Amazon

Binsar লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Binsar লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ৫ মে, ২০১৭

কুমায়ুনের খাতা

পর্ব-১
প্রায় ৮ মাস আগে যখন বাবন - লিপির হানিমুনের সঙ্গে নিজেকে জুড়েছিলাম তখন বুঝিনি, আমাদের থাকা কত জরুরি ছিল। ধীরে ধীরে সব লিখবো। মুন্সিয়ারি যেতে না পারার আক্ষেপ করেছিলেন রশনি মুখার্জি। চলুন বলে ডাক দিয়েই ফেললাম। সংশয় ছিলই। একদম চিনিনা, পছন্দ-অপছন্দ, বায়না, মানিয়ে চলার ক্ষমতা, কোনটাই একদম জানি না। "দেখা যাবে যা হবে" ভেবে শুরু হল আয়োজন। সুকুর থেকে প্ল্যান নিয়ে নিজে খানিকটা পরিবর্তন করে সাজিয়ে ফেললাম সব কিছু। ব্যাবস্থা মত, কিছুটা আমি কিছুটা অর্নবদা মিলে রাজধানী শতাব্দী লাল কুয়া গাড়ি গুলর টিকিট কেটে নিলাম। তার পর দিন গোনা শুরু।
দেখতে দেখতে এসে গেলো ৪র্থ এপ্রিল। বিকেলে চেপে গেলাম রাজধানী। শতাব্দি অনেক উঠলেও রাজধানী প্রথম। মনে একটা আনন্দ শুরু হয়ে গেলো। সঙ্গে থাকুন, ধীরে ধীরে এগতে থাকব।


পর্ব-২
রাজধানী চলতে শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও। রিতিমত ঝর তুলে এগিয়ে চলেছে। ভেতরে অনেক কষ্টে লিপি বাবুন কে আমাদের কাছে আনতে পারলাম। এক সরদারজি ও এক বিহারী বাবু সিট পরিবর্তন করায় আমরা একসঙ্গে হতে পারলাম। একটু পরেই জামাই আদর শুরু। খাবার - জল - চা সবই জুটল। দুর্গাপুর-আসান্সল-ধানবাদ-গয়া-মুঘল সরাই-কানপুর হয়ে একদম সঠিক সময় আমরা ঢুকে পরলাম দিল্লি। সকাল সকাল। এদিকে গরমের ভয়। শুনলাম উষ্ণতা ৪০ ছুঁয়েছে। নেমেই কুলি ধরে মালপত্র নিয়ে ছুটে "গিঙ্গের"। স্টেশন থেকে দু পা। ঘেমে গেলাম। কিন্তু হোটেল ভারি সুন্দর। খাবার ব্যাবস্থা আছে। ঘর পাওয়া মাত্র বিশ্রাম নিলাম ছোট করে। বাতানকুল যন্ত্র ঘরটিকে হিমেল করে রেখেছে। এই হোটেলে টেবিল-ফিটেড হিটার আছে। যেখানে জল গরম করে চা - কফি খাওয়া যায়। আমি এক কাপ চা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে তৈরি হতে থাকলাম দিল্লি ঘুরব। এক কাপ করে চা ও কফি বিনা পয়সায় প্রত্তেকের জন্য।
একটু সূর্যদেব শান্ত হতেই বেরিয়ে পরলাম. অর্নবদা অসুস্থ হওয়ায় আমরা ৭ জন বেরলাম। ধারনা ছিল দিল্লিতে সব কিছু দামি। দুপুরে খাবার ও বেশ দামি ছিল। যদিও সবকিছু কলকাতা ভাবলে ভুল হবে। যাইহোক, একটা অটো ও একটা ৪ জন বসার গাড়ি মোট ১০০০ টাকায় ঠিক করে ফেললাম। ঘুরে দেখাবে লালকেল্লা, হুমায়ুনের কবর, পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতি ভবন, ইন্ডিয়া গেট, জন্তরমন্তর। সস্থা মনে হল। বেরিয়ে পরলাম লালকেল্লা। মিনিট ১৫ -২০, চোখের সামনে অভূতপূর্ব মুঘল স্থাপত্ত। সাহজাহান তার রাজধানী সাহজাহানাবাদকে সুরক্ষিত করতে লাল পাথরে মোরা এই দুর্গ ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এটি তৈরি করেন। এখন ভারতের গৌরব হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। লাহোরি গেট থেকে ৩৫ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে এক ইতিহাসের পাতা পড়ে ফেললাম। ভেতরে আছে বিভিন্ন মহল। কোনটি সম্রাটের রাজ্যসভা তো কোনটি প্রমদ ভবন। পাথরে পাথরে ইতিহাস। শেষ মুঘল সম্রাটদের এখানেই কোতল করে ইংরেজরা। ঢুকে দেখলাম, প্রচুর ইংরেজ-রাশিয়ান-তুরকি এমন কি বাংলাদেশী সবাই হাজির।
গলায় ক্যামেরা ঝুলতে দেখে দুই রাশিয়ান ললনা তাদের ক্যামেরায় তাদের ছবি তুলে দিতে অনুরধ করে। এই টুকু অথিতি সেবা করা আমার ধর্ম। করেও দিলাম।
লালকেল্লা দেখার পর, এগিয়ে গেলাম হুমায়ুনের কবরের দিকে। মাঝে গাড়ি থেকেই দেখলাম রাজঘাট। কিন্তু বন্ধ ছিল। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন পত্নি হামিদা বানু, তার পতির স্মৃতিতে এই অদ্ভুত ও সুন্দর শিল্পকর্ম নির্মাণ করেন। অনেকটা তাজমহলের মত হলেও শ্বেতপাথরের নয়। ঘুরে দেখলাম। ঢিমেতালে বৃষ্টি শুরু। আবার উঠে পরলাম গাড়িতে।
ঘুরতে ঘুরতে পউছেগেলাম ইন্ডিয়া গেট। মুশলধারে বৃষ্টি। তাই গাড়িথেকেই গেট দর্শন। লিপি বাবুন ভিজে ভিজেই চলে গেলো দেখতে। বাকিরা আইসক্রিম খেতে লাগল। তবে শহর পরিষ্কার নয়। এমন কি কলকাতা আমার মনে হল এর থেকে পরিষ্কার।
ফেরার পথে বৃষ্টির মধ্যেই রাষ্ট্রপতি ভবন ও নর্থ সাউথ ব্লক দেখে নিলাম। ভারি সুন্দর লাগল। বলে রাখি। বিকেলে ধীরে ধীরে পরিবেষ ঠাণ্ডা। বৃষ্টির জন্য হতে পারে। তবে ২-৩ দিন লাগবে দিল্লি দেখতে। আবার আসবো।
ফিরে এলাম হোটেল। গাড়ি সস্থা হলে কি হবে, খাবারের বিল ছেঁকা দিল। গোলাপজামুন ১২০ টাকায় ২ টো। কি আর করা। গরমে বাইরে খেতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিল মিটিয়ে শুয়ে পরলাম। তবে আমরা যাব আর আড্ডা হবে না? বেশ খানিখন আড্ডা দিলাম। দেখলাম অর্নবদা আমাদের মতই মানুষ। জমবে ভালই। রোশনিদি আমুদে। বাবুন লিপি দুই মিষ্টি বাচ্চা।
এক ঝটকায় রাত কাবার। ক্লান্ত শরীর হলে যা হয় আর কি। এদিকে ভোরে হোটেল ছেড়ে দিলাম। পরিবেষ ঠাণ্ডা। কিন্তু কুলি পাওয়া গেল না। অগত্যা নিজেদের বইতে হল। আজকে আমরা শতাব্দী ধরে যাব কাঠগুদাম। এখান থেকেই শুরু হবে পাহার চরা। সঙ্গে থাকুন। এবার ধীরে ধীরে বাড়বে ঠাণ্ডা।






পর্ব-৩
বিরক্তিকর অপেক্ষা। শতাব্দী কিছুতেই প্লাটফর্ম পায় না। মাত্র ২০ মিনিট আগে এলেন। ঝপাঝপ মালপত্র তুলে নিলাম। শতাব্দীতে একটি বড় সমস্যা মালপত্র ঠিকঠাক রাখা। প্রায়শ দেখেছি যাত্রীদের মধ্যে ঝামেলা হতে। কিন্তু এযাত্রায় আমাদের এক গাড়ি মালপত্র উঠে পরল ঝামেলা ছাড়াই। প্রসঙ্গত বলি, রোশনিদি বাড়িতে তৈরি দারুন সুস্বাদু কাপ কেক রাজধানীতে খাইয়েছে। খবর পেলাম তার দু একটি বেঁচে আছে। মাথায় একটু প্ল্যান চলছিলো, কি করে হাতান যায়। কিন্তু শুনলাম ওটা সুফি ও আমার মেয়ের জন্য। নিরস্ত্র হলাম। শতাব্দী খুঁড়িয়ে চলতে লাগল। এই প্রথম দেখলাম এত কম দূরত্বে কোন শতাব্দী এত সময় নিচ্ছে। এত হোঁচট খেয়েও তিনি প্রতি স্টেশনে সঠিক সময় পৌঁছে যাচ্ছেন।
কিন্তু রামপুর স্টেশন ঠিক আমাদের পোষায় নি। যাত্রা শুরু ও শেষে এই স্টেশনে আমাদের ভাল যায় নি। এই স্টেশনে পৌঁছতে শুনলাম শুভাদীপ বমি করছে। অসুস্থ। বমি করলে যা হয়। প্রায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে। শতাব্দীর খাবার হজম হয় নি। এমনিতে শুভাদীপ হল সাত বোন চম্পক। তার একজন সেখানে উপস্থিত। তাই বোঝা যাচ্ছে হুরহুরি কি পর্যায় হবে। তবে আমাদের চন্দন বদ্দির ওষুধ জফার এম ডি ৪ এই সব ক্ষেত্রে অব্যর্থ। কৌষিকী ওষুধ দিতে সামান্য সুস্থ হল। আজকে সিতালাখেত যাব। এই অঞ্চল একটু দুর্গম। রানিখেত থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তাই আগে থেকে ফোন করে আমাকে বলে দিতে হল রাতে ও বিকেলে কি খাব।
ট্রেন থামতেই মালপত্র নিতে ঠেলাগাড়ি হাজির। হাজির আমাদের সারথি চন্দন আরজ। যাকে আমি গতকাল থেকে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে মাত্র একবার সফল হয়েছি।
ভিপিন উপেরেত্তি, জিনি কুমায়ুন ট্রিপ বলে সংস্থার কর্ণধার। তিনিই আমাদের কাঠগুদাম থেকে সব ব্যাবস্থা করেছেন শুধু সিতলাখেত ছাড়া। তার সংস্থার চালক চন্দনজী হাজির স্টেশনে। জানি না আমাদের এত মালপত্র দেখে কিনা, উনি প্রথম আমাকেই জিগ্যাসা করেন যে আমিই ওনার গেস্ট কিনা। তাই খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় নি একটুও। "কুমায়ুন ট্রিপ" আমাদের জন্য ইনভা গাড়ির ব্যাবস্থা করেছে। যদিও আমি ত্রাভেরা চেয়েছিলাম ইনভা দামি বলে। এটা একপ্রকার কমপ্লিমেন্ট। ঝকঝকে নতুন গাড়ির মাথায় শুধু নয়, পেছনের ছোট ডিকিও ভরে গেলো আমাদের ব্যাগে। বেশ গরম লাগছে। একটু পড়ে ঠাণ্ডা হবে।
রোশনিদির ভরে আনা এক পেনড্রাইভ গান চালু হতেই পাহাড় চরা শুরু। প্রাতরাশ শতাব্দীতে হলেও দুপুরের খাবার ঠিক হল কাঞ্ছি মঠের পাশে দোকানে হবে। মন ভরানো গান শুনতে শুনতে প্রথম দাঁড়ালাম ভিমতালের পাশে। এখানে সামান্য অপেক্ষা। কারন শেষে আবার আসব এখানেই। এর পর কাঞ্ছিমঠ। এখানে দুপুরের খাবার ঠিক হল। নিরামিশ। মোটেই ভালো খাবার নয়। এছাড়া উপায় নেই। মঠ দর্শন করেই পেট পুজ। প্রাকৃতিক দৃশ্য বড়ই মধুর। পাহাড় ঘেরা এই মঠে মহারাজের সমাধি দেখে নিলাম। একটি ছোট সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। তলায় মৃতপ্রায় কোশী নদী বলেই শুনলাম। তার ধারেই খাবার দাবার আয়োজন।
শুভাদীপের শরীর খুব খারাপ । উপায় নেই। আমরা রানিখেত পৌঁছলাম। ওখানে মন্সকামন মা কালি মন্দির দেখে সোজা গলফ কোর্স। আকাশের মুখ ভার। কোন শৃঙ্গ নজরে আসছে না। মন খারাপ। গাড়ি ছুটল সিতালাখেত।
সিতালাখেত নামলাম সন্ধে হয় হয়। চারিদিকে জঙ্গল। মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। আগের দিন দিল্লিতে রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। আজকেও পাহাড়ে হবে। বনজঙ্গল যেন অপরূপ সাজে সেজে উঠল।
নিচের তলায় ডিলাক্স ঘর আমাদের জন্য থাকলেও আমরা ২০০ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে ওপরের সুপার ঘরে ঢুকে গেলাম। তিনটে ঘর। চার পাশে বৃষ্টির শব্দ। চূড়ান্ত নির্জন ও মহময়। গরম গরম কফি সহজগে ইংরেজ আমলে তৈরি সুবিশাল ঘর আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। গা ছমছমে পরিবেশে থাকব আজকের রাত।






পর্ব-৪
প্রসঙ্গত বলি, ধীরে ধীরে শুভদীপ সুস্থ হয়ে গেল, কিন্তু মনস্কামনা মন্দির থেকে লিপি দিদিমনি ফীলিং ওয়াক ওয়াক। অর্থাৎ রানিখেত থেকে সিতালাখেত, চন্দন বদ্দির ওষুধ শুভাদীপকে সুস্থ করলেও লিপির কাজ করে নি। পতির বেদনা পত্নী গ্রহন করলো আর কি। তাই হিমেল হাওয়া, গা ছমছমে পরিবেশ সঙ্গে চারদিক ঘেরা বনজঙ্গল, কোন কিছুই প্রাথমিক ভাবে লিপির কাছে ভালো লাগার কথা নয়। তবে ঘরে ঢুকে বিশ্রাম নেওয়া খানিকটা সুস্থ করে তুলল।
এই জঙ্গলে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কোন বন্য শব্দ কানে আসে নি। চিতা আছে, এক দুটি রয়াল বেঙ্গল ও আছে, ওপরে ট্রেক করে যাওয়া মন্দিরের আশে পাশে। বন মোরগ, শূয়র দু চারটি এদিক ওদিক চোখে পড়েছে। আর আছে সবুজ ও সবুজ। পর্বতের সারি এখান থেকে দেখতে পাওয়া যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু আজ মেঘে ঢাকা। রাতবাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডা বেড়ে চলেছে। মাঝে মাঝে মুশল ধারে বৃষ্টি। ব্রিটিশ স্তাপত্তে তৈরি এই বাড়িটি যেন কত রহস্যে মোরা।
রাতে মুরগির ঝোল সহজগে পেটপুজ শেষ হতেই বিছানা লাভ। গরম গরম কম্বল, সে যতই গা কুট কুতে হোক, আরাম দেবেই। এদিকে কোলকাতা ৪০ ডিগ্রিতে ফুটছে। গোল পাকলো রাত ৩ঃ৩০ নাগাদ। আমাদের ঘর গুলির সামনে একটা লম্বা গাড়ি বারান্দা মত বারান্দা আছে। ওখানে আমরা কিছুখন আড্ডা দিয়েছি, পকরা কফি খেয়েছি। বাসন পড়েআছে। সেখানে খুটুর খাটুর শব্দ। একটুপরে দরজায় আঁচড়ানোর শব্দ। আমি উঠে ভেতর থেকে হুস হাস শব্দ করলাম। কিন্তু থামল না। এই শব্দ আমি দুয়ারস এও শুনেছি। তখন জন্তু বলেই ধরেছিলাম। এখন একটু অন্যরকম লাগল। কৌষিকী উঠে পড়েছে। শুনেই বলে "আমি বাড়ি যাব"। ভয় যে একটু করবেই সেটাই স্বাভাবিক। যাই হোক শব্দ আরও কিছুক্ষণ হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো।
সকালে বিনা পয়সার প্রাতরাশ খেতে বসে সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করলো ওটা কুকুর ছিল। কিন্তু, কিছু ব্যাপার, যেমন কুকুর হলে হুস হাস শব্দে পালিয়ে কেন গেলো না বা অন্তত কিছুক্ষণ থেমে থাকত। খাবার বাসন অনেকক্ষণ ওখানে ছিল, তবে এত রাতেই বা কেন খেতে এলো। যাই হোক আমিও সেই সময় এসব বলে ওদের ভয় বাড়াতে চাই নি।
সকালে অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে, কিছু নতুন ধরনের পাখি দেখে ও জঙ্গল সাক্ষী রেখে বিদায় জানালাম সিতালাখেত কে। ভালো লেগেছে। আবার আসবো। কর্মচারিদের আতিথেয়তা মন ভরিয়ে দিল।
চললাম পরবর্তী গন্তব্য কৌশানি। বলা হয়, গাড়োয়াল ও কুমায়ুন হিমালয়ের সব কটি শৃঙ্গ এখানে দৃশ্যমান। কিন্তু আমাদের কপালে নেই। রাস্থায় ঘন মেঘ। ধীরে ধীরে মুশলধারে বৃষ্টি। আনাসক্তি আশ্রম প্রথম পৌঁছলাম। এই আশ্রমে গান্ধীজী থাকতেন। কৌশানি গান্ধীজীর খুব প্রিয় ছিল। উনি একে ভারতের সুইজারল্যান্ড বলেছেন। কিন্তু হায় তার আশ্রম থেকে আমরা শুধু মেঘ আর মেঘ, সঙ্গে মুশলধারে বৃষ্টি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এমন কি ভেতরে ঢোকাও হল না। নিস্ফল প্রচেষ্টা করলাম শৃঙ্গ দেখার। এখানে একটি উঁচু বেদি করা আছে। সেখানে উঠে সব শৃঙ্গ দেখা সম্ভব। বেদিতে দিকনির্দেশ দেওয়া আছে, দিকনির্দেশ দেখে শৃঙ্গ চেনা সম্ভব। আমরা শুধু মেঘ দেখলাম।
গাড়ি এবার সোজা হোটেল উত্তরাখন্ড। এই হোটেলে আজকে রাত থাকবো। ভাবছিলাম একদিন বেশি থাকা যায় নাকি। তবে আকাশ একদম মেঘে ঢাকা। তাই লাভ নেই। এই হোটেল পরিষ্কার হলেও সেই পুরনো আমলের। খাওয়া দাওয়া ভালো। একদিকে উন্মুক্ত। সেদিকেই শৃঙ্গরাজি হাজির থাকার কথা। এখন নেই। বরং এখন আমাদের জন্য গরম গরম কফি ও শিলাবৃষ্টি । মন্দ নয়। পাহাড়ে শিলা পরলে বরফ পড়তে পারে। কিন্তু আজকে পরবে না। ফেব্রুয়ারী বা মার্চ হলে আশা থাকত। এবছর অবশ্য এপ্রিলেও বরফ পড়েছে ১-২ তারিখ। আজ বিকেলের বাদে সব খাবার বিনামুল্যে। অর্থাৎ "কুমায়ুন ট্রিপ" সংস্থার প্যকেজে। তবে নির্ধারিত। সেই মত দুপুরের খাবার খেয়ে বারান্দায় আড্ডা চলল। এর মধ্যে হনুকুল হাজির। রোশনিদি ও কৌষিকী এক প্রস্থ দাঁত খিচানির স্বাদ পেয়েছেন। তবে কামরায় নি। করার কিছু সেভাবে নেই। আছে বসে বসে পাকদণ্ডি রাস্থা দেখা ও পাশের মন্দিরের ঘণ্টা শোনা। মাঝে মিটিয়ে দিতে হল বাকি টাকা।
বিকেলে বৃষ্টি থেমে গেলো। ধীরে ধীরে ত্রিশুল ও নান্দাদেবী পর্বতমালা স্পষ্ট হচ্ছে। সন্ধে থেকে জমিয়ে আড্ডা চালু পকরা ও ডিম ভুজিয়া সহযোগে। রাতে ঠাণ্ডা জমিয়ে পড়েছে। এটা অনেকটা শহর শহর। তাই বন্য পশুর আশা নেই। রুদ্রপ্রয়াগে ভুমিকম্পের খবর পেলাম। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু নেই।
সকালে একটু জলদি ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পাখির আনাগোনা ভালই। লাকি বার্ড বলে এক ধরনের ছোট পাখি দেখলাম। ছবি তোলা খুব মুশকিল। আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। তবে কুয়াশা আছে। ত্রিশুল, নান্দাদেবী, নান্দাকোট হাজির। ৩টে মাথাওলা ত্রিশুল, চ্যাপ্টা মত নান্দাদেবী এবার কামেরায় ও এসে গেল। মনে আনন্দ। তবে আজকে যেতে হবে অনেক পথ। প্রায় ৮ ঘণ্টা পেরিয়ে মুন্সিয়ারি। স্বপ্নের গন্তব্য।












পর্ব-৫
যেহেতু শেষ বেলায় ত্রিশুল ইত্যাদি শৃঙ্গ দর্শন হয়েছে, তাছাড়া চন্দনজী ও আসতে একটু দেড়ি করলেন, তাই কৌশানি থেকে যাত্রা শুরু করতে একটু দেড়ি হয়ে গেলো। প্রায় ১০ঃ২৫, গাড়ি ছাড়ল। গন্তব্য মুন্সিয়ারি। স্বপ্নের গন্তব্য। কিন্তু পথমধ্যে আমরা যাব বাগেশ্বর, বইজনাথ মন্দির, চাকউরি, থল, বিরথি জলপ্রপাত হয়ে। লম্বা ও কঠিন যাত্রা। অনেকটা উঁচুতে উঠব। চিন্তা সুফিকে নিয়েও। বাচ্চা মানুষ। কিন্তু এখন অবধি দারুন সুস্থ। একবার ও বমি করে নি। বমি করে বিখ্যাতরা এখন অবধি সুস্থ, যেমন কৌষিকী, আমার মেয়ে, সুফি। আর পাহাড় চরে চরে হি ম্যান হয়ে যাওয়া শুভদীপ, লিপি এর মধ্যেই খাতা খুলেছে, আমি ও অর্নবদা লজেন্স খেয়ে গা গোলানকে থামিয়ে রেখেছি। রোশনি দি ফিট। বড্ড বেশি পাকদণ্ডি। এই বামে তো এই ডানে। পশ্চিমবঙ্গীয় পর্বতের রাস্থার সঙ্গে চূড়ান্ত অমিল। হটাত হটাত নেমে আসছি অনেক নিচে, আবার উঠে যাচ্ছি। এই ঠাণ্ডা তো এই গরম। সঙ্গে গাছের অপ্রতুলতা। জানি না বসন্ত বলে কিনা, পাহাড় লাল হয়ে অপরুপ সুন্দর, কিন্তু সবুজের বড়ই অভাব। আজকে টের পেতে লাগলাম। মাঝে মধ্যে শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো। হু হু করে বয়ে চলেছে হাওয়া, তবুও নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো।
আজকে আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টির নাম নেই। সূর্য দেব প্রখর কিরন নিয়ে হাজির। প্রথম থামলাম বইজনাথ মন্দির। এটি বাগেশ্বর থেকে একটু আগে। মন্দিরটি একটু নেমে হেঁটে যেতে হয়। পাশে বয়ে চলেছে সরযূ নদী (স্থানীয় মত অনুসারে)। হেঁটে খানিকটা গিয়ে মন্দির দর্শন হল। মন্দিরটি অনেক পুরনো। অস্টম কি নবম শতাব্দীর। মন্দিরে শিল্প অনেকটা উড়িষ্যা বা দক্ষিণ ছোঁয়া। প্রধান বিগ্রহ শিব ও তার সর্পকুল। পাথরে তৈরি মন্দিরের সামনে একটি জলাশয় আছে। যেখানে কুমির আছে বলে মনে হল। ধীরে ধীরে মন্দির দর্শন সম্পন্ন করলাম।
খানিকটা এগিয়ে বাগেশ্বর সঙ্গমে হাজির হলাম, আবার খানিকটা নেমে নদীর ধারে গেলাম। এখানে সরযূ ও গোমোতি নদীর সঙ্গম। সুন্দর মন্দির ও মহাদেবের মূর্তি আছে। দেখে নিলাম। বড্ড গরম। লিপির শরীর খুব খারাপ। রাস্থার পাশেই বসে পরল। চোখে মুখে জল দিয়ে গাড়িতে এ সি চালিয়ে আবার যাত্রা শুরু। বাগেশ্বর একটি পাহাড় ঘেরা উপত্যকা। উচ্চতা ১০০০ মিটারের একটু বেশি। নিচু বলেই গরমে ভালই গরম পরে। গাড়ি একটু পাহাড় চরতেই একবার থেমে সকলে প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে নেমে গেল। একটি হোটেল আমাদের ব্যাবস্থা করে দিলেন নিখরচায়। আপ্লুত হলাম।
সারথি চন্দনজী, লিপির অসুস্থতার কারনে স্বল্প দীর্ঘের রাস্থা ধরলেন। চাউকরি ও থল ফেরার পথে। তবে এ রাস্থাও খুব একটা কম নয়। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের সাথে দেখা রামগঙ্গা নদীর। এঁকে বেঁকে আমাদের সাথে চলতে থাকলো। একটা বাঁক নিতেই দেখতে পেলাম বরফ ঢাকা পিণ্ডারি হিমবাহ। এর থেকেই উতপন্ন পিণ্ডারি ও রামগঙ্গা। দূরে ছাদের মত চ্যাপ্টা বরফ ঢাকা পিণ্ডারি হিমাবাহ। এখন একটু বরফ কম লাগলো।
রাস্থার পরিমান যত দীর্ঘ হচ্ছে, লিপির অসুস্থতা বেরে চলেছে। মাঝে একটি রাস্থার ধারের হোটেলে প্রায় ৪ টের সময় দুপুরের খাবার খেলাম। মাঝে কিছু চোখে পরে নি। খাবার একদম ভালো না। সবাই পেট ভরে খেতে পারে নি। প্রথম মন ভরে গেল বিরথি জলপ্রপাতের সামনে এসে। প্রবল বেগে জলধারা নিচে আছরে পড়ছে। একটি নদীর আকারে বয়ে চলেছে। নেমে মন ভরে দেখে নিলাম। ছবি তোলা শুরু হল। চা পান ও ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবিতোলা। পথের ক্লান্তি খানিকটা কমিয়ে দিল।
নেই নেই শেষ নেই, সন্ধে হতে দেড়িহয় এখানে। প্রায় ৭ টায় সন্ধে নামলো। আমাদের গাড়ি এখন চলেছে। মাঝে একটি ব্রিজ পেরতেই দেখা শিয়াল বাবাজির সঙ্গে, গাড়িতে কেউ চিতা তো কেউ নেকরে বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। আসলে দেখা গেলো শিয়াল। তবে আকৃতি বড়। ওই সামান্য মজা করেই পথের ক্লান্তি ভুলে থাকা। উচ্চতায় ওঠা।
একটা বাঁক সম্পূর্ণ করে চন্দনজী গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন। বললেন দেখিয়ে। আমাদের মুখ হাঁ হয়ে গেলো। চোখের সামনে ইয়া ইয়া বড় সাদা পর্বতমালা। সন্ধের আধোআলোয় ভয়ঙ্কর সুন্দর। আমি এসব খেত্রে দুম করে গাড়িথেকে নামি না। রোশনিদিরা নেমেছিল। নামতেই হাড় ফুটো করে দেওয়া হিমেল হাওয়ার সামনে। মুখ দিয়ে হু হু করে শব্দ বেরিয়ে এলো। বেচারা সুফি, নেমেই এত ঠাণ্ডা পেয়ে হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ির ভেতরে উষ্ণতা অনেক বেশি।
প্রথম পঞ্চচুল্লি দর্শন। পরিষ্কার আকাশ। অল্প চাঁদের আলো। মোহময়। সামনেই মিলাম ইন। আমাদের থাকার জায়গা।










পর্ব-৬
মিলম ইন হোটেলটা খুব ছিমছাম কিন্তু সুন্দর জায়গায়। ঘর থেকে পঞ্চচুল্লি সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। সঙ্গে সঙ্গে হংসলিঙ্গ ও চিতল কেদার পর্বতমালাও দেখা যায়। যেহেতু "কুমায়ুন ট্রিপ" এর নিজস্ব হোটেল, তাই খাতির একটু বেশি। তবে প্রধান কর্মী বসান্তজী তুলনাহীন সারভিস দেন। আপ্যায়ন করলেন কফি দিয়ে। ওপরের ঘর গুলির ৩টি আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। শুভাদীপদের ঘর বেছে নিয়ে আমরা গল্প করতে লাগলাম সেইদিন। এত ধকল কাটিয়ে আড্ডা দেবার ইচ্ছা দমিত হয় নি। গরম গরম পকরা সহযোগে ভুতের গল্প বেশ জমে উঠেছিল। রুমের ভেতর থেকে উঁকি দিতেই একদিক পুরো কাঁচের হওয়ায় সোজা চন্দ্রাহত পঞ্চচুল্লি, অন্যদিকে মন্দিরের ঘণ্টা। স্বর্গ বোধয় একেই বলে।
রাত তখন ৩ঃ৩০। হটাত রুম ফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল। আমি পড়ি মরি করে ফোন ধরতেই অন্যপ্রান্তে শুভাদীপের ভয়ার্ত কন্ঠ। "লিপির খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।" ধরমরিয়ে উঠে বসলাম। একটু সময় নিয়ে বেরনোর আগেই দুজনে হাজির আমাদের রুমে। লিপির খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রায় ৪ টে নাগাদ ফোনে তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। যদি কোন ওষুধ বিশেষ ব্যাবস্থা করা যায়। কাকুর কথা মত ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ান হল। ওই সময় নিচে নামতে বলা হলেও, হিসেব করে দেখলাম ওদের পক্ষে নামা সম্ভব নয়। বাকি সময় আমি ঘুমইনি। ধীরে ধীরে পঞ্চচুল্লির ঠিক পেছন থেকে সূর্য উঠল। শীতকালে অপরুপ কিন্তু এখন একটু দেরিতে। তাই সেই রকম সুন্দর নয়। ধীরে ধীরে কালো থেকে সাদা হয়ে গেলো। এই রুপের সামনে অনবদাও ঘুমতে পারে নি। রাতে উঠে উঠে পঞ্চচুল্লির রুপ দেখেছে। কিন্তু বাকি সবাই কুম্ভকর্ণের বর-প্রাপ্ত। সহজে ঘুম থেকে ওঠে নি। লিপিও ঘুমিয়েছে। আমাদের ঘরে।
আজকে শুভাদীপ লিপির সঙ্গে ছিল। আমরা একটু দেড়িকরেই বেরলাম। উদেশ্য নন্দাদেবী মায়ের মন্দির। সঙ্গে মিউজিয়াম দর্শন। বেশি কিছু দেখার নেই এখানে। যাই হোক, নন্দাদেবী মন্দিরে ঢুকে আমরা হতবাক। এক রুপের ঢালি নিয়ে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ সহ হাজির সবাই। আহা। চোখ জুরিয়ে গেলো। আকাশ একদম পরিষ্কার। আমাদের সামনে আরও সুন্দর হয়ে পঞ্চচুল্লি, চিতল কেদার, হংসলিঙ্গ, এমন কি নন্দাদেবী পর্বতমালাও। মন্দির টি বিরাট সবুজ প্রান্তরের মাঝ খানে। প্রায় সমতল ওই প্রান্তরে নেই কোন ধর্মীয় বাঁধা। বাচ্চারা বেশি খুশি। তারা খেলে বেরাতে লাগলো। প্রান্তরের যেকোনো প্রান্ত থেকে উন্মুক্ত দৃশ্য মোহ এনে দিলো। কিন্তু আমি ভুল করেছি। ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ করতে দিয়েছিলাম। পুনরায় ক্যামেরায় ভরতে ভুলে গেছি। তাই মোবাইলদিয়েই তুলে শান্ত থাকতে হল।
অনেক্ষন কাটিয়ে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে, নন্দাদেবীমা কে প্রনাম জানিয়ে আমরা বিদায় নিলাম। মা খুব জাগ্রত। এবার গন্তব্য স্থানীয় এক মানুষের তৈরি মিউসিয়াম। সেখানে একটু উঁচুতে উঠতে হয় ঠিক, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চমকে উঠতে হয় সংগ্রহে। বহুপুরনো তিব্বতি ত্রিপিটক পাথরে খোদাই থেকে শুরু করে মিলম হিমাবাহের ভিডিও। সব পাওয়া যাবে। আমি একটি বই সংগ্রহ করলাম।
এর পরে আবার হোটেলে ফেরত। সেখানে বসেই সারাদিন পঞ্চচুল্লি দর্শন। পুরনো হবে না কখনই। ধীরে ধীরে সাদা থেকে হাল্কা লাল হয়েই ঘুমের দেশে চলে গেলেন। পুরাণ মতে এই পঞ্চচুল্লি যা কিনা আসলে ৫ টি ভুমি সংযুক্ত প্রায় সম উচ্চতার পর্বতমালা, ছিল পাণ্ডব পত্নী দ্রউপদীর পাঁচ স্বামীর পাঁচটি উনুন। এর মাথায় রান্না করেছেন বলে মহাভারত বা পুরানে নথি আছে। এই পাঁচ শৃঙ্গএর মধ্যে পঞ্চচুল্লি - ২ সব থেকে উঁচু। ৬৯০৪ মিটার। Panchachuli-1 (6,355 m), Panchachuli-3 (6,312 m), Panchachuli-4 (6,334 m), Panchachuli-5 (6,437 m)। মাহেন্দ্রা সিং এর নেত্রিত্বে ইন্দটিবেটান পুলিশের একটি দল প্রথম সব থেকে উঁচু চুড়ায় ওঠে।
আমরা রুমে আলসেমি করে ও সামনের লনে আড্ডা দিয়ে দিন কাটিয়ে দিলাম। আজকে রাতে রিস্ক নি নি। লিপিকে আমাদের ঘরে কৌশীকীর জিন্মায় রেখে আমি শুভাদীপের ঘরে ছিলাম। রাতে সেরকম ঝামেলা হয় নি।
সকালে উঠতেই একটু তাড়াতারি বেরনোর প্রয়াশ করতেও ৯ঃ৩০ এর আগে বেরতে পারলাম না। আজকে আমরা ঠুমরি কুণ্ড ট্রেক করবো। জঙ্গলে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে হেঁটে হ্রদ দেখতে যাবো। পথে মিলতে পারে বন্য জন্তু। রাস্থা কঠিন ও গাছমছমে। সে এক অভিজ্ঞতা। পরের পর্বে।
















পর্ব-৭
ঠুমরীকুণ্ড যাবার জন্য যেখানে হাঁটা শুরু হয় সেখানে আমাদের গাড়ি এসে থামল। বলে রাখি, মুন্সিয়ারি আসা ইস্তক আমার ও একটু একটু শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো সকালের দিকে। গাছপালা কম নেই। তবে কেমন যেন অক্সিজেন কম মনে হতে লাগলো। এখানে নেমে প্রথমেই শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তারপর যখন হেটে যাওয়ার রাস্থা দেখলাম, আমার আশার বেলুন সাথে সাথে সশব্দে ফেটে গেলো। রাস্থা একদম সোজা নয়। বেশ চরাই উৎরাই । সঙ্গে সরু রাস্থা ও একদিকে খাদ। নিরিবিলি প্রকৃতি। মাঝে মাঝেই গাছের ফাঁক থেকে পঞ্চচুল্লি ও অন্যান্য চূড়া উঁকি দিচ্ছে। আরও পরিষ্কার, আরও কাছে। যা আছে কপালে বলে উঠতে ও নামতে লাগলাম। আমি একটু ধীরে। মেয়ে তার মার সঙ্গে। অনব দা ও শুভাদীপ সুঠাম শরীর নিয়ে উঠতে লাগলো। সব থেকে অদ্ভুত পথপ্রদর্শক। তিনি গুনে গুনে ৮০০ টাকা নেবেন, কিন্তু ছুটছেন সবার আগে। সাধারণত এরকম হয় না। অন্তত সারমেয়কুল যদি আপনার পথপ্রদর্শক হয় তো কথাই নেই। কিন্তু এখানে সারমেয়কুল নেই। পথপ্রদর্শক বাবুর নাম মনে নেই। কিন্তু আমাকে একবার ধমক দিতে হল। ধমক খেয়ে উনি শুভাদীপের সঙ্গে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু ওদের হাঁটার গতি অনেক বেশি। আমি সবার শেষে। পুরো দূরত্ব ৩.৫ কিলোমিটার। আমি এক এর একটু কম গিয়ে আর পারলাম না। তার পর কানার মত চলতে গিয়ে খেলাম গুঁত। প্রায় মৃত এক রাস্থা আটকে থাকা গাছে গুঁত খেয়ে মাথা কেটে হাল্কা রক্ত পরল। আমি আর এগোয় নি। মেয়েকে নিয়ে ফিরতে লাগলাম। মেয়ের মাকে ঝারা হাত পায়ে কুণ্ড দর্শন করতে সুযোগ করে দিলাম। মেয়ে পাড়ত। কিন্তু আমি নিয়ে ফিরে এলাম। অনবদা উৎসাহ দিয়েছিল। কিন্তু আমি উৎসাহিত হতে পারি নি। তবে রাস্থার ধারে ফুটে থাকা লাল গুরাস বা রডডেনড্রন, গাছের ফাঁকে উঁকি দেওয়া পাহাড়, ও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিরিবিলি পাথুরে রাস্থা। জঙ্গল ট্রেক হিসেবে এক অপূর্ব স্বর্গ। কুণ্ডটি বরফ গলা জলে পূর্ণ।
উত্তারাখান্ড দেব ভুমি, তাই পদে পদে জড়িয়ে পুরাণ। এই কুণ্ড নিয়ে গল্প হল, এই কুণ্ড একসময় নইনিতালের থেকেও বড় ছিল। স্থানীয় আদিবাসিদের কন্যাকে দেবতারা চক্রান্ত করে এখানে লুকিয়ে রেখেছিলো। তাই স্থানীয় আদিবাসিরা কুণ্ডটি খুঁড়ে দেয়। অনেক জল বেরিয়ে যায়।
ফেরার পথ মোটেই মসৃণ নয়। কখন উঠতে কখন নামতে হচ্ছে। সিঁড়ি বলতে পাথরের খাঁজ। একটু অসতর্ক মানেই পরে যাওয়া। দুটি থাকে উচ্চতা কম নয়। ফলে হামাগুরি দিয়েও উঠতে হতে পারে। এদিকে আমার দম একদম শেষ। রাস্থায় দেখলাম জন্তুর হাগু। ঘোড়া হতে পারে, ভালুক হতে পারে। তবে টাটকা। এদিকে আমরা দুজন। মনে ভয় ধরে গেলো। শেষ শক্তি নিয়ে বাকি রাস্থা কিভাবে পেরিয়েছিলাম আমি নিজেই জানি না। যাওয়ার পথে রাস্থার শোভা দেখেছি। ফেরার পথে দ্রুত রাস্থা শেষ করেছি। তবে বাকিরা কষ্ট করে হলেও কুণ্ডে পৌঁছেছে। কুণ্ড মানে জলাশয়। ঠুমরী খুব সুন্দর একটি কুণ্ড। আর এই রাস্থাও একদম প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে। অপূর্ব লাগবেই। লোক কম, ফলে হুরহুরির সুবিধা নেই। তবে বন্য জন্তু আছে। তাই পথপ্রদর্শক ছাড়া না যাওয়াই ভালো।
আমি আর মেয়ে ফিরে এসে গাড়িতে প্রাতরাশ সারলাম। লিপি শুরুই করে নি। আমি আর লিপি বাজি ধরলাম, কৌষিকী ও রশনি দি এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরবে কিনা তার ওপরে। আমার বিশ্বাস ছিল না। আমরা নিচে অপেখ্যা করতে থাকলাম বিরক্তিকর ভাবে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে ওরা সবাই, মানে কৌষিকী, রোশনিদি, অনবদা, সুফি সবাই কুণ্ড দেখে প্রায় ৩ ঘণ্টা পরে ফিরে এলো। শুভদীপ শেষ করতই। অনবদাও। কিন্তু বাকিদের নিয়ে সংশয় থাকলেও তাড়া শেষ অবধি গিয়ে আবার ফিরেছে। পথপ্রদর্শক বাবু যথারীতি আগে আগে দৌড়েছে, শুভাদীপ সবার আগে আসবেই, ওর গতি বেশি, আর ও পেছনের লোকের জন্য অপেখ্যা করে না। ফলে ভুটানের মত সমস্যাও হয়। তবে এখানে সমস্যা হয়েছে বাকিদের। পথপ্রদর্শক বাবু সুযোগ বুঝে শুভাদীপের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে, ফলে বাকি ধীর গতির ট্রেকাররা একটু সমস্যায় পড়েছে। অনবদা সাহায্য করেছে বলে রক্ষ্যে।
ফিরে এসেই শুভাদীপ গুরাস দিয়ে লিপি কে ছাব্বিক (কাব্বিক থেকে নেওয়া, ব্যাকারন মানি না) ভালোবাসা প্রদান করে বসলো। আমার বউ ও ফিরে এসেছে। মুখে বিজয়ির হাঁসি। সঙ্গে আমি কেন পারলাম না তার এক গুচ্ছ কারন। :) কখন উঠে আসছে ধুম্রপান তো কখন অতিরিক্ত ওজন। আমার সবথেকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে ওজন অতিরিক্ততা। যার ফলে আমি হাপিয়ে গেলাম। আমাদের বিয়ে ১০ বছর হতে চলেছে, কিন্তু এখন আমার বউ ফেরার পথে আমার জন্য গুরাসফুল আনতে ভোলে না। গুরাস ফুল দিলো।
গাড়ি ফিরে এলো হোটেল। এক গামলা খাবার নিমেশে শেষ করে আমাদের আজকে ঘুম দিতেই হল। বিকেলে কষা মুরগি সহযোগে বন-ফায়ার হবে যে। ঘুম ভাঙ্গার একটু পরেই, মিলম ইনের ভেতর দিকের গাড়ি রাখার অঞ্চলে ফাঁকা জায়গায় কাঠ সাজিয়ে রাখা। মুরগি রোস্ট হয়ে আসছে। সব সুদ্ধু ২৪০০ টাকা। একটু পরেই আগুন জলে উঠল। ৬ যুবক-যুবতি ও দুই শিশু আনন্দে মেতে উঠল। হল নাচা গানা। সঙ্গে ফুর্তি চূড়ান্ত, যা দীর্ঘদিন স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যাবে।











পর্ব-৮
মুন্সিয়ারির শেষ রাত সমগ্র ভ্রমনের আয়ুর মধ্যে সব থেকে সুন্দর রাত। লিপিও প্রায় সুস্থ ছিল। সবাই খুব আমোদ করেছি। জ্যোৎস্না রাতের মায়াবি পঞ্চচুল্লির সামনে, মহময় পরিবেশে বন ফায়ার চিরকাল স্মরণীয়। বিশেষ উল্লেখ আমাদের খুদে সদস্য সুফি। সে আজকে এমনি একার চেষ্টায় ৭ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্থা অতিক্রম করেছে, বাবার কোলে খুব কম উঠে। এটা তার প্রথম ট্রেক ছিল। প্রথমেই সফল ওই ৫ এর থেকে কম বয়েশি। এর আগে আর এক খুদে "টিনটিন" যে আরও ছোট, নিজেই হিলে-বারসে ট্রেক করেছিল। গল্প পড়েছি। আজকে দেখলাম। সেই আনন্দ যেন বন ফায়ারে আরও মজা এনে দিলো। তাই পরের দিন সকালে হোটেল ছাড়তে মন চাইছিল না। কিন্তু দীর্ঘ পথ আবার অতিক্রম করতে হবে। থল-চাউকরি হয়ে আমরা যাবো বিন্সার জঙ্গলের পাশ দিয়ে কাসার। অর্থাৎ গভীর জঙ্গল। শেষ বারের মত ছবি তোলা হোল। আজকে এখন পঞ্চচুল্লি দেখা দিচ্ছেন ফুটফুটে।
ফেরার পথে প্রথম বাঁধা, লিপির ফোন ফেলে আসা। গাড়ি ঘুরে আবার চলল হোটেল। প্রায় ৫ কিলমিটার। আমি যাই নি। আমি অনবদা ওখানেই নেমে গেলাম। কারন? চোখের সামনে অপূর্ব দৃশ্য। বসন্তের লালাভ গাছের পাতা যেন এক অনুভুতি। এঁকে বেঁকে চলেছে রাস্থা তার মাঝে। আর ফাকে ফাকে উঁকি দিচ্ছেন ধবল পর্বতমালা। কিছু ছবি চটপট তুলে ফেললাম। ওদের একটু কষ্ট হোল, আমার মন ভরে গেলো। গাড়ি ফিরতেই দ্বিতীয় বাঁধা। আমাদের একটি ব্যাগ ছিঁড়ে রাস্থায়। যদিও পাওয়া গেছে, তবে প্রাথমিক ভাবে বুঝতে আর একটু দেড়ি হলে বা খাদে পরলে দরকারি কাগজপত্র সব নষ্ট হত। তবে সারথি চন্দনজী মুখ বুজে আমাদের পরিষেবা প্রদান করে গেলেন। উনিই দৌরে ব্যাগ নিয়ে এসে শক্ত করে বাঁধলেন। প্রায় আবার ১০ টা বেজে গেলো মুন্সিয়ারি ছাড়তে। আবার আসবো।
মুন্সিয়ারি থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম থল। এখানে রামগঙ্গা দেখা দিল। একদম কাছে। লিপির শরীর লম্বা ভ্রমনে কখনই ঠিক ছিল না। কিন্তু রামগঙ্গা ওকে সতেজতা এনে দিলো। রৌদ্র প্রখর। কিন্তু হিমেল হাওয়া। ফলে গরম লাগছিল না। একটি জায়গায় গিয়ে একদম প্রায় নদীর সমতলে গাড়িটি দাঁড়িয়েগেলো। একটু নামলেই রামগঙ্গা। সবাই নেমে পড়লাম। তিস্তার সঙ্গে তুলনা চলে। অনেকটা এক জলের রঙ। তবে এখানে মাছ আছে। পায়ে সুড়সুড়ি দিতে আসছে। সাহসি। জলে নামতে কেউ ভয় পেল না। আমি নামলাম না। কারন আমি চিত্রগ্রাহক। সামান্য পদস্খলন বহু দামি ক্যামেরা গুলির বারটা বাজিয়ে দেবে। সঙ্গে রয়েছে মুন্সিয়ারির স্মৃতি। বাকিরা হিমেল জলে পা ভেজাতে লাগলো।
এর পরেই থল। একটু বড় জনপদ। এখানেই দুপুরের খাবার খাওয়া হল। ঠিক ছিল ধুউলচিনা বলে একজায়গায় খাবো, ভাগ্যিস এখানে খাবারের সিধান্ত নিয়েছিল অনবদা। নাহলে সেদিন রাতের আগে খাবার মিলত না। খাবার মান খুব ভালো নয়। ভাত, রায়তার ডাল, ডিম ভাজা সহযোগে অল্প বিস্তর পেট ভরিয়ে আবার ছোটা শুরু।
রাস্থা আর শেষ হয় না। বিকেল বিকেল পেরলাম চাকউরি। জঙ্গলে ঘেরা দারুন প্রকৃতি। কিন্তু এখন পর্বতমালা কুয়াশায় ঘেরা। তাই ভাগ্যে কিছু জুটল না। বেশিক্ষণ সময় নষ্ট না করেই এগিয়ে চললাম। সবাই বমির হাত থেকে বাঁচতে ঘুমন্ত। শুধু পথ মধ্যে এক স্থানীয় ছোট দোকানে চায়ের জন্য ও লিপিকে সুস্থ করতে নামা হল। একবার উঠছি তো একবার নামছি। একবার গরম তো একবার ঠাণ্ডা। এর ফলেই সঙ্গে মনে রাখার মত পাকদণ্ডি, যে কেউ শরীর খারাপ করে ফেলবে। যাই হোক চা খেতে মন ফুরফুরে হল। চাদোকানের মালিকের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে। এসেছিল আমাদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। সুফির তো খুব পছন্দ। আজকেই পারলে বিয়ে করে ফেলে। ওর মা, হবু বউমার ছবি ইত্যাদি নিয়ে এসেছে। ভবিষ্যৎ কি বলে সেখা যাক।
আবার বিরক্তিকর যাত্রা। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামবে। সূর্য ডুবতে চলেছে। হটাত সামনে বেশ বড় একটি গাছ ধপাস করে পরল। না ধস নয়। কয়েকজন মিলে গাছটিকে কোতল করলো। দেখে মনে হয় নি গাছটি মৃত বা কাটার উপযুক্ত। অরন্য ধ্বংস। মনে হল বন বিভাগের লোক। অর্থাৎ সরকারি খুন। শুনেছি এই অঞ্চলে প্রচুর গাছ। কিন্তু পেলাম কই? অর্থাৎ প্রচুর খুন খারাপি হয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় আলো নেই এমন সময় হটাত চন্দনজী আসল রাস্থা ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেলেন। বললেন এটাই আসল বিন্সার জঙ্গল। কালকে আপনারা অনেক নিচে কেএমভিএন এর লজে বা জিরো পয়েন্ট জেতেই পারেন কিন্তু জন প্রতি ২৫০ টাকা ও গাড়ির জন্য ২০০ টাকা গুনতে হবে। তার থেকে আসল বনপথ দিয়ে চলুন। কিছু দেখলেও দেখতে পারেন। বরং কালকে কাসার দেবী মায়ের মন্দির ও আলমোরা চিরিয়াখানা ঘুরিয়ে দেবো। প্রস্থাব মন মত হল। খরচের চাপ পড়েছে। তাই আরও অতিরিক্ত খরচ করতে ইচ্ছা হল না। জঙ্গলের ভেতরে কাঁচা রাস্থা ধরে এগতে থাকলাম। আমার সঙ্গে জন্তুদের সম্পর্ক আছে। আমি গাড়িতে থাকলে নিদেন পখ্যে একটা হরিনতো দেখাই যাবে। মুন্সিয়ারি ঢোকার মখে শিয়াল ও হরিন দেখেছিলাম। এখানেও কিছুটা এগতেই বাচ্চা হরিন আমাদের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেলো। একটু এগতেই গলু দেবতার ছোট্ট মন্দির। গাছমছমে জঙ্গল। তবে ঘনত্ব আমাদের উত্তরবঙ্গের থেকে অনেক কম। এর একটু এগতেই কৌষিকী দর্শন পেল কালো কালো হামাগুরি দেওয়া বাচ্চা কোন পশু। পাথরের ফাঁকে এক ঝলক। নিশ্চয়ই ভালুক বাচ্চা। একদম নিরাশ হতে হল না। বাঘ বাঘ ভেবে অনেক কিছুই দেখলাম, কিন্তু চিতা সেই চিরিয়াখানায়।







পর্ব-৯
কাসার পৌঁছলাম। কাছেই কাসার দেবী মায়ের মন্দির। আমরা থাকব কাসার জঙ্গল রিসর্ট। একটি তিন তারা হোটেল। জঙ্গলে ঘেরা। ৪ টি করে ঘর নিয়ে একটি ব্লক। আমাদের অভ্যর্থনা করলো মকটেল সহযোগে। আয়োজন ভালই। ঘর একটু গা ছমছমে ও একদম গাছপালায় ঘেরা। কাছেই বিন্সার জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। কুমায়ুন মণ্ডলের রিসর্ট দেখা যায়। বিদেশীদের পছন্দের। কারন জঙ্গলে ঘেরা ও খুব সুন্দর ভিউ আছে। ঘর পরিষ্কার। তবে জঙ্গল হলে যা হয়। অল্প বিস্তর মাকড়শা জাতীয় উতপাত। রাত টা ঘটনাহীন হতে পাড়ত। হয় নি। খাবার টেবিলে বসতেই হাতে ছ্যাকা লাগলো। প্রায় কিছু না খেয়েই হাজার চারেক টাকা খসে গেলো। তিন তারায় এত খরচ আগে পাই নি। পরিমান প্লেট হিসেবে কম। রাতে অত রাস্থা অতিক্রম করে ক্লান্ত থাকলেও আমরা তিন ছেলে মিলে অনেক রাত পর্যন্ত বকবক করেছি। গাছমছমে পরিবেষ গায়ে মেখে।
সকাল আজকে দেড়ি করে হল সবার। তবে আমি সেই ভরেই উঠে পড়েছি। কুয়াশা ঘেরা দৃশ্য। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে সেই ত্রিশুল ও নন্দাদেবী চূড়া দেখা যাচ্ছে। বাকি সব ঢাকা। অল্প সময় দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো। শুভাদীপদের ঘর থেকে ভালো দেখা যাচ্ছিল। আমাদের নিচের তলায় গাছের জন্য দৃশ্য বাঁধাপ্রাপ্ত। তবে জঙ্গল দর্শন খুব ভালো হচ্ছে।
১০ টা নাগাদ গাড়ি চেপে বেরলাম। সামনে সস্থার হোটেলে প্রাতরাশ সেরে ধীরে সুস্থে এগিয়ে চললাম কাসার দেবীমার দর্শনে। একটু এগিয়ে চন্দনজী থেমে গেলেন। ওপরে দেখিয়ে বললেন ওই যে মায়ের মন্দির। ওপরে উঠে দর্শন করুন সময় কাটান। আমি আজকে একদম রিস্ক নিতে চাইছিলাম না। কিন্তু সবাই উৎসাহ দিলো। অনবদা প্রায় তুলে নিয়ে গেলো। এই রকম লোক সঙ্গে থাকলে উৎসাহ অনেকগুন বেরে যায়। ধীরে ধীরে পাথরের রাস্থায় উঠতে উঠতে মনে মনে মা কে ডাকলাম। অন্তত দর্শন দিয়। একটু অসুবিধা হলেও ৬০০-৭০০ মিটার এই খাঁড়াই রাস্থা আমি পার করে দিলাম। হাঁটুতে ব্যাথা হয়েছে। তবে আজকে হার মানি নি। অরনবদার উৎসাহ আমাকে আজকে সফলতা দিলো। ওপরে উঠে মায়ের দর্শন করলাম। ওপর থেকে দৃশ্য খুব মনরম। সমগ্র আলমোরা দেখতে পাওয়া যায় প্রায়। সঙ্গে শীতকালে অবশ্যই শৃঙ্গ দর্শন হয়। আজকে কুয়াশার চাদর সরিয়ে হল না। এখানে দেখলাম স্বামী বিবেকানন্দ তপস্যা করেছেন। মন্দিরটি একটি গুহার বাইরে অবস্থিত। গুহায় বসেই তপস্যা করেছেন স্বামীজি। মন্দিরের পুজারী হটাত কি হল, আমাকে একটি টিপের পাতা দান করলেন। আমি গ্রহন করলাম। আরও ওপরে মহাদেবের মন্দির তৈরি হচ্ছে। আমি উঠিনি। অরনবদা ও শুভদীপ গেছিলো। কিছুক্ষণ থেকে নেমে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম বিদেশীদল ওপরে উঠছে। ঘেমে নেয়ে একশা। এদিকে আমাদের ঠাণ্ডা লাগছে। হাই হেলো বলে নেমে এলাম।
এবার গন্তব্য আলমোরা চিরিয়াখানা। টিকিট কেটে উঠতে লাগলাম। একটু উঠে দেখতে পেলাম দুই মহিলা ও এক পুরুষ চিতাবাঘের। কয়েকজন ওপরে উঠেছিলো। হরিন দেখতে। কিন্তু বেশি ওপরে ওঠার দম রাখতে পারে নি। নেমে এসেছে।
এর পর গেলাম গলুদেবতার মন্দির। মহাদেবের রুপ। অনেকেই এখানে কামনা করে ঘণ্টা বেঁধে রেখেছেন। ঘণ্টায় ঢাকা রাস্থা দিয়ে মন্দিরে যেতে হয়। মন্দিরে বাঁদরের উতপাত ভালই। ভেতরে মন ভরে প্রনাম করলাম।
আজকে লিপি সুস্থ আছে। বিকেলে কোন কাজ নেই। সামান্য ভাত ঘুম দুপুরে দিয়েই বিকেল থেকে নিখাদ আড্ডা। সঙ্গে ভৌতিক আলোচনা। ভুতুরে জঙ্গলে ভৌতিক আলোচনা জমে উঠল। যদিও কালকের থেকে আজকে লোক বেশি, তবে জঙ্গলের মধ্যে হওয়ায় গা ছমছম বেশি করেছে। এত দিনে আমরা যেন একটা পরিবার হয়ে গেছি। আর মাত্র একটি স্পট। ব্যাস ভ্রমন শেষ। মন খারাপ। আর দুই রাত থাকবো আজকের পরে। রাতে অনেখন গল্প হল।
সকালে উঠে ক্যামেরা নিয়ে বেরলাম। পাখির আনাগোনা ভালই। একটি কালো মাথার জয় পাখি সুন্দর ভঙ্গিমায় ধরা দিলো। ব্যাগ পত্র গোছান ও গাড়িতে তোলাসম্পন্ন হতেই আমরা রওনা দিলাম নৈনিতাল।













 পর্ব-১০
সকাল ৯ঃ৩০ নাগাদ চন্দনজী হাজির গাড়ি নিয়ে। আজকে আলমোড়া বাইপাস ধরে নিলাম। সময় সংক্ষিপ্ত করতে। পথে বালমিঠাই কিনে নিলাম বাড়ির জন্য। এই মিষ্টিএকটু অদ্ভুত। এখানে পাওয়া যায় কিনা জানি না। করাপাক লম্বাটে ও গায়ে হাল্কা বাঁধুনিতে ছোট নকুলদানা লাগানো। খেতে গেলে ঝরে পরবেই। রস হীন। আর এক রকম নিলাম, নাম টা বলল চকলেট, কিন্তু মিষ্টি। ২৪০ টাকা প্রতি কেজি দুটোই। মন একটু খারাপ। এতদিনের ভ্রমন প্রায় শেষের পথে। সঙ্গীরা প্রায় পরিবার। কিন্তু সব কিছুর শেষ আছে। সেই মত শেষ ভ্রমন স্পট নৈনিতাল পৌঁছলাম। রাস্থায় একটু দাঁড়িয়ে কষ্ট করতে হয়েছে, রাস্থা সারাই হচ্ছিলো। গরম ভালই ছিল। চন্দনজী ও কুমায়ুন ট্রিপ ম্যাহেমাননওাজি ভালই করেছে সারা ভ্রমন। গাড়িতে সমতল বা উপত্যকায় এলেই বাতানকুল যন্ত্র চালু করে দিয়েছেন। আজকেও চালু করতে হয়েছিল খানিখন। আবার পাহাড়ে উঠতেই যন্ত্র বন্ধ।
একটু পরেই "তাল" দেখতে পেলাম। বুঝে গেলাম নৈনিতাল এসে গেছে। পাকদণ্ডি বেয়ে নেমে আসলাম বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে ম্যালরোড ঢুকেই হোটেল এলিফেনস্টোন আমাদের পরবর্তী দু রাতের ঠিকানা। সামনেই "নৈনিতাল"। হোটেলের উল্টো দিকেই। হোটেল থেকে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের সাধারন মানের রুম দিলো অসাধারন দামে। রুম বড় কিন্তু স্নানঘর এতই ছোট যে গায়ে দেওয়াল লেগে যাচ্ছে। ইংরেজ আমলের কাঠামো। পরিষ্কার হলেও সম্পূর্ণ নয়। আমাদের ঘরগুলর সামনে গাছেঢাকা লেক। ফলে গাছের ফাঁকদিয়েই যা দেখা যাবে। অন্য পাশটা পরিষ্কার ভিউ রুম থাকলেও আমাদের দিলো না। খাবার অত্যন্ত দামি। কাসারের মতই। কিন্তু পরিমান বেশি হওয়ায় কম নিলেও পুশিয়ে যাচ্ছিলো। আমরা দুপুরটা ও রাতটা ওখানে খেলাম। বিকেলে অনেকটা হেঁটে ম্যালে এলাম। সেখানেই প্রথমে লেক ভ্রমন করলাম নৌকায়। এক একটি নৌকায় ৪ জন করে সর্বাধিক। ২২০ টাকায় পুরো লেক বললেও আসলে অর্ধেক লেক ঘোরা। মাঝে ড্রাম ফেলে সিমানা নির্দিষ্ট। একদিকে তল্লিতাল সেটাই ঘুরলাম। আমাদের হোটেলের সামনে মাল্লিতাল। ওটা আর ঘোরা হয় নি।
এর পর রোশনিদি কফি খাওয়াল। আমরা খেলাম তার সাথে খাসির মোমো। ভালই স্বাদ ছিল। আসেপাশে কেনাকাটার হরেক সম্ভার। অতয়েব মহিলা সদস্যদের কেনাকাটা শুরু। অতিরিক্ত ব্যাগ বেরে যেতে থাকলো। দাম খুব একটা সস্থা নয়। কিন্তু কিনলাম। এই অঞ্চলে একসঙ্গে নৈনি দেবী মার মন্দির, একটু দূরে মসজিদ, পাশে গুরুদোয়ারা, বিশাল ক্রিকেট মাঠ। কাছাকাছি চার্চও ছিল। অর্থাৎ সর্বধর্ম সমন্বয়। আজকে একটু ক্লান্ত থাকায় মহিলাবাহিনী জলদি বাড়ি ফিরে এলেন।
রাতে হটাত ভুতুরে উপদ্রব। আমাদের ছাদের ওপরে বুট পায়ে হেঁটে বেড়ানোর শব্দ। শুভাদীপ ভয়ার্ত ফোন করে বসলো। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম ওপরে বাচ্চা সহ অনেকের হাঁটা চলার শব্দ। রাত প্রায় ১২ টা। অর্থাৎ নতুন অথিতি এসেছে ওপরের ঘরে। তাই এত বিরক্তিকর শব্দ। যাই হোক শুভাদীপকে এটাই বুঝিয়ে শুয়ে পরলাম। পরের দিন সকালে হোটেলের লোকেদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। দিল্লি নিবাসীরা ৩ দিনের ছুটিতে চলেএসেছেন। যেমন আমরা দার্জিলিং যাই আর কি। আসতে রাত হওয়ায় এই উপদ্রব।
যাই হোক, পরের দিন সকালে প্রাতরাশ না করেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম ঝর্না দেখতে। ঝর্নার সামনেই হোটেল। খুব বড় না হলেও তেজ আছে, পাহাড়িতো। পাশেই উত্তরাখন্ড সরকারের কাপড়ের দোকানে চুটিয়ে কেনাকাটা। এখন প্রায় শেষের দিকে বলে আর ভয় নেই পয়সা করির। যা আছে উগড়ে জিনিস কেনা হল। সস্থা হল। তবে সময় অনেকটা ব্যয় হল।
পরবর্তী গন্তব্য খুরপিয়া তাল ও মনসামন্দির। পাহারের গায়ে মা মনসা দেবীর মন্দির। তার এক পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে ঘোড়ার খূরের মত দেখতে লেক। এর পর এক ভিউ পয়েন্টে গিয়ে পুরো লেক টা আমের আকৃতি দেখা গেলো। পথে পরল সুখাতাল, যার জল সুখিয়ে গেছে। সেই সব ছবি নেওয়া হল। গেলাম স্নো ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে শৃঙ্গ দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দুরভাগ্যের জন্য জুটল না। ফেরার পথে রোপওয়েতে নামলাম না। খিদে পেয়েছিল। বাঙালি হোটেল মৌচাক আমাদের সস্থায় খাসি সহযোগে রসনা তৃপ্ত করলো। বিকেলে আমি আর বেরোই নি। মহিলা মহল ঘুরতে গেলো। প্রায় নৈনিতাল বাজার ফাঁকা করে জিনিস কিনল। ফিরতে রাত করলো। চকচকে মুখ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আরও একটু কিনলে ভালো হত। কিন্তু হোটেলের দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। যাই হোক আজকেই ভ্রমনের শেষ রাত। কালকে ফিরব ট্রেন ধরতে।
[পরের পর্বে সমাপ্ত]




















পর্ব-১১
শেষ রাতে কেনাকাটা করে জিনিসপত্র ব্যাগে ঢোকাতে রিতিমত লড়াই চলল। লিপিকে ব্যাগের ওপরে বসিয়ে ৩ জনে মিলে ব্যাগের চেন লাগানো হল। সব ঘরের এক ছবি। রাতে আর আজকে কোন উপদ্রব হয় নি। খাবার সময়মত হোটেলেই সারলাম। হোটেল মালিক দু চারটে বাক্য বিনিময় করলেন এবং প্রচেষ্টা করলেন বাংলায় বলার। ব্যাবসা কিভাবে করা যায় এদের থেকে শেখা ভালো। সকালের সম্পূর্ণ খাবার শুভাদীপ টাকা দিয়েছিল, রাতে তাই ওদের টা আমরা দেবো ঠিক হল। দেখা গেলো আপতকালীন সময় ব্যাবহার করার জন্য কিনে রাখা শুখন খাবার অনেক থেকে গেছে। নিয়ে নেওয়া হল ব্যাগে।
সকালে ঠিক ১০ টায় হোটেল ছেড়ে দিলাম। ৯ঃ৩০ থেকেই খোঁজ নিচ্ছিল কখন ছাড়বো। নরম ভাবে। আসলে প্রচুর ভ্রমন প্রিয় বা ছুটি কাটানোর লোক দিল্লি থেকে এসে গেছে। একটু নিচে নামতে হল । মাল বাহকরা নামিয়ে আনলেন। এই প্রথম এই হোটেলে দেখলাম খোরাকি নিয়ে ভিখারিপনা। এর আগে যে হোটেলে রুমবয়দের যে টাকাই দিয়েছি, হাঁসি মুখে মেনে নিয়েছে। এখানে এমন করতে লাগলো যে মোট ৮০০ টাকা দিতে হল দুবারে। ভিখারিপনার চূড়ান্ত। আমি বলবো এই হোটেলে না যেতে।
গাড়ি এগিয়ে চলল বিভিন্য তাল বা হ্রদ দেখাতে। নল দময়ন্তি তালের পাশ দিয়ে একটু পরেই রাম, লক্সমন, ইত্যাদি ৭ জনের নামে সাততাল। খুব সুন্দর। একটি পাহাড়কে মাঝে দ্বীপের মত করে চারপাশদিয়ে ঘিরে হ্রদ গুলি পরস্পরের সাথে যুক্ত। এখানেও নৌকায় ঘোরা যায়। কিন্তু আমরা উঠিনি। অনেখন সময় এখানে কাটালাম। ট্রেন দেড়ি আছে। এখান থেকে বেরিয়ে পৌঁছে গেলাম নউখছিয়া তাল। এই হ্রদ অপেক্ষায় ছোট। কিন্তু এখানে নৌকায় চাপার ভাড়া অনেক বেশী। নৌকাগুলি সুন্দর ও ওপরে ঢাকা দেওয়া।
পরবর্তী গন্তব্য সুবিশাল হনুমান মন্দির ও মা কালির মন্দির। গুহাপথে মাদর্শন করতে হয়। আমি যাই নি। জামাকাপর পরিষ্কার ছিল না। বাইরে থেকেই ছবি তুলে গাড়িতে উঠে পরলাম। বাকিরা গেছিলো।
শেষ গন্তব্য ভিমতাল, আসার দিন এর পাসদিয়ে গেলেও আসল রুপদেখা হয় নি। সুবিশাল হ্রদ। নৈনিতালের মতই প্রায় লম্বায় চওড়ায়। শুধু ছবি তুলতে নামলাম। রৌদ্র ভালই তেজী। গরম, তাই সবাই সব জায়গা দেখতে পেল না। ভিমতাল ও সাততাল আমার নৈনিতালের থেকে ভালো লেগেছে।
গাড়ি ধীরে ধীরে নেমে এলো কাঠগদাম। তার আগে দুপুরের খাওয়া সেরেছি, ভালো লাগেনি। আমরা গাড়ি ধরব লালকুয়া থেকে। লালকুয়া/হাওড়া এক্সপ্রেস খুব ভালো আসে। কিন্তু সপ্তাহে শুধু শুক্রবার হাওড়া থেকে ছাড়ে ও শনিবার লালকুয়া থেকে ফেরে। আজকে শনিবার। দেখতে দেখতে ১২ দিন শেষ। কাঠগদাম থেকে মিনিট ৪০ গাড়ি চলে লালকুয়া এসে দাঁড়াল। চন্দনজীকে বিদায় জানিয়ে আমরা মালপত্র নিয়ে ট্রেনের সামনে চলে এলাম। সময় মত ট্রেন ছেড়েও দিলো।
গল্প এখানেই শেষ হতে পাড়ত। হল না। রাতের খাবার নিয়ে সমস্যা তিব্র হল। গাড়িতে একটিও হকার নেই। নেই খাবার অর্ডার নিতে আসা কোন লোক। কারন সামনে এই রাস্থায় রাজ্যরানি এক্সপ্রেস লাইনচুত হয়েছে। সবাই কি সেখানে গেছে? জানি না। আমি রুদ্রপূর ঢুকতেই আইআরসিটিসি মোবাইল খাবার থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বেরেইলি পৌঁছে আমাকে ফোন করলো তারা খাবার দিতে পারবে না। কারন সেই ট্রেন উল্টে যাওয়া। একপ্রস্থ বাকবিতন্ডা হতেই আমি অর্ডার কেন্সেল না করে বিষয়টি রেল মন্ত্রকের নজরে আনলাম। ওদের আমি জিগ্যাসা করেছিলাম, আমরা কি খাবো তবে? ওদের উত্তর আমরা কি জানি। ভাবুন।
তবে বাচ্চাদের ব্যাবস্থা হয়ে গেলো। একদল ট্যুরপার্টিও ছিল আমাদের সঙ্গে। সেই পার্টির মালিকের বউ (এনার নাম জিগ্যাসা করি নি, পদবি লোহার) আমাদের পরিস্থিতি বুঝে বাচ্চাগুলোর জন্য পরঠা ব্যাবস্থা করে দিলেন। নিখরচায়। আসানসোল নিবাসি সম্ভবত সানি ট্রাভেলস এর মালকিনের এই মানবিকতা আমাদের ভোলা সম্ভব নয় কোন দিন। আপনাকে ধন্যবাদ আবার। আমাদের পেট পোরার জন্য ব্যাবস্থা হল কিছু শক্ত শক্ত লুচি, যা আমরা বেরেইলি থেকে তুলে নিয়েছিলাম।
রাতেই রেল মন্ত্রক ব্যাপারটা আইআরসিটিসি নর্থজোনকে দেখতে নির্দেশ দেয়। সমগ্র লেখালেখি টুইটারের মাধ্যমে। এই কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি খাদ্য পরিবেশন সংস্থা শুধু ধমকই খায় নি, তাদের কাজ করার লাইসেন্স কিছুদিনের জন্য বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আমাকে দুবার ফোনে সব ঘটনা জেনে নিয়েছে। সম্ভবত ট্রাভেলখানা ওদের নাম।
ফেরার পথে পরে গয়া- কোডারমা-হাজারিবাগ রোড। মানে বুঝতেই পারছেন ট্রেনে বসেই আর এক প্রস্থ জঙ্গল সাফারি।
যাই হোক ফিরে এলাম ঘরে, ফিরে এলাম আর এক নতুন তৈরি পরিবার নিয়ে। প্রায় অচেনা মানুষগুলি কত কাছের হয়ে গেলো। সঙ্গে সুন্দর অভিজ্ঞতা। আহা, জীবনের মণিকোঠায় অনেকদিন থেকে যাবে এই অভিজ্ঞতা।
রুট যেভাবে গেছিঃ
শিয়ালদহ- দিল্লি( এক রাত)- কাঠগদাম-সিতলাখেত ভায়া রানিখেত (এক রাত)- কউশানি ( এক রাত)- মুন্সিয়ারি (৩ রাত)- বিন্সার/কাসার ( ২ রাত) - নৈনিতাল (২ রাত)
জন প্রতি আমাদের পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা কেনাকাটা নিয়ে।
সঠিক সময় শীতকাল হলেও মার্চ ও এপ্রিলের প্রথমার্ধে যাওয়া সম্ভব ও গুরাস দেখা যাবে।
মনে রাখবেনঃ
১। রাস্থা একদম দার্জিলিং/লাদাখ/কাশ্মীরের এর মত নয়, অনেক বেশী পাকদণ্ডি। তাই মাথা ঘুরবে ও বমি পেতেই পারে।
২। রাস্থা সর্বত্র ভালো নয়।
৩। আমাদের সঙ্গে পাতালভুবনেস্বর থাকলেও শুধু পাতালভুবনেস্বর এ একদিন রাখবেন। নাহলে আমাদের মত যেতে পাড়বেন না।
৪। সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা ভালো, বিশেষ করে মুন্সিয়ারির দিকে।
৫। এখানে হোমস্টে ব্যাপারটা দেখলাম না।
৬। সবকিছু খুব দামি।
৭। খাবার দাবার পাঞ্জাবি ঘরানার। ফলে হজমের ওষুধ নিয়ে যাবেন।
[শেষ]