একটু এগিয়ে মাআনন্দময়ী আশ্রম। বাঙালি অধ্যুষিত এই আশ্রমে ঢুকলে মন শান্তিতে ভোরে যায়। 
কঙ্খল থেকে ফিরে আবার গঙ্গার ধারে। খানিক সিগাল জাতীয় পাখির আনাগোনা দেখেই  আসন গ্রহন করতে হল হর কি পৌরি ঘাটের ঠিক উল্টো দিকে। ভালো ভিড় এর মধ্যেই। পূজার সময় গোনা শুরু। উল্টোদিকের ঘাটের সিঁড়িতে বসেপরে প্রথমে গঙ্গাপূজা দেখতে লাগলাম। সাড়ে পাঁচটা থেকে আধঘণ্টা মত পুজাপাঠ হওয়ার পর শুরু আরতি। এর মধ্যে অনেকেই নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন পাতার ভেলায় প্রদীপ। এক স্বর্গীয় অনুভুতি। ১৫ মিনিট ধরে কম করে ১০ জন পুরোহিত গঙ্গামাকে আরতি করলেন। সঙ্গে ঘণ্টা ও স্ত্রোতর শব্দ পরিবেশকে ভাবগম্ভির করে তুলল। লোহার শিকল ঝোলানো আছে, সেগুলো ধরে স্নান করা যায়। কিন্তু আরতি দেখায় প্রধান বাঁধা এগুলি। তবে প্রায় ১৫-২০ মিনিট চলা এই ধর্মীয় আচার মনকে শান্ত ও গম্ভির করবেই। "জয় গঙ্গা মাইয়া" ধ্বনিতে শেষ হওয়ার পর আর বিশেষ কিছু করার ছিল না হোটেলে ফিরে পরের দিনের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া। দুঃখ একটাই, এই ভ্রমণসূচিতে আমরা হৃষীকেশ রাখিনি, তাই রামঝুলা লক্ষণঝুলা অন্য সময়। তবে হরিদ্বারে বা দেরাদুনে দুইদিন থাকলে হৃষীকেশ দেখে আসা সম্ভব। 
ধনৌলটি
গাড়োয়াল সুন্দরী ধনৌলটি এই অঞ্চলের মধ্যে সব থেকে সুন্দর বলেই মনে হয়। সেই উদেশ্যে ১৭ই অক্টোবর সকাল ৮ টায় সবাই হরিদ্বারে ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে মিলিত হয়ে সেখান থেকে টেম্পোট্রাভেলারে চেপে দেরাদুন হয়ে চললাম ধনৌলটি। দেরাদুন পেরতেই চড়াই শুরু।তার আগে রাস্তায় প্রাতরাশ সেরে নিলাম। এখানে ডিম পাওয়া গেলো। ধনৌলটি বিখ্যাত লালিগুরাস বা রডদেন্ড্রন সহ বিভিন্য ফুল ও দিগন্ত বিস্তৃত বরফাবৃত পর্বতমালার দর্শনের জন্য। আমাদের প্রায় চার ঘন্টা সফর জুড়ে উন্মাদনা সঙ্গে নতুন স্বপ্ন বোনা শুরু। পথমধ্যে হনুমানকুলকে বাই বাই করে, অজস্রবার ছবি তুলে আমরা পৌঁছলাম ধনৌলটি ইকোপার্ক সংলগ্ন আওারা ক্যাম্পের ওপরে। এই "আওারা ক্যাম্প" আজকে আমাদের বাসস্থান। রাস্থা থেকে প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট নীচে পর পর তাঁবু খাটানো অঞ্চল নামা ওঠার জন্য একদম মসৃণ নয়। বরং একটু বিপদসঙ্কুল। নামা ওঠার রাস্থা একটু খাঁড়া ও সাবধানে না নামলে স্লিপ করে পড়ে চোট লাগার সম্ভাবনা আছেই। কিন্তু অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত তাঁবুর সাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার পর মজাই আলাদা। ঠাণ্ডা কনকনে। সঙ্গে চারিদিক খোলা থাকায় হাওয়ার দাপট। ১৮০ডিগ্রি খোলা অঞ্চলে পর পর শ্রীকান্ত(6133 m), গঙ্গোত্রীর তিনটি চূড়া(6672 m max), জাওনলি (6630 m), খাতলিং গ্লেসিয়ার ও থায়াল সাগর( 6361 m) দেখা দেবে।
এক ধাপ উঁচুতে এদের রান্নঘর। বুকিং এর সময় আমাদের থাকা খাওয়া ধরা ছিল। পৌঁছেই সুন্দর পানীয় মাধ্যমে স্বাগতম জানালো। অনেকটা নামার কষ্ট এক নিমিষে উধাও। দুপুরের খাওয়া ভালো ছিল। খাওয়া শেষে যে যার তাঁবুতে গিয়ে হাল্কা বিশ্রাম নিয়েই বেড়িয়ে পরলাম বিকেলের দৃশ্য দর্শনে। মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে কেউ কেউ দর্শন দিলেন আমাদের। আমার মনে হল  শ্রীকান্ত, গঙ্গোত্রীর তিনটি চূড়া ও থায়াল সাগরআমাদের দর্শন দিয়েছেন। সোনালি রঙের আবিরের খেলায় মেতে উঠলো দিগন্ত। অবগুণ্ঠন খুলে ধীরে ধীরে স্বপ্নপুরী বানিয়ে ফেললেন হিমালয়। দোলনা খাটানো ছিল। সেখানে বসে দোল খেতে খেতে সূর্যাস্তের পর্বতমালা দর্শন যেন শুরুতেই জানিয়ে দিলো কি হতে চলেছে এই ভ্রমন। এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু আওারা ক্যম্প আমাদের জন্য রাতে আরও একটু নীচে ক্যম্পফায়ার, নাচাগানা আয়োজন করে ওই ঠাণ্ডার রাতকে আরও মায়াবি করে তুলল।     
তাঁবুগুলির সঙ্গে টয়লেট যুক্ত। খুব একটা পরিষ্কার না হলেও সেদিকে আমাদের নজর ছিল না। আমার মেয়ে বউয়ের এই প্রথম তাঁবুতে রাত কাটান। প্রত্যেক তাঁবুতে ৩ টি করে খাট পাতা। রাতে ঠান্ডা ভালই লাগবে। কিন্তু রাত কাটলেই যে দৃশ্য সামনে আসবে তা ভুলিয়ে দেবে সব কষ্ট। উপরে বর্ণিত সব চুড়া খানিখনের জন্য সবার সামনে আবার উন্মুক্ত হল। কিন্তু বিধিবাম। বেশিক্ষণ থাকলেন না। আবার মেঘের আড়ালে। যেন লুকোচুরি খেলা। এদিকে আজকে তেহরি যাওয়ার তাড়া আছে। সঙ্গে আবার উঠতে হবে প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট। তাই প্রাতরাশ সেরে নিয়েই শুরু হল পরের দিনের প্রস্তুতি।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

ধনৌলটি- তেহরি

প্রাতরাশ সেরে আবার ৫০০-৬০০ ফুট চড়াই ভেঙ্গে ওপরে উঠে আসা সহজ ছিল না। বড্ড বুকে চাপ লাগে। উচ্চতা কম হওয়ায় সমস্যা হল না। তবে বয়স্কদের একটু সময় বেশী লাগলো। খাঁড়াই হওয়ায় পা হরকে যাওয়ার ভয় থাকে। ভালো গ্রিপের জুতো পরে আসা অবশ্যক। আমার স্ত্রী কন্যা আগেই দ্রুত উঠে গেলো। মালপত্র নিয়ে চলে গেলো ক্যাম্পের লোকজন। এদের পরিশ্রম কাবিলে তারিফ। আমি মিনিট ১৫ সময় নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। রাস্থার পাশেই গাড়ি রাখা ছিল। সবাই উঠে যেতে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। একটু এগোতেই রাস্থার ধারে পাইনের সারি জানান দিলো এটাই ধনৌলটি ইকোপার্ক। এখানেই পাইনের সারির ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঝলমলিয়ে ওঠে। ব্যাকগ্রাউন্ডে পর্বতরাজী। যেন এক স্বপ্নপুরী।
আবার গাড়ি চলতে লাগলো। প্রায় ঘন্টা তিনেক চলার পর চাম্বা পেরতেই একদিকে একে বেঁকে ভাগীরথী। এখানে বাঁধ আছে। এই বাঁধ তৈরির সময় অনেককে পুনর্বাসন দিতে হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে সেই গল্প শুনলাম। ফলে পুরাতন তেহরি এখন বসবাস অযোগ্য। তাদের নিয়েই একটু ওপরে তৈরি হয়েছে নতুন তেহরি। এখানে একটি ছোট জলের ধারা এসে ভাগীরথীতে মিশেছে। এবং জলাধার মিশ্রিত এক সুন্দর লেকের সৃষ্টি করেছে। জলের গতি বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এখানে ভাগীরথী ধির স্থির। কিন্তু চারিদিকে উচ্চ পর্বতমালা বেষ্টিত হয়ে লেকের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের দলের বেশীরভাগের আজকে থাকার জায়গা হোটেল মানাআর। ১২০০ টাকা রুম প্রতি ভাড়ায় এখানে প্রায় সবাই থাকলেও দুটি পরিবারের জন্য অন্যত্র ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়োয়াল মন্ডলের এখানে সুন্দর কটেজ আছে। কিন্তু ভাড়া কম করে ৫০০০ টাকা। এছাড়া সরকারি পরিকল্পনায় এখানে টুরিসম বৃদ্ধির উদ্যেশ্যে তৈরি হয়েছে ভাসমান কটেজ। সেগুলি লেকের ওপরে তৈরি ভেলায় ভাসমান। পারে যাতায়াতের জন্য নৌকা আছে। দাম? আকাশছোঁয়া। প্রায় ৬০০০ দিন প্রতি দুজনের জন্য। একটু চেপে খরচ করা আমাদের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমরা গেলাম তেহরি বাঁধ কর্তৃপক্ষের হোটেলে। এখানে থাকার রুম পাওয়া মুশকিল হলেও ফাঁকা থাকলে দিয়ে দেয়। আমাদের এক কলকাতার বন্ধুর মাধ্যমে চেষ্টা করেও পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওখানে গিয়ে কথা বলতে দুটি ঘর পাওয়া গেলো। ভাড়া ঘর প্রতি ২৫০ টাকা। সব থেকে সস্থা ও অকল্পনীয়। ঘরগুলি সাজানো এবং একদম নদীর পাশেই। একটু অযত্নের ছাপ আছে। তবে সামনের বিস্তৃত খোলা অঞ্চলে এবং পেছনের ফুলের বাগানের পাশেই ভাগীরথী বহমান ধারা এবং একটু দূরে বাঁধ যেন এক স্বর্গীয় অনুভুতি। খাওয়া এখানে সম্ভব হল না। দশেরার ছুটির কারনে আমাদের খেতে হল হোটেল মানাআরে।হোটেল মানাআর থেকে দৃশ্য একটু আলাদা। অনেকটা পাখির চোখের দৃশ্য এখানে ফুটে ওঠে। কিন্তু দুজায়গা থেকেই সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। 
আমরা বিকেলে গেলাম জলক্রিয়ায়। এখানে বোটে করে ভাগীরথীর এপার ওপার করায়, আধ ঘণ্টা জনপ্রতি ৪০০ টাকায়। এছাড়া ওয়াটার স্কুটার থেকে শুরু করে ভাসমান রেস্টুরেন্ট, সব এখানে উপস্থিত। দাম একটু চড়া এই যা। ছাউনিদেওয়া সাধারণ মটর বোটে লেকতুল্য নদীতে এপার ওপার করে পড়ন্ত সূর্যালোকে মোহময় তেহরি যেন মায়ালোকে পরিণত। এখানে জলকেলি শেষ হতেই একটু দৃশ্য দর্শন করে আবার গাড়িতে উঠে পরা। ঠাণ্ডা পড়তে শুরু সূর্যডোবার সাথে সাথে। তাই অন্ধকারের সাথে সাথে আমাদের কাজ কম্ম সবই ঘরে বন্দী হয়ে গেলো। পরের দিন অনেক কাজ। যাবো উত্তরকাশি। 
উত্তরকাশি 
ঘন্টা ৪ এর রাস্থা কিন্তু আশেপাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভোলাবেই। ভোর ভোর বেড়িয়ে এলাম। চিনিয়ালসর হয়ে ধরাসু বেন্ড দিয়ে উত্তরকাশির হোটেল গঙ্গাশ্রয় আজকে আমাদের গন্তব্য। কিন্তু গাড়ি গতি প্রায় কি করে? চিনিয়ালসরের রাস্থা ধরতেই যেন স্বর্গে প্রবেশ। ধীরে ধীরে সূর্যদেবতার আগমন, ডান দিকে নীচে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, দূরে দেখতে পাওয়াযাচ্ছে গাড়োয়াল মণ্ডলের ভাসমান কটেজ। পাহাড়েঘেরা ভাগীরথীর পাখিরচোখে দৃশ্যায়ন। পূর্বআকাশ রক্তিম। পুরো অঞ্চল্টাই আমাদের সামনে। বাঁকে বাঁকে শিহরন। বার বার গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা আর চোখের আরাম। দেরি হয়ে গেলে উত্তরকাশিতে আমাদের পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানে সমস্যা হতে পারে। তাই একটা তাড়া ছিলই। নাহলে এখানেই থেকে যাওয়া যায় জন্মের পর জন্ম। এই ভাবেই ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম ধরাসু বেন্ড। এখানে রাস্থা দুভাগ হয়ে একভাগ গেছে বারকোট হয়ে যমুনেত্রী বা দেহরাদুন আর একভাগ উত্তরকাশি হয়ে হরসিল এবং গঙ্গোত্রী। আমরা আজকে ডানদিকের উত্তরকাশির রাস্থা ধরলাম। তার আগে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। তবে অপরিস্কারের ধারা এখানেও বজায় আছে। সুলভ সৌচালয়ে প্রবেশ খুবই কষ্টকর।
গাড়ি চলতে শুরু তো করলো কিন্তু আবার গাড়ি থামতে হল। প্রথম একা একা ধরা দিলেন মাউন্ট বান্দরপুঞ্ছ। একটা বাঁক পেরতেই। বাঁদরের লেজের মত বলে এনার নাম বান্দরপুঞ্ছ। তিনটি শিখর নিয়ে দাঁড়িয়ে। ছবি তোলার শত্রু ইলেকট্রিক তারের বাঁধা টপকে মনের মত ছবি হয়ত তোলা গেলো না, কিন্তু চোখের আরাম ষোলোআনা। আবার গাড়ি এগিয়ে চলল। ঘণ্টা চারেক পড়ে প্রধান উত্তরকাশি শহরে প্রবেশ। এখানে প্রায় আধুনিক সুযোগসুবিধা সবই পাওয়া যায়। তবেই এখানেই শেষ। এর পরে সবই কষ্টের। আমরা এখানে প্রথম দাঁড়ালাম কৈলাস আশ্রমে। এখানে পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল আমাদের। সেখানে সাধুসন্তদের "ভান্ডারা" প্রদান করা হবে। সেই মত কয়েকঘন্টার অনুষ্ঠান সমাধা করে অনেকেই লাঞ্চ সেরে নিলেন আশ্রমেই। আশ্রমের পাশেই গঙ্গার ধারা যা ভাগীরথী হিসেবে পরিচিত, বয়ে চলেছে। এর পর আবার প্রায় ৮ কিলোমিটার গাড়ি চলার পর পৌঁছলাম আমাদের আজকের আস্থানা হোটেল গঙ্গাআশ্রয়। এখানে রুমপ্রতি ভাড়া ১২০০। হোটেলটি একদম নদীর ধারেই। এখানে নদী নিচু দিয়েই প্রবাহিত। ১০-২০ ফুট নামলেই জলধারা স্পর্শ করা যায়। রুমের পাশে লনে দাঁড়ালেই দেখা যায় এঁকে বেঁকে নদী এসেই আবার পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গেলো। কয়েকধরনের মাছরাঙার সঙ্গে দেখা হল।
একটু বিশ্রাম নিয়েই চলে গেলাম পাশেই মানুষসৃষ্ট ঝর্না খেঁদি ফলস দেখতে। এটা একটি উপ-জলধারা, যা ভাগীরথীতে এসে মিশেছে, তাকে ব্যাবহার করে সম্ভবত জলবিদ্যুত তৈরি হচ্ছে। জলপ্রপাতের পাশে রামধনু তৈরি হয়েছে। শেষ বিকেলে এখানে পৌছনোর মজাই আলাদা। ফিরে এসে নামলাম নদীর বুকে। জল ভালো ঠাণ্ডা। একে তো বরফগলা, তায় এখানে তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ঠাণ্ডার দাপট। ভোরের দিকে শূন্যের নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। আমাদের স্বপ্নের যাত্রা চালু রয়েছে। পরের দিনে আমার স্বপ্নের গন্তব্য হরসিল। তাড়াতাড়ি রাতের আহার শেষ করেই সারাদিনের ক্লান্তি দূরে করতে বিশ্রামের আশ্রয় নিলাম। তবে তার আগে একপ্রস্থ গানের লড়াই খেলে নিতে অসুবিধা হল না। এই স্বর্গীয় ভুমিতে মন আনন্দে গুন গুন করে উথবেই "এ কাহা আ গায়ে হাম, তেরে সাথ ...।"    

গাড়োয়ালের আলিগলি

উত্তরকাশি গঙ্গাআশ্রয় হোটেল নিঃসন্দেহে ভালো। শহর থেকে একটু দূরে, কিন্তু নিরিবিলি। তবে খাবারের দাম নিয়ে দড়াদড়ি আবশ্যক। নাহলে বেশী দামে কম খাবার। এছাড়া একটা সংখ্যা বা অঙ্কগত সমস্যা এদের দেখতে পাচ্ছি। হিসেবে ভুল করা, সর্বমোট রুটির সংখ্যা নির্ণয়ে ভুল, এবং খাবারের বিল কম বেশী করে ফেলা, এখন অবধি সরকারি বেসরকারি সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। তাই নজর রাখতে হচ্ছে। 

বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা পাখির আগমন সকাল সকাল। ঠাণ্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের সকাল সকাল উঠতেই হবে। সেই মত ৬ টা নাগাদ আবার গাড়ি চলতে শুরু করে দিলো। আজকে যাবো রাজ কাপুরের স্বপ্নের হরসিল। উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফিট। ঠাণ্ডাও জম্পেশ লাগবে। সকালেই ১০ এর নীচে থাকার সম্ভাবনা। এখানে আমাদের থাকার জায়গা গাড়োয়াল মণ্ডলের লজে। গাড়ি চলতে থাকলে আমাদের পাশে পাশে ভাগীরথীও চলতে থাকে। আগের দিন যাওয়া খেঁদি ফলসের একটু আগে উত্তরাখন্ড পুলিশ প্রত্যাক গাড়ির তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। গতকাল একবার তথ্য দেবার পরেও আজকে আবার দিতে হল। কিছুটা সময় নষ্ট। আবার খেঁদি ফলস পেরিয়ে মানেরি বাঁধ পেরিয়ে চলেতে লাগলাম। মানেরি বাঁধের সৌন্দর্য অপরিসীম। তেহরির মত না হলেও খুব সুন্দর। সাধারনের প্রবেশ নিষেধ। তবে আমাদের গ্রুপ ক্যপ্টেনের "ম্যনেজ স্কিলে" ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছিল। ছবি তোলার নয়। মাঝে ভাটয়ারি বলে একটা জায়গায় গাড়ির চাকা ঠিক করানো হল। তেল আগেই নেওয়া হয়েছিল। এর পরে আর গাড়ির সারাইয়ের জন্য বা তেল ভরার আর কোন দোকান পাওয়া যাবে না। 
এই রাস্থার সর্বত্র পর্বত যেন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেখ্যা করে আছে। তাই যেখানে দাঁড়ানো সেখানেই ছবি তোলা আর গাড়ির গতি থাম্মিয়ে বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য আরোহণ আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের দুটি গাড়ি। আমাদের বড় গাড়ি এমনি ধীর তায় আমাদের অত্যাচারে গতি তোলার ক্ষমতা নেই। পেছনের ছোট গাড়ি দেরি করে বেরিয়েও আমাদের সঙ্গেই পৌঁছে যেতে থাকল। তাই মাত্র ৬৭ কিলোমিটার হরসিল পৌছতেও কম করে ৪ ঘন্টা লেগে গেলো। 
ভাগীরথী একটু ডান দিকে মোচর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে এই ভাবে একটা সুন্দর উপত্যকা বানিয়ে ফেলবে হরসিলে গাড়ি থেকে নেমেও কল্পনা করতে পারি নি। কারন সেনা বাহিনীর ক্যাম্প পেরিয়ে, ছোট নদীর ওপর দিয়ে এগিয়ে হরসিল গ্রামে প্রবেশ করার পর্যন্ত চারিদিকে বরফপড়া পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিলো ঠিকই কিন্তু ভাগীরথী দেখতে আমাদের হরসিল গাড়োয়াল মন্ডলের লজ অবধি যেতেই হত। মালপত্র বয়ে নিয়ে আসার জন্য কুলির ব্যাবস্থা করেই ঘরের দাবী পেশ করার মত বাজে কাজ গুলি আমাকেই করতে হল। কারন আমার নামেই অনলাইনে বুকিং ছিল। সেই কাজ ঝটাপট মিটিয়ে, আমাদের ঘরে মালপত্র প্রবেশ করিয়ে আমি ছুটলাম লজের লনে। সেখানে চমক। ঘরে বসে সব পাওয়া যাবে না। সামনের দিকের ঘর গুলি বা ওপরের ঘরগুলি থেকে কিছু দৃশ্য পাওয়া গেলেও বেশীরভাগ ঘরেই দৃশ্য নেই। তবে লনে জায়গায় জায়গায় কাঁচ ঘেরা ঘর কম করে দুটি। বসে আড্ডা মারা ও সঙ্গে ভাগীরথী দর্শন। সাথী হিমালয়ের কিছু বরফাবৃত চুড়া, যাদের নাম নেই আর কিছু নামী চূড়া, যেমন বান্দরপুঞ্ছ(আগে দেখেছি), শিভলিং, সুনদর্শন। একটু যেন কম কম বরফ। গলে গেছে হবে। কিন্তু প্রকৃতি দেবী একটু বেলা বারতেই মেঘ নিয়ে এসে সেই খামতি মিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা দূর থেকে সেই হোয়াইট ওয়াশ দেখতে লাগলাম। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ভাগীরথী এঁকে বেঁকে, লজের সীমা চুম্বন করে, দূরের পাহাড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। নদীর উচ্চ গতি। ফলে স্রোত ভয়ানক বেশী কিন্তু জল কম। নদীর ধারে অসংখ নুরি পাথর আর পাখির সমাহার। লালঝুটি থেকে সাধারণ বুন পায়রা, উপস্থিত সবাই। কারন? নদীর ধারে ভেসে আসা আপেলের সারি। এবছর আপেলের চাষ ভালো হয়েছে। এখানে আপেলের চাষ হয়। লজের নিজস্ব গাছে আপেল পেরে খেতে আপত্তি নেই, কিন্তু গ্রামের মানুষের ফল পারা যাবে না। আপেলের দাম ২০ টাকা প্রতি কেজি। কল্পনা করা যায় আমাদের শহরে? 
হরসিল বলিউড খ্যাত। গল্প শুনেছি রাজ কাপুর সাহেব হরসিলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বানিয়েছিলেন রাম তেরি গঙ্গা মেইলির মত সিনেমা। যার বেশীরভাগ এখানেই শুটিং। মন্দাকিনীর নামে একটা ঝর্নার নাম ও আছে, কিন্তু খুঁজে পেতে একটু কষ্ট। তিনি কেন মুগ্ধ হয়েছিলেন তা এসেই বুঝতে পারছি। চারিদিকে বরফ সাদা পাহাড়ের মাঝে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া ভাগীরথীর গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আপেলের গাছের সাড়ি নিয়ে অবস্থান করা এক অপূর্ব উপত্যকা এই এত্ত উঁচুতে।
  গল্প আছে, এক ইংরেজ সাহেব সিপাহী বিদ্রোহের সময় সমতল থেকে পালিয়ে তেহরি মহারাজের আশ্রয় চান। মহারাজ আশ্রয় না দিলে তিনি এই হরসিলের গ্রামে লুকিয়ে থাকেন। বিয়ে করেন এক স্থানীয় ভদ্রমহিলাকে। তারপর তাদের আপেলের চাষের উপায় বাতলে ও গাছের গুঁড়ির ব্যাবসা করে ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে যান রাজা। পত্তন করেন এই জনপদের। লোক মুখে এই কথাই ঘোরে। এখানে বেশীরভাগ মানুষ গাড়োয়ালী হলেও কিছু নেপালি মানুষ আছেন। বেশীরভাগ কুলিরা তাই হন। 
মালপত্র ঘরে ঢুকিয়ে ক্যমেরা নিয়ে নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। নামা যেত। তবে অপরিস্কার থাকায় ও আমার ব্যালেন্স খুব ভালো না হওয়ায় নামিনি। তবে চোখ ভরে দেখে নিয়েছি প্রকৃতি। বেলা বারতেই হু হু করে হাওয়ার দাপট। মেঘে ভরে গেলো আকাশ। মাঝারী বৃষ্টি শুরু হল। আশা জাগল যদি বরফ পড়ে। এই বৃষ্টিতে ভেজা উচিত নয়। এখানে প্রকৃতি এখন এরকমই। সকালে পরিষ্কার, বেলা বাড়তে থাকলে মেঘ এসে হাজির হবে। তার পর বৃষ্টি হয়ে আবার রাতের দিকে পরিষ্কার। আজকে একটু বেশীসময় বৃষ্টি হল। যেন আশেপাশের সবুজ পাহাড় স্নান করে আরও সুন্দর হল। ফাঁকা থাকায় হাওয়ার দাপট খুব বেশী ছিল। ফলে ঘরবন্দি। সন্ধের আগে ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকল। আর চোখের সামনে দেখতে পেলাম সামনের উচ্চ শৃঙ্গগুলি আরও সাদা। অনেক নীচে পর্যন্ত বরফ পড়েছে। তবে আমাদের কপালে জুটল না। তবে মাউন্ট সুদর্শনের দিকটা অন্ধকার না হওয়া অবধি পরিষ্কার হল না। চাঁদ উঠেছে। তবে মাথার ওপরে। লজের আলোয় আলাদা করে খুব বেশী না হলেও সামান্য সামান্য দেখা যেতে লাগলো। কলকাতার সংস্থা ওয়েদার আল্টিমা আসার আগে আমাকে বলে দিয়েছিল যে এই সময় পশ্চিমী ঝঞ্জার কারনে হরসিল গঙ্গোত্রীর মত উঁচু অংশে বৃষ্টি থাকবে, বরফ পড়তে পারে। তাই আশায় বুক বাঁধলেও শেষ মেশ হতাশ হলাম। রাতের ঠান্ডা ভয়ংকর। শূন্যের কয়েক ডিগ্রী নীচে। বাঁচোয়া যে রুমের হিটার চালু করা গেছিল ও বিদ্যুতের সমস্যা হয় নি। না হলে কি হত পরের দিনের গল্পে পড়ুন। রাতে আজকের মেনু ছিল মটন। আর একটি খবর যা শুনে এসেছিলাম, মিলল না। শুনেছিলাম এই রাস্থায় কোথাও আমিষ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হরিদ্বার ছাড়া প্রায় সর্বত্র কম করে ডিম পেয়েছি। দেখা যাক সামনে কি পাওয়া যায়। চিকেন তো পাওয়া যাচ্ছেই। এখানের রান্নার স্বাদ খুব ভালো। তবে সেই লোক কম থাকার সমস্যা আছেই। ফলে ঘর পরিষ্কার থেকে খাওয়া সবেতেই দেরি হচ্ছে। 
আমার হরসিলে দু রাত থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনায় এক রাত। ঠাণ্ডায় কষ্ট করে একরাত কাটিয়ে দেওয়া যায় শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখানে প্রকৃতি যেন একটু বেশী সুন্দর সেজেছে। বৃষ্টি না হলে হয়তো গ্রাম ঘুরে দেখতাম। তবে পরের দিন সকালে উঠে বেড়িয়ে পরার তাড়ার মধ্যেও সকালের পরিষ্কার আকাশে আরও কয়েকবার উপত্যকার সৌন্দর্য আহরন করে নিতে ভুলি নি। আবার কবে আসব কে জানে আমার এই স্বপ্নপুরিতে।   

গাড়োয়ালের আলিগলি

গাড়োয়ালের আলিগলি যেন এক স্বপ্নের শুরু শেষ আর এক স্বপ্নের উৎপত্তি। আমরা তুষারপাত পেলাম না। এই গল্প লেখার সময় হরসিলে ভালো তুষারপাত হয়েছে বলে শুনতে পেলাম। বিধি বাম। তবে তুষারপাত হলে পরিষ্কার সকাল উপভোগ করা যেত না। আজকেও সকাল ৭ টা নাগাদ বেড়িয়ে পরলাম গঙ্গোত্রীর দিকে। বেশী রাস্থা নয়, ঘণ্টা খানেক। কিন্তু আমরা থেমে থেমে যাবো বলে একটু তাড়াতাড়ি বেরচ্ছি প্রত্যেকদিন। আর থামবো নাই বা কেন? এক এক মোর ঘুরতেই বরফ সাদা পাহাড় চূড়া এসে আমাদের দৃষ্টি স্বার্থক করে দিচ্ছে। আজকেও ব্যাতিক্রম নয়। একটু এগোতেই মাউন্ট শিবলিঙ্গ, সুদর্শন এনারা দেখা দিতে লাগলেন। যেন ডেকে নিয়ে যেতে চান। কালকে রাতে ঠাণ্ডার ধাক্কা এখনো সহযাত্রীরা সামলাতে পারেন নি। তাই গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলার লোক আজকে ২-৩ জন। বাকিরা গরম গাড়ির ভেতরেই। কাল রাতের উষ্ণতা শূন্যের বেশখানিক নিচেই ছিল। বেরনোর সময় জমে থাকা জল জেলি বা সাদা সাদা হয়ে যেতে দেখেছি। যাকে গ্রাউন্ড ফ্রস্টিং বলে। আজকে সকালেও সেই ঠান্ডা কমার কোন লক্ষন নেই। উলটে আজকে রাতে আরও বেশী ঠাণ্ডা পড়বে। তবে কি বরফ পাবো? 
 অচিরেই আমরা গঙ্গোত্রী মন্দিরের থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের গেটে এসে পৌছলাম। এখানেই গাড়ি থেমে যাবে। আর এগোনর অনুমতি দেবে না উত্তারাখন্ড পুলিশ। আবার কুলি নিয়ে মালপত্র নিয়ে যেতে হবে। খরচ পড়বে ১১০ টাকা প্রতিবার প্রতিকুলি। এখানেও আমাদের গাড়োয়াল মন্ডলের গেস্টহাউস নেওয়া আছে। পাঠক এখানে মনে রাখবেন দুটি   গাড়োয়াল মন্ডলের ব্যাবস্থাপনায় থাকার জায়গা আছে। একটি একদম গঙ্গোত্রী মায়ের মন্দিরের লাগোয়া ছোট, অন্যটি বড় ও ৫০০ মিটার দূরে, নদীর অন্যপ্রান্তে। আমাদের বড় প্রধান  গেস্টহাউস বুকিং ছিল। খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। তবে একটু দূরে এই যা। নদীর ওপরে তৈরি ব্রিজ পেরতে হবে এবং একটু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তবেই  গেস্টহাউস পৌঁছন সম্ভব। বয়স্কদের অসুবিধা হওয়ার কথা। তবে সারা হরসিলে মোবাইলে বি এস এন এল ছাড়া কারো সংযোগ ছিল না। গঙ্গোত্রী পৌছতে আমার এয়ারটেল কাজ করতে শুরু করলো। আমাদের দুটি পরিবারের জন্য একটি রুম ব্যাবস্থা হয়েছে। তাকে এফএএম বা ফ্যামিলিরুম নাম দিয়েছে। ভাড়া ১৬০০ মত। অন্যদের প্রত্যেক পরিবারের ডিলাক্স রুম। ডিলাক্স রুমে প্রাতরাশ বিনা পয়সায়। রুম থেকে কোন পর্বত দেখতে পাওয়া যায় না, কিন্তু সামনের লনে এলেই কেদার ও সুদর্শন হাজির রুপের ডালি নিয়ে।  গেস্টহাউসটি এত সুন্দর জায়গায় যে ডান দিকে এগোলেই কয়েক পা গেলেই সূর্য কুন্ড নামের ঝর্না। যেখানে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা ভাগীরথী নীচে নেমে আসছে। আর এক প্রান্তে সীতাকুণ্ড। সেটিও তাই। 
পুরাণ অনুসারে সগর রাজার ৬০০০০ সন্তান কপিলমুনির অভিশাপে ভস্ম হয়ে গেলে তাদের পুত্র ভগিরথ, তপস্যা বলে মা গঙ্গাকে মর্তে আগমন ঘটান। সেই পুণ্য গঙ্গার স্রোতে ৬০০০০ সন্তানের ভস্ম ধুয়ে যাওয়ায় তাদের মুক্তিলাভ ঘটে। এই গঙ্গোত্রীতেই মা গঙ্গার মর্তে আগমন। এখানে ভাগীরথী নামে পরিচিত ভগিরথের নাম অনুসারে। প্রয়াগে আলকানন্দার সঙ্গে মিশে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হন। কিন্তু তেজী মা গঙ্গার স্রোত ধারা মহাদেবের জটায় ধারন ছাড়া মর্তের বিনাশ আটকানো সম্ভব ছিল না। তাই মনে করা হয় এই সূর্যকুন্ডে মহাদেব গঙ্গামা কে জটায় ধারন করেন। পবিত্রভুমি গঙ্গোত্রী তাই ছোটা চারধাম। বিজ্ঞান বলছে অনেক আগে গঙ্গোত্রী হিমবাহ গঙ্গোত্রী পর্যন্ত ছিল। ধীরে ধীরে গোমুখ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। এখন আরও পিছিয়ে গেছে। যার নাম গোমুখ -২। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ, গোমুখ -২ ট্রেক করে যাওয়া যায় বা ঘোড়ায় চড়ে। হেঁটে গেলে ৩ দিন মত লাগবে -১ পর্যন্ত। এছাড়া ভাগীরথী, কেদারতাল, প্রভৃতি অনেক রকমের অভিযান এখান থেকেই যেতে হয়। এর পরে আর গাড়ি যায় না।   
রুমে মালপত্র রেখে কুলিভাড়া মিটিয়ে আমরা এগলাম গঙ্গামায়ের মন্দির দর্শনে। সূর্যকুন্ডে রামধনু দেখা যায়। কিন্তু আজকে অদৃশ্য। সূর্যকুন্ড থেকে মাউন্ট সুদর্শন দেখে ছবি তুলে আমরা এগলাম মন্দিরের দিকে। এক কিলোমিটারের কম রাস্থা পেরিয়ে, ভাগীরথী নদীর একটি ধারা পেরিয়ে প্রধান ধারার ওপরের ব্রিজে পৌছনোর আগে ভাগীরথী শিলা। মনে করা হয় এখানেই ভগিরথ শিবের তপস্যা করেছিলেন। তারপর ব্রিজ পেরিয়ে মন্দির। মন্দিরে প্রধান বিগ্রহ গঙ্গামাইয়া। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে এখানে পূজা দেন। আমিও ব্যতিক্রম নই। জল মাথায় দিলাম। ভালো ঠাণ্ডা, কিন্তু কেমন যেন সহ্য হয়ে গেলো। ওখানে ছোট ছোট ১০০ মিলির বোতল বিক্রি হয়। ১০ টাকায় কিনে জল ভরে নিলাম। বড় বোতল ছিল। কিন্তু লাগেজের ভয়ে নিলাম না। পুজর প্রসাদ খই ও নকুলদানা। ভক্তিভরে খেয়ে নিলাম। ইতিহাস মতে মন্দির তৈরি করেন নেপালি জেনারেল অমর সিং থাপা। নদীর এঁকে বেঁকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এক পাশে মন্দির। মন্দির উঠানে দাঁড়ালে উল্টোদিকে মাউন্ট সুদর্শন উপস্থিত সঙ্গে কেদার। যেন পাহারা দিচ্ছেন। অপরুপ দৃশ্য। একটু থেকে বেড়িয়ে এলাম। এবার ফেরার পালা। এক পথে ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম বনবিভাগের রেস্টহাউস এখানেই আছে। একটু আগে। ফিরে এসেও থেমে গেলাম না। দুপুরের খাবারের একটু দেরি আছে। তাই বেড়িয়ে পরলাম দেড় কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া পান্দব গুহা দেখতে। প্রথম দিকে ভালো চড়াই উৎরাই থাকলেও শেষের দিকে প্রায় সমতল রাস্থা দিয়ে দেড়কিমি থেকে একটু বেশী রাস্থা হেঁটে যেতে ভালই লাগে। জঙ্গলের ভেতরে গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাখির ডাক শুনে এগিয়ে চলা। নীচে দিয়ে বয়ে চলা ভাগীরথীর গর্জন। শেষের দিকে বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু পৌছে গেলাম। একটা বড় পাথরের ভেতরে ছোট গুহায় কয়েকজন সাধুর বসবাস। রান্নার ধোঁয়ায় এমনি ভেতর বড্ড কষ্টকর। রাস্থার সৌন্দর্যের সঙ্গে এখানের তুলনা চলে না। তাই একটু হতোদ্যম হয়েই ফিরে চললাম। সর্বত্র ফেরার সময় কম লাগে। এবারেও তাই। তার মধ্যে গেস্ট হাউসে থেকে যাওয়া সহযাত্রীদের ফোন, আরও গতি বাড়াতে সাহায্য করলো। দুপুরের গরম গরম নিরামিষ খাবার ডাকছে। ২০ মিনিটে ফিরে এলাম। এসেই খিদে পেটে গোগ্রাসে গিলে তো নিলাম। কিন্তু খাবার পর থেকেই ঠাণ্ডা লাগতে লাগলো বেমাক্কা। হাঁটাচলার জন্য যে গা গরম হয়েছিল তা কিছুক্ষনেই ঠাণ্ডা হয়ে শরীরের হারগুলি ঠোকাঠুকি করতে লাগলো। যেন সহ্য ক্ষমতা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত। সূর্য ডুবতেই উষ্ণতা একদম নিশ্চিত শূন্যের নীচে। ওদের অফিসরুমের বাইরে লাগানো থার্মোমিটার জানা দিচ্ছে -২ ডিগ্রী এখনি। রুমহিটারে
খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেলো না। নিয়েও লাভ হত না। সারাদিন বিদ্যুতের দেখা নেই। সন্ধের পর থেকেই জেনারেটরে ১১টা অবধি আলো জ্বালিয়ে রাখলেও তারপরে অন্ধকার। তার মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়েপরা ছাড়া আর কোন কাজ করার উপায় নেই। সেই সঙ্গে কনকনে হাওয়া। বরফের পাহাড়গুলো খুব কাছে হওয়ায় ঠান্ডা মাত্রারিক্ত। রাতের উষ্ণতা -১০ এর কাচকাছি ছিল। কারন পরের দিন সকাল সকাল ছবি তুলেই পালিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। ৬ টা নাগাদ সব তোরজোড় করে বেড়িয়ে আসার সময় উষ্ণতা দেখা গেলো -২। ফলে তারাহুর করে বেড়িয়ে পরলাম। আজকে যাবো বারসু। প্রসঙ্গত বলে রাখি গঙ্গোত্রীর উচ্চতা ১০ হাজার ফুটের একটু বেশী। সাধারণত শ্বাস নিতে অসুবিধা না হলেও, উত্তেজনা, ক্রোধ ইত্যাদি করলে শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই পারে। দরকারে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হবে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে চকলেট বা গা গরম রাখার খাবার খাওয়া প্রয়োজন। তবে নিরামিষ একমাত্র ভরসা হওয়ায় মাংস অমিল। ওতেই মানিয়ে নিতে হবে।
 চলবে

বারসু।

--------------------------
ইচ্ছাছিল বা বলাযায় প্রায় নিশ্চিত ছিলাম বরফ পড়বে, অথবা বরফ পড়ে থাকবে, কিন্তু বিধি বাম। গঙ্গোত্রীতেও তুষারপাত দেখা হল না। তবে সুগতদা চিন্তিত ছিলেন যে বরফ পড়লে ঠাণ্ডায় আমাদের আরও কষ্ট হবে। সঙ্গে প্রাকৃতিক যে দৃশ্য আমরা দুচোখ ভরে গিলছি, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল অন্তত এই অভিজ্ঞতা হয়ে যাক। ব্যাজার মুখে গাড়িতে চলতে লাগলাম। প্রায় এক রাস্থায় নেমে আসতে হবে ভাটয়ারি পেরিয়ে গংনানি অবধি। গংনানির একটু আগে ডান দিকে রাস্থা উঠে যাবে। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার মত গেলেই বারসু গ্রাম। বারসু গ্রাম হল দায়রা বা দরিয়া বুগিয়ালের বেস ক্যাম্প। এখানে সবাই ট্রেক করতেই আসে। কিন্তু আমাদের দলে সেই লোক হাতে গোনা ৪-৫। তাই ট্রেক নয়, আমরা সৌন্দর্য দেখতেই এসেছি।
   গংনানির পর বারসুর রাস্থা ওপরে উঠতেই চোখের সামনে হই হই করে চলে এলো একের পর এক সাদা শৃঙ্গ। কেউ কেউ নাম করা যেমন কেদার, কেউ অনামি। সদ্য কাল রাতে বরফ পড়ে সাদা হয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থাৎ সেই আমাদের গাড়ির গতি রুদ্ধ হয়ে গেলো। আজকে মোট যাওয়ার ছিল ৪০ কিমি মত। তার শেষ ১০ কিমি আমাদের ছবি তোলার ধুমে যেতে লেগে গেলো প্রায় ১ ঘন্টা। লাগবেই না কেন। এক এক বাঁকে এক এক শুভ্র হিমশীতল চূড়া আমাদের অভ্যর্থনা করছে যে। না নেমে উপায় কি? আমাদের গাড়ি হিমাচল থেকে আনানো হয়েছিল। স্থানীয় নন। তবে তার কোন অসুবিধাতো হইয়নি, বরং আমাদের খুব পরিচিত যোগরাজ ভাই যেখানে যেমন খুশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে সাহায্য করেছেন। স্থানীয় চালক কেপির থেকে অনেক ভালো। হয়তো দ্রষ্টব্য স্থান আমাদের খুঁজে নিতে হয়েছে, কিন্তু কোনওসময় তাড়াহুরো করেননি। ফলে ক্যামেরা ভরে ভরে ছবি এসেছে বাড়িতে।
  আমরা পৌঁছলাম গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউসে। এই প্রথম গাড়ি একদম রেস্ট হাউসের সামনে আমাদের পৌঁছে দিতে পারলো। অন্যগুলির মত এরও ঘর থেকে কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য সেভাবে নেই। তবে ঘর পরিষ্কার যতই পুরনো হোক। রান্নাও ভালো। বিপদ হতে পারত। অন্যসব রেস্ট হাউসগুলির মত এখানে আমাদের আগমনের অগ্রিম খবর সরকার এনাদের পাঠায় নি। ফলে আমাদের আগে কোন ট্রেকারদল এসে গেলে আমাদের ঘর তাদের হয়ে যেত। এখানে প্রধান আবাসের মোট ৭ টি ঘর ও সুন্দর তাঁবু সদৃশ দুটি ঘর নেওয়া হয়েছে। তাঁবুগুলি থেকে সরাসরি দূরে বরফ চূড়া দেখা যায়।
  আসার পথে ভাটয়ারির আগে প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিলাম। ভারি খাবার খেয়েছিলাম। আমাদের একটা উদেশ্য ছিলই। যেখানে যা খাবার পাওয়া যাবে, পেট ভরে খেয়ে নাও, আর যেখানে প্রথম তুষারশৃঙ্গ দেখা যাবে, ছবি তুলে চোখ ভরে দেখে নাও। দুখেত্রেই পরে আর নাও পেতে পারো। আজকে সেই মন্ত্র কাজে দিলো। এদের খাবার পরিবেশনে একটু দেড়ি হল। তৈরি ছিল না যে ১৯ জনের দল এখানে আসবে। তবে মানুষজন খুব ভালো। যথাসাধ্য সাহায্য করা এদের ধর্ম। সুন্দর প্রকৃতির মানুষ সুন্দর।
 আসে পাশে জঙ্গল আছে। একটু দূরে উঁচুতে ভোলানাথের মন্দির। দলের কয়েকজন সেখানে ঘুরেও এলেন। আমরা দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় দেখতে লাগলাম আর রোদ গায়ে লাগাতে লাগলাম। এখানে ঠাণ্ডা দশের (যেদিন কলকাতায় শীতলতম দিন হয়, সেদিন দশের আশেপাশে থাকে তাপমাত্রা) আশেপাশে থাকলেও গঙ্গোত্রী হরসিলের পরে এখানে সেভাবে লাগছিল না। ফলে লেপের তলায় ঢুকতে সবার আপত্তি। বিকেলে চায়ের আসরে শুনলাম এখানে অনেক ছায়াছবির শুটিং হয়েছে। তবে বেশীরভাগ নেপালি ছবি। শুটিং শেষ হলে জায়গাটা নেপাল দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে ছবিতে। ক্যন্টিনের ইনচার্জ আমাদের গল্প শোনালেন এসব। এখন অবধি যেখানে যেখানে গেছি, আমার মনে হয় সর্বত্র শুটিং করাই যায়। কেন এখনো হলিউড এখানে পদার্পণ করেনি সেটাই বিস্ময়।
  বিকেলে আকাশ মেঘাছন্ন হয়ে পরেছে। ঠান্ডাও শূন্যের নীচে নেমে যেতে লাগলো রাত বাড়তেই। তবেকি বরফ পরবে? এর মধ্যে শুনতে পেলাম সব থেকে দুঃখের খবর। আমাদের দলের এক সদস্যের পরিচিত কয়েকজন আজকে গঙ্গোত্রী গেছেন। গেছেন ঠিক, কিন্তু থাকতে পারেন নি। কারন? তুষারপাত। আমরা বেরনোর কয়েকঘন্টা পরেই শুরু হয়েছে তুষারপাত। সেনাবাহিনী সব গাড়ি কম করে দশ কিমি নীচে নামিয়ে দিয়েছেন। হায় কপাল। কয়েকঘন্টার তফাতে আমি জীবনের প্রথম তুষারপাত মিস করলাম। ভাগ্যে ছিল না, বা অন্যভাবে ভাগ্য ভালো ছিল। কারন বরফে রাস্থা আটকে পড়লে আমাদের নামা মুশকিল হয়ে যেত, থাকা মুশকিল হত। এর পর দুঃখীমন নিয়েই রাতের নিদ্রা। ব্যাবস্থা ভালই। এখানে তিনটে বেড ছিল। ফলে আমাদের শুতে অসুবিধা হয় নি। অতিরিক্ত টাকা দিতেও হয় নি।
 সকালে মন ভালো হয়ে গেলো। কালকের বরফ ঢাকা এবং নেড়া সব পাহাড়গুলি রাতে অনেক অনেক বরফ পড়ে একদম সাদা। যেন আইসক্রিম। খুশির শেষ নেই। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে তুলতে বুঝতে পারলাম এদের দূরত্ব খুব বেশী নয়। এমনকি বরফ শেষ যেখানে পড়েছে তার থেকে এই বাড়ির দূরত্ব সামান্যই। অর্থাৎ সেই হরসিলের মত আবার কাছে এসেও এলো না। আমরা বেড়িয়ে পরলাম সকাল সকাল। আজকে উত্তরকাশি হয়ে বারকোট যাবো। উত্তরকাশিতে সময় লাগবে, এবং রাস্থাও অনেক। তাই ৭ টায় বেড়িয়ে পরা ছাড়া উপায় নেই। তখন সবে পাহাড়ের মাথায় ধীরে ধীরে সূর্যের আলো এসে পৌঁছেছে। অপূর্ব বরফ ঢাকা পাহাড়গুলি যেন ঝলসে উঠছে। ঘোড়ায় চড়ে দিনের কাজে বেড়িয়ে পরেছেন গ্রামবাসীরা। কালকে রাতে পরিচিত হওয়া এক বাঙ্গালি ভদ্রলোক তার গাইড নিয়ে দরিয়া বুগিয়াল চলে গেলেন। আমরা গংনানি হয়ে উত্তরকাশি নেমে আসতে লাগলাম।   

উত্তরকাশিতে আবার

-------------
এক রাস্থায় ফিরতে হবে বলে , কাশিতে বিশ্বনাথ মন্দির ফেরার পথে রাখব ঠিক ছিল। সেই মত ৯টা নাগাদ এখানে পৌঁছে মন্দির দর্শনে গেলাম। মন্দিরে শিব ও শক্তি। আগে শক্তির পূজা করে চলে গেলাম শিবের মন্দিরে, পাশাপাশি। বলা হয় গঙ্গার ধারা যেখানে উত্তরবাহিনী, অর্থাৎ সাধারণ নদীর তুলনায় একটু অন্যমুখি, সেই সব পীঠস্থান কাশি নামে পরিচিত। যেমন বরানসী, উত্তরকাশি, গুপ্তকাশি প্রভৃতি। এখানে হিন্দু ধর্মের জ্ঞ্যান লাভের চর্চা হয়। প্রচুর সন্যাসি এখানে থাকেন ও বেদের জ্ঞ্যানলাভ করেন ও প্রদান করেন। এখানে ভাগীরথী তেজী কিন্তু জলের ধারা এখন শরু। মন্দিরে আমাদের পূজা ভালমতই সম্পন্ন হল। মনে শান্তি এলো। শিবের দর্শন না পাওয়া পর্যন্ত আমার মন খুতখুত করছিল। এখানে এসে যেন প্রায় সম্পূর্ণ। এরপর বাকি শুধু যমুনেত্রী। এখানে প্রাতরাশ সেরে শহর ঘুরে দেখতে লাগলাম। সবরকম আধুনিক সুবিধা প্রায় সমমুল্যে এখানে পাওয়া যাচ্ছে দেখতে পেলাম। এরপরে আর পাওয়া যাবে না আগেই লিখেছিলাম। গাড়ি সারাই হয়ে চলে এলো। আমরা উঠে বসলাম, ধারাসু বেন্ড যাবো, সেখান থেকে নতুন রাস্থায় বারকোট।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

-------------------------------
উত্তরকাশি থেকে বেড়িয়ে একটু দ্রুত এগোতে লাগলাম। কিন্তু ধরাসু বেন্ডে এসে আবার দাঁড়িয়ে পরতে হল। সামনে গাড়ির সাড়ি জানান দিলো ধস নেমেছে। খুব বড়সড় নয়। ঘন্টা খানেকের অপেখ্যা। আবার গাড়ি ধরাসু বেন্ড পেরিয়ে এবার নতুন রাস্থা নিল। ফেলে আসা তেহরির দিকে না গিয়ে ডান দিকে ঘুরে আবার চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গাড়ি চলতে লাগলো। এখানে সাধারণ পার্বত্য পথ। সেভাবে কিছু দেখার নেই। একজায়গায় মন্দিরে শিবের উপাসনা হয়, গুম্ফা আছে। ব্যাস আর কিছু নেই। বিরক্তির ঘন্টা ২ চলার পর আমরা পেয়ে গেলাম বারকোট বেন্ড। প্রধান বারকোট শহর আমাদের সামনে আসবে যখন আমরা মুসৌরির দিকে যাবো। কিন্তু আমরা ডান দিকে ঘুরে যমুনেত্রীর দিকে যাবো। তাই ফেরার পথে প্রধান শহর পাবো।
এই বেন্ডে আমাদের আজকের ঠিকানা হোটেল আদিত্য প্যালেস । প্যালেস শুনে চমকে যাওয়ার নেই। ভাড়া মাত্র ৭০০। রুম বা সমগ্র হোটেল কখনোই মনে হয় নি অন্তত প্যালেস। হটাত উঠে দাঁড়ানো শুরুতেই শেষ, দোতলা আবাস। তবে ঘর খুব সুন্দর ওপরেরগুলি। নিচেরগুলি একটু ছোট। তাই কথা বলে ভাড়া কমিয়ে ৫০০ করা হল। এখানে এক রাত থেকে দূর থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা পরের দিন ভোরে উঠে জানকীচট্টী যান। সেখান থেকে ট্রেক করে যমুনেত্রী মন্দিরে পূজা দিয়ে আবার রাতের আগেই বারকোট ফিরে আসেন। জানকীচট্টীর হিমশীতল পরিবেশ থেকে এর ফলে বাঁচা যায়। আমাদের উদ্দেশ্য তাই। ৫-৬ ঘন্টার পথ পেরিয়ে বিশ্রাম নেওয়াই উদ্দেশ্য। একটু দূরে নদীর পারে তাঁবু করে থাকাই যেত। কিন্তু পকেট অনুমতি দেয় নি। সেখান থেকে যমুনেত্রী হিমবাহের পাহাড়ের দেখা মেলে।
এই বারকোটেই আমাদের আধার কার্ড দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হল। তবে দুপুরের খাওয়ার পরে। ছবিও তুলে রেখে দিলো। একটি পাস জাতিয় কাগজ প্রত্যেককে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। যদিও কোথাও কাজে লাগে নি। তবে দেখানোর দরকার পরলে বা বিপদে কাজে লাগবে। এখানে ঠাণ্ডা অনেক কম। উচ্চতাও অনেক কমে গেছে। কাল প্রায় ৩০০০ ফুট আবার উঠবো গাড়িতে। তবে দুপুরের বৃষ্টি আমাদের পিছু ছাড়েননি। বৃষ্টি হয়ে একটু ঠাণ্ডা বাড়িয়ে দিলো। না হলে আমি গায়ে গরম জামা ছাড়াই ঘুরছিলাম।
 পরের দিন ভোরে উঠে পরলাম। ৫ টায় বেড়িয়ে পরলাম। কারন অনেকেই যমুনেত্রী মন্দিরে যাবেন। কেউ কেউ ঘোড়ায়, কেউ হয়তো হেঁটে। একটু এগিয়ে দুটো বাঁক নিতেই চমক। যমুনেত্রী হিমবাহের সঙ্গে আরও নাম না জানা দু একজন হাজির রুপের ডালি নিয়ে। এ যেন শেষ না হওয়া রুপকথা। ঘন্টা ৩ গাড়িতে থাকার পর আবার ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে গেলাম হনুমানচট্টী। এখানেও অনেকে থাকেন। এখান থেকেও হেঁটে যান। গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউস এখানেও দেখলাম। কিন্তু আমরা শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাবো। একটু চা খেয়ে পুলিশের তল্লাশি পেরিয়ে আমরা এসে গেলাম জানকীচট্টী। এটা যমুনেত্রীর বেস ক্যাম্প। এখানেও আমাদের গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউসে বুকিং। কিন্ত এই প্রথম ঘর নিয়ে ধাক্কা খেলাম। ম্যনেজার নেই। একজন কেয়ারটেকার। একটু বয়স্ক। আমাদের ৯টা রুম দেখাতে দেখাতে হাঁপিয়ে উঠলেন। তায় আমাদের দুটো ঘর পছন্দ না হওয়ায় ইকো থেকে ডিলাক্স রুমে পরিবর্তন করে নিলাম। বাকি ঘর গুলি আশ্বাস ছিল ১২ টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তবে প্রত্যেক রুম দুইজনের হলেও অতিরিক্ত একটি খাট আছে। আমাদের সমস্যা হল না। এই প্রথম আমাদের ঘর থেকেই দেখা দিলেন যমুনেত্রী হিমবাহ, একধারে কুলকুল করে বয়ে চলেছে যমুনা নদী। অনুভুতি স্বর্গীয় কিন্তু ঘর বড্ড নোংরা। খাবার ব্যাবস্থা ভালই। যাদের যাবার তারা চটপট আলুর পরঠা খেয়ে ঘোড়ার দাম দস্তুর করে বেড়িয়ে পরল। সংখ্যায় ৭। ঘোড়া প্রতি যাওয়া আসা নিয়ে ১০০০ টাকা। ডুলি চেপে যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল আমার স্ত্রীর। কিন্তু তারা ৮০০০ চেয়ে বসায় আমার বৌ রনে ভঙ্গ দেয়। মনটা খারাপ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। আমরা আরও জনা ছয়েক টিফিন করে বেড়িয়ে পরলাম জানকীচট্টী ঘুরে দেখতে। মন্দিরের রাস্থা ৫ কিমি হলেও প্রথমেই খাঁড়াই। তাই ওদিকে না গিয়ে রেস্ট হাউসের খাবারের দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোকের কথা মত বেরলাম সরস্বতী শিব মন্দির দেখতে। সাধারণ পথ একটু বেশী বলে আমরা চড়াইয়ের রাস্থা ধরে উঠে গেলাম। একটু কষ্ট হলেও সৌন্দর্য কিছুই কম নয়। প্রায় ২ কিমি হেঁটে মন্দিরে পৌঁছলাম। এই মন্দিরে যমুনামাতা কার্ত্তিক পূর্ণিমার পরেই নেমে আসেন যমুনেত্রী টপ থেকে। ঠান্ডার কারনে।  যমুনেত্রী টপের মন্দির তখন বন্ধ থাকে। মন্দিরে একটি উষ্ণপ্রস্রবণ আছে। সেখানে প্রসাদ ফেলে ফুটিয়ে নেওয়া হয়। বোতলে করে জল নিয়ে আসা হয়। আর মন্দিরে পূজা দেওয়া হয়। যারা গেলেন তারা এই আচার পালন করলেন, আর আমরা মায়ের শীতকালীন আবাসে সরস্বতী মায়ের ও শিবের পূজা দিলাম। ঠাণ্ডা যমুনার জলে ছেটা আর গুরুগম্ভির মন্ত্রোচ্চারণে পরিবেশ মধুর করে ফিরে গেলাম প্রধান রাস্থায়। এখান থেকে দেখা গেলো মন্দিরের ঠিক মাথায় যমুনেত্রী হিমবাহ। আর পাশে বয়ে চলেছে যমুনানদী। হু হু করে বয়ে চলা হাওয়া, সেরকম ঠাণ্ডা পরিবেশ।
 আমরা চললাম গাড়োয়ালী গ্রাম দেখতে এরপর। গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্থা পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে পৌঁছলাম শনি-নাগ দেবতা মন্দিরে। মুল মন্দিরটি চারশ বছরের পুরনো। পাথর ও কাঠ দিয়ে তৈরি। সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ভেতরে আলো খুব কম। মন্দিরের নীচে স্থানীয় রামলীলার আয়োজন হচ্ছে। একটু দুরেই নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। ভেতরে ঢোকার জায়গা দেখলাম না। বাইরে থেকে প্রণাম সারলাম। শুনলাম শনি দেবতা এখন বদ্রি মহারাজের ওখানে গেছেন। নাগদেবতা আছেন। মন্দিরের পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে তুষারশুভ্র পর্বতের উপস্থিতির বিরাম নেই। দেখা শেষে ফিরতে লাগলাম। এখন অপেখ্যাকৃত সহজ লাগলো উৎরাই বলে। নীচে একটা ঝুলন্ত সেতু আছে। সেটা পেরিয়ে যমুনা পেরতে হয়। দেখলাম এখানেই যমুনার দূষণ শুরু। ক্লান্ত পদযুগলকে টেনে নিয়ে রেস্টহাউসে ফিরে দেখি এখনো ঘর বসবাস যোগ্য হতে দেড়ি আছে। অগত্যা সামনের উঠানে বসেই হিমবাহ দর্শন। এত কাছ থেকে হিমবাহ অনেকেই দেখেন নি। এখন একটু ঠাণ্ডা কম তাই পাহাড়ের গায়ে বরফ গলে যাচ্ছে। যারা ওপরে গেছিলেন তারাও ধীরে ধীরে ঘোড়ায় ফিরলেন। তবে ততক্ষণে আমাদের দুপুরের খাবার হয়ে গেছে। তাড়া ফিরে এসে জানালো ওপর থেকে ঝর্না দেখা যায়, কিন্তু পর্বতমালা আর নতুন কিছু দেখা যায় না। অনেকে মন্দির থেকে হিমবাহ অভিযান করেন। কিন্তু সেই দলে আমাদের কেউ ছিল না।
সব ঘর পরিষ্কার হতে হতে বিকেল হয়ে গেলো। বিকেলে সবার যে যার ঘরে ব্যাগ রেখে একটি ঘরে মেয়েরা ও একটি ঘরে ছেলেরা গল্প, তাস সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিতে থাকল। আমি একবার ওই ঠান্ডায় বাইরে এসেছিলাম। চাঁদের আলোয় অপার সৌন্দর্যের রুপ আমার সামনে বিকশিত হয়েছিল হিমবাহের। যমুনার কুলকুল শব্দ এখন যেন গর্জন। শুনলাম এখানে কয়েকমাস আগে মেঘফাটা বৃষ্টি ও সঙ্গে হড়কা বানের কবলে পড়ে এই রেস্ট হাউস বরাত জোরে বেঁচে যায়। হারিয়ে যায় সামনের একটি হোটেল। আজকেও উষ্ণতা শূন্যের নীচে। তাই বেশী দেরী না করে শুয়ে পরাই মঙ্গল। কাল ফিরব মুসৌরি। অনেক পথ।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

------------------------------
সকালের প্রথম আলোয় ঝলমলে যমুনেত্রী হিমাবাহ চোখ ধাঁধানো রুপ নিয়ে সামনে হাজির। কাল রাতে পাহাড়ের চুড়ায় বরফ পড়েছে। আরও সুন্দর আরও মসৃণ। কিন্তু আমরা একটু জলদি বেড়িয়ে পরছি প্রত্যেকদিন। আজকেও ব্যাতিক্রম নয়। আজকে আমাদের দুই সহযাত্রী দেবেশ-মনিকা আমাদের ছেড়ে পারি দিচ্ছেন কেদারনাথের পথে। তাদের বারকোট নামিয়ে দিয়ে যাবো। সেখানে বাসে করে উত্তরকাশি ফিরতে হবে তাদের। উত্তরকাশি থেকে শ্রীনগর হয়ে গুপ্তকাশির পথে চলে যাবেন। আমরা এগিয়ে যাবো মুশৌরির পথে। সেই মত আবার ঘন্টা দুই চলারপর বারকোট বেন্ডে পৌঁছে ধরাসুর দিকের রাস্থায় না গিয়ে দেহরাদুনের দিকে গাড়ি চলতে লাগলো। এসে পৌঁছলাম বারকোট শহরে। বারকোট বেন্ড থেকে ৮ কিমি দূরে। এখানে খাবারদাবারের ভালই ব্যাবস্থা আছে। কিন্তু অপরিচ্ছনতা ও অস্বাভাবিক দাম যেন সর্বত্র। এর মধ্যে খবর এলো চরম অব্যাবস্থা সম্পন্ন জানকীচাট্টী গাড়োয়াল মণ্ডলের রেস্ট হাউসে, স্নানকরার সময় পড়ে গিয়ে রুদ্রাণী(দত্ত) মামির হাতের হাড় সম্ভবত চিড় ধরেছে। তাঁরা অন্য গাড়িতে আমাদের পেছনে আসছেন। আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে এক্সরের দোকান পেয়ে গেলাম ঠিক, কিন্তু খুলতে দেরী। তবে মুশৌরিতে হোটেলে ফোন করে সেখানে এক্সরে করার ব্যাবস্থা করা হল। আমরা প্রাতরাশ সেরে নিলাম। দেবশদাদের বাসে তুলে দেওয়া হল। আমাদের দুটি গাড়ি একত্রিত হয়ে এগিয়ে গেলাম  মুশৌরির পথে। আবার ঘন্টা ৪ এর বিরক্তিকর গাড়ি যাত্রা। ঘণ্টা তিনেকের কিছু সময় পর আমাদের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতরাশি উন্মুক্ত হল। গাড়োয়াল রেঞ্জের প্রায় সবকটি পর্বত এখান থেকে দেখা যায়। তবে আজকে একটু বেলা হয়ে যাওয়াতে মেঘে ঢাকা। ফলে আমাদের একটু দমেই থাকতে হল। এরপর এলো কেম্পটি ফলস। এখানে আজকে নামলাম না। এগিয়ে চললাম শহরের দিকে। আরও প্রায় ৪৫ মিনিট গাড়ি চলার পর ম্যাল রোডের সামনে এসে গেলাম। কিন্তু আমাদের হোটেল দ্বীপ ক্যামেল ব্যাক রোডে। সেটি ম্যালের শেষ প্রান্তে। তাই পাশের গাড়ি চলার রাস্থা দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে একদম পেছনের দিকে নিয়ে দাড় করানো হল। এখান থেকে বাকি প্রায় ৭০০ মিটার হেঁটেই যেতে হবে। প্রায় সমতল রাস্থায় হেঁটে যাওয়া সমস্যার নয়। কিন্তু সঙ্গের মালপত্র কুলি ছাড়া নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কুলি ভাড়া ১১০ টাকা, গাড়িতে উঠিয়ে দিলে আর একটু বেশী। আমাদের ১৩ জনের মালপত্র একদম কম নয়। পাঁচজন কুলির দরকার পরল।
হোটেল দ্বীপ ভালই লাগলো। আমাদের ঘর ছিল ৪ তলায়। তবে লিফট আছে। সামনে খোলা বারান্দা। সেখান থেকে কেদার পর্বত দেখা যায়। তবে আজ বিকেল হয়ে যাওয়ায় আমাদের ভাগ্যে কিছু নেই মেঘের জন্য।
দুপুরের খাবার খেতে বিকেল হয়ে গেলো। পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, বারান্দায় বসে হাল্কা শীতের আমেজে আমাদের খাবার শেষ হল। আজকে সন্দীপ মামারা বেড়িয়ে যাবেন কলকাতার উদ্দ্যেশে, দিল্লী হয়ে, মামির হাত কালকে সকালে দিল্লীতে দেখিয়ে বিমানে চেপে বসবেন। সন্ধের আগেই মামারা বেড়িয়ে পরলেন দেহরাদুনের উদ্দেশ্যে। আমাদের মহিলাকুল ও তাদের স্বামীরা গেলেন বাজার করতে। এই ভ্রমণের শেষ দিন কাল। তাই যার যা বেঁচে আছে পকেটে সেটা খরচ জরুরী। আমি ভাগ্যক্রমে সঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেলাম। রেহাই পেলেন গ্রুপের নেতা সুগত বসুও। কিন্তু দুজনে মিলে পরশু ফেরার পরিবর্তিত স্থান নিয়ে চালক সাহেবের সাথে কথা বলে নিলাম। একটু বেশী (২০০০ মত) দিতে হবে, কারন আমরা হরিদ্বার নামবো বলে এসেছিলাম, কিন্তু টিকিট কুম্ভ এক্সপ্রেসে না পাওয়ায় সাহারানপুর হয়ে যাওয়া পাঞ্জাব থেকে আসা গুরুমুখী এক্সপ্রেস আমাদের গতি। ফলে পরশু আমরা উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর যাবো। ফলে রোড ট্যাক্স অতিরিক্ত লাগবেই।
পরের দিন সকাল হতেই ঝলমলে কেদার শৃঙ্গ আমাদের সামনে, হোটেল দ্বীপের ছাদের থেকে দৃশ্যমান। তবে সব পাহাড়ি শহরের মত মুশৌরিও দূষণে আক্রান্ত। ফলে একটা কুয়াশা-ধোঁয়াশা ভাব রয়েছে।একদিকে ঘড়িঘর, সেইদিকেই সূর্য উঠলো। সকালের খাবার বাইরেই খাবো। তাই সূর্যদয়ের একটু পরেই বেরলাম। আজকে মুশৌরি ঘুরে দেখবো। শেষে ম্যাল হয়ে কেনাকাটা করে বাড়ির জন্য প্রস্থুত হবো। এক স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে। মুশৌরি শহর সম্পর্কে বলি, ইংরেজ জেনারেল ফেড্রিক ইয়ং এর শখ হয়েছিল শুটিং গেম খেলতে, তিনি এখানে এসে মুশৌরি ও ল্যন্ডর নামে দুটি হাওড়া - কলকাতার মত জমজ শহর মত্তন করেন এই প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায়। এখানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানেই থেকে যান। প্রথম গোর্খা বাহিনী তৈরি করেন ও আলুর চাষ করেন। আমরা যে ক্যমেল ব্যাক রোডে আছি সেখানেই উনি একটি শুটিং স্পট তৈরি করেন। সাহেবি শখ। পরে এখানে ক্যন্টন্মেন্ট তৈরি হয়। ঘড়িঘর তৈরি হয়। মানে ইতিহাসের পুরো এক প্যকেজ। আমাদের পরের দিনের যাত্রা শুরু ঘড়িঘর দিয়ে। শরু রাস্থায় একটু এগিয়েই কাছেই ঘড়িঘর দেখে মনটা ঐতিহাসিক করে যখন কেম্পটি ফলস এর দিকে এগলাম তার মাঝে দেখে নিলাম সর্বচ্চ পয়েন্ট লাল টিব্বা। এখান থেকে হিমালয়ের দৃশ্য বড়ই মধুর। তবে হাল্কা কুয়াশা আছেই।ক্যামেল ব্যাক রোড এখান থেকে দেখতে অনেকটা উঠের পিঠের মতই। তাই এই নাম।
কেম্পটি পৌছতে ৪৫ মিনিট লাগলো। সেখানে খানিক নামার পর কেবল কারে চেপে ঝর্নার পতন স্থানে নামা ও ওঠা সম্ভব। ফলে ওঠা নামার হ্যাপা এড়ানো যায়। শুধু উঠতে ১০০, ওঠা নামা ১৫০। আমরা ওঠা নামা কেটে চেপে বসলাম। মিনিট খানেকের যাত্রায় একদম নীচে নিয়ে আসে। তবে মুল স্নান করার জায়গা আর একটু ওপরে। আবার উঠতে হয়। সেখানে স্নান করার ব্যাবস্থা আছে। আছে ব্রিজে দাড়িয়ে ছবি তোলার উপায়। এছাড়া যেখানে কেবল কার থেকে নামলাম, সেখানে চা খাওয়া সম্ভব, সম্ভব গাড়োয়ালি পোশাকে সজ্জিত হয়ে ছবিতোলা। আমরা ঘন্টা খানেক সব করলাম। তারপর উঠে এসে একটি হোটেল দেখে দুপুরের খাবার সারলাম। বিশ্রামের সময় নেই, গাড়ি ফিরে এসে নামিয়ে দিলো ম্যালরোডের মুখে। এখান থেকে হেঁটে বা রিক্সায় হোটেল ফিরতে হবে। আমরা পদব্রজে কেনাকাটা করতে করতে এগিয়ে চললাম। দাম এমনকিছু কম নয়। বরং বেশী। খানিক বিশ্রামে কফিশপে কফি পান। আবার হন্টন। এবার পৌঁছলাম "গান হিল" যাবার কেবেল কারের নীচে। কয়েকজন ওপরে উঠলো এতে চেপে। কিন্তু আমরা বিরত থাকলাম।  "গান হিল"থেকে সমগ্র  মুশৌরি এবং দেহরাদুন শহর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিকেলের দিকে কুয়াশার দাপট বেশী থাকায় দেখা সম্ভব নয় দেখেই আর অতিরিক্ত খরচ করি নি। এরপর হেঁটে হোটেল ফিরে আসা আর রাত কাটিয়ে পরের দিন ট্রেন ধরার প্রস্তুতি।
এখানেই কাহিনী শেষ হতে পারত। কারন পরের দিন ৬ টায় বেড়িয়ে আমরা ১১ঃ৩০ এর ট্রেন ধরতে ছোটায় দেহরাদুন শহর ঘোরার বা সহস্রধারা জলপ্রপাত দেখার সময় পাই নি। কিন্তু দেহরাদুন শহর পেরতেই, সাহারানপুরের রাস্থা ধরতেই আবার সমতল ছেড়ে উঁচুতে উঠলাম ও নামলাম। মাঝে পেরিয়ে এলাম একটা জাতীয় উদ্যান। যার নাম রাজাজী জাতীয় উদ্যান। এটি সম্পূর্ণ ধারনার বাইরে ছিল। ভেবেছিলাম একটা জঙ্গল পেরতে হবে। সেটা যে রাজাজী জাতীয় উদ্যান তা বোর্ড দেখে জানতে পারলাম ও উৎসাহিত হলাম। তবে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্থা হলেও সেভাবে কিছু নজরে আসে নি হনুমানের দল ছাড়া। জঙ্গলের গন্ধ নিয়েই সমতলে নামতে হল। সমতলের রাস্থাও বেশ খানিকটা খুব বাজে।  সাহারানপুরের একটু আগে থেকে রাস্থা ভালো হয়েছে। যাই হোক গুরুমুখী এক্সপ্রেস সঠিক সময় এসেছিল। তাতে চেপে ৩ ঘণ্টা দেরিতে কলকাতা স্টেশন পৌঁছে আমাদের যাত্রা শেষ হয়। এক স্বপ্ন যা এখনো মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে। সারা জীবনের সম্পদ হিসেবে।

আমাদের যাত্রাপথ আর একবারঃ কল্কাতা-দিল্লী-হরিদ্বার-ধনৌল্

টি-টিহরি-উত্তরকাশি-হরসিল-গঙ্গোত্রী-বারসু-উত্তরকাশি-ধরাসু বেন্ড-বারকোট বেন্ড-যমুনেত্রী-বারকোট শহর-মুশৌরি-দেহরাদুন-সাহারানপুর-কলকাতা।