Amazon

Yamunetri লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Yamunetri লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮

গাড়োয়ালের আলিগলি


প্রথম পর্ব

হরিদ্বার

গাড়োয়াল শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে উঁচু উঁচু বরফাবৃত গাড়োয়াল হিমালয়ের শৃঙ্গ সঙ্গে নীচে দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী গঙ্গার বা যমুনার উপনদীগুলি। স্বপ্নের কাছাকাছি এই অঞ্চলে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিকল্পনা প্রায় ১ বছরের। সুগত বসুর নেতৃত্বে আমাদের ১৯ জনের দল ১৮ সালের অষ্টমীর দিন ১৭ই অক্টোবর হরিদ্বারে মিলিত হব। হরিদ্বার গাড়োয়ালের প্রবেশদ্বার বলা যায়। এখান থেকে শুরু করা যায় গাড়োয়াল হিমালয় ভ্রমন। সেই মত বিমানে দমদম থেকে দিল্লী, সেখানে রাতে পৌঁছে পরের দিন ভোরে দেরাদুন শতাব্দী ট্রেনে সাড়েএগারটা নাগাদ হরিদ্বারে পৌঁছলাম। হরির দ্বার মানেই সেখানে ধর্মীয় ভাব থাকবেই। হর কি পউরি ঘাট এর প্রানকেন্দ্র। আমাদের হোটেলের নামও হোটেল হরকিপউরি। একদম ঘাটের পাশে। এছারা আরও অনেক হোটেল ঘাটের আশেপাশে আছে, যেমন "গঙ্গা বেসিন"। শহর এবং হোটেল পরিষ্কার নয় খুব একটা। এখানে সেখানে নোংরা। গঙ্গা লাগোয়া হোটেলগুলির দাম খুব চড়া। স্টেশন থেকে পৌছতে অটো বা টোটো ভরসা। নো এন্ট্রি ভয় দেখিয়ে প্রথমেই অনেক দাম চাইবে, দামাদামিতে কমবে। নিরমিষ খাবার। তবে হৃষীকেশের দিকে রাস্থায় কিছু আমিষ পাওয়া যায়। খাবারের মান খারাপ নয়, দাম বেশী, বেশীরভাগ খাবারের হোটেল পরিষ্কার নয় তবে আমাদের হোটেল পরিষ্কার। জনপ্রতি ১০০-১২০ টাকা লাগবেই এক এক বেলা খেতে। আমরা পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেড়িয়ে পরলাম ঘাট দেখতে। ঘাটে পৌছনোর জন্য ব্রিজ আছে, ব্রিজ থেকে দূরে ঘড়িঘর দেখা যায়। ঘাটে পৌঁছে একটু মাথায় গঙ্গা জল দিলাম। গঙ্গা এখানে স্রোতস্বিনী, কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে চ্যানেল দিয়ে দ্রুত বয়ে চলেছে। দূরে মহাদেবের সুউচ্চ মন্দির। এখানেই বিকেলে আরতি ও পুজাপাঠ হবে। ইচ্ছা হোল "কঙ্খল" যাওয়ার। ২৫০ টাকা অটো ভাড়া করে আমরা ৫ জন চলে গেলাম সেখানে। "কঙ্খল" শহরের দক্ষিণে অবস্থিতঅঞ্চল। এখানে দক্ষেশ্বর মহাদেব মন্দির, সতী কুণ্ড, মা মনসা মন্দির, আনন্দময়ী মায়ের মন্দির। দক্ষেশ্বর আমাদের প্রথম গন্তব্য। এই মন্দিরের পাশদিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এখানে পুজাপাঠের পর বলা হয় স্ত্রী স্বামীর পা ধুয়ে পুণ্য অর্জন করতে। দক্ষযজ্ঞ ঘটনার উল্লেখে নিবেদিত এই মন্দির। পাশেই সতিকুন্ড (বলা হয় এখানেই সতীমা জীবন ত্যাগ করেন) ও মামনসা মন্দির। সেখান থেকে একটু এগিয়ে মাআনন্দময়ী আশ্রম। বাঙালি অধ্যুষিত এই আশ্রমে ঢুকলে মন শান্তিতে ভোরে যায়। 
কঙ্খল থেকে ফিরে আবার গঙ্গার ধারে। খানিক সিগাল জাতীয় পাখির আনাগোনা দেখেই  আসন গ্রহন করতে হল হর কি পৌরি ঘাটের ঠিক উল্টো দিকে। ভালো ভিড় এর মধ্যেই। পূজার সময় গোনা শুরু। উল্টোদিকের ঘাটের সিঁড়িতে বসেপরে প্রথমে গঙ্গাপূজা দেখতে লাগলাম। সাড়ে পাঁচটা থেকে আধঘণ্টা মত পুজাপাঠ হওয়ার পর শুরু আরতি। এর মধ্যে অনেকেই নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন পাতার ভেলায় প্রদীপ। এক স্বর্গীয় অনুভুতি। ১৫ মিনিট ধরে কম করে ১০ জন পুরোহিত গঙ্গামাকে আরতি করলেন। সঙ্গে ঘণ্টা ও স্ত্রোতর শব্দ পরিবেশকে ভাবগম্ভির করে তুলল। লোহার শিকল ঝোলানো আছে, সেগুলো ধরে স্নান করা যায়। কিন্তু আরতি দেখায় প্রধান বাঁধা এগুলি। তবে প্রায় ১৫-২০ মিনিট চলা এই ধর্মীয় আচার মনকে শান্ত ও গম্ভির করবেই। "জয় গঙ্গা মাইয়া" ধ্বনিতে শেষ হওয়ার পর আর বিশেষ কিছু করার ছিল না হোটেলে ফিরে পরের দিনের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া। দুঃখ একটাই, এই ভ্রমণসূচিতে আমরা হৃষীকেশ রাখিনি, তাই রামঝুলা লক্ষণঝুলা অন্য সময়। তবে হরিদ্বারে বা দেরাদুনে দুইদিন থাকলে হৃষীকেশ দেখে আসা সম্ভব। 
ধনৌলটি
গাড়োয়াল সুন্দরী ধনৌলটি এই অঞ্চলের মধ্যে সব থেকে সুন্দর বলেই মনে হয়। সেই উদেশ্যে ১৭ই অক্টোবর সকাল ৮ টায় সবাই হরিদ্বারে ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে মিলিত হয়ে সেখান থেকে টেম্পোট্রাভেলারে চেপে দেরাদুন হয়ে চললাম ধনৌলটি। দেরাদুন পেরতেই চড়াই শুরু।তার আগে রাস্তায় প্রাতরাশ সেরে নিলাম। এখানে ডিম পাওয়া গেলো। ধনৌলটি বিখ্যাত লালিগুরাস বা রডদেন্ড্রন সহ বিভিন্য ফুল ও দিগন্ত বিস্তৃত বরফাবৃত পর্বতমালার দর্শনের জন্য। আমাদের প্রায় চার ঘন্টা সফর জুড়ে উন্মাদনা সঙ্গে নতুন স্বপ্ন বোনা শুরু। পথমধ্যে হনুমানকুলকে বাই বাই করে, অজস্রবার ছবি তুলে আমরা পৌঁছলাম ধনৌলটি ইকোপার্ক সংলগ্ন আওারা ক্যাম্পের ওপরে। এই "আওারা ক্যাম্প" আজকে আমাদের বাসস্থান। রাস্থা থেকে প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট নীচে পর পর তাঁবু খাটানো অঞ্চল নামা ওঠার জন্য একদম মসৃণ নয়। বরং একটু বিপদসঙ্কুল। নামা ওঠার রাস্থা একটু খাঁড়া ও সাবধানে না নামলে স্লিপ করে পড়ে চোট লাগার সম্ভাবনা আছেই। কিন্তু অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত তাঁবুর সাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার পর মজাই আলাদা। ঠাণ্ডা কনকনে। সঙ্গে চারিদিক খোলা থাকায় হাওয়ার দাপট। ১৮০ডিগ্রি খোলা অঞ্চলে পর পর শ্রীকান্ত(6133 m), গঙ্গোত্রীর তিনটি চূড়া(6672 m max), জাওনলি (6630 m), খাতলিং গ্লেসিয়ার ও থায়াল সাগর( 6361 m) দেখা দেবে।
এক ধাপ উঁচুতে এদের রান্নঘর। বুকিং এর সময় আমাদের থাকা খাওয়া ধরা ছিল। পৌঁছেই সুন্দর পানীয় মাধ্যমে স্বাগতম জানালো। অনেকটা নামার কষ্ট এক নিমিষে উধাও। দুপুরের খাওয়া ভালো ছিল। খাওয়া শেষে যে যার তাঁবুতে গিয়ে হাল্কা বিশ্রাম নিয়েই বেড়িয়ে পরলাম বিকেলের দৃশ্য দর্শনে। মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে কেউ কেউ দর্শন দিলেন আমাদের। আমার মনে হল  শ্রীকান্ত, গঙ্গোত্রীর তিনটি চূড়া ও থায়াল সাগরআমাদের দর্শন দিয়েছেন। সোনালি রঙের আবিরের খেলায় মেতে উঠলো দিগন্ত। অবগুণ্ঠন খুলে ধীরে ধীরে স্বপ্নপুরী বানিয়ে ফেললেন হিমালয়। দোলনা খাটানো ছিল। সেখানে বসে দোল খেতে খেতে সূর্যাস্তের পর্বতমালা দর্শন যেন শুরুতেই জানিয়ে দিলো কি হতে চলেছে এই ভ্রমন। এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু আওারা ক্যম্প আমাদের জন্য রাতে আরও একটু নীচে ক্যম্পফায়ার, নাচাগানা আয়োজন করে ওই ঠাণ্ডার রাতকে আরও মায়াবি করে তুলল।     
তাঁবুগুলির সঙ্গে টয়লেট যুক্ত। খুব একটা পরিষ্কার না হলেও সেদিকে আমাদের নজর ছিল না। আমার মেয়ে বউয়ের এই প্রথম তাঁবুতে রাত কাটান। প্রত্যেক তাঁবুতে ৩ টি করে খাট পাতা। রাতে ঠান্ডা ভালই লাগবে। কিন্তু রাত কাটলেই যে দৃশ্য সামনে আসবে তা ভুলিয়ে দেবে সব কষ্ট। উপরে বর্ণিত সব চুড়া খানিখনের জন্য সবার সামনে আবার উন্মুক্ত হল। কিন্তু বিধিবাম। বেশিক্ষণ থাকলেন না। আবার মেঘের আড়ালে। যেন লুকোচুরি খেলা। এদিকে আজকে তেহরি যাওয়ার তাড়া আছে। সঙ্গে আবার উঠতে হবে প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট। তাই প্রাতরাশ সেরে নিয়েই শুরু হল পরের দিনের প্রস্তুতি।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

ধনৌলটি- তেহরি

প্রাতরাশ সেরে আবার ৫০০-৬০০ ফুট চড়াই ভেঙ্গে ওপরে উঠে আসা সহজ ছিল না। বড্ড বুকে চাপ লাগে। উচ্চতা কম হওয়ায় সমস্যা হল না। তবে বয়স্কদের একটু সময় বেশী লাগলো। খাঁড়াই হওয়ায় পা হরকে যাওয়ার ভয় থাকে। ভালো গ্রিপের জুতো পরে আসা অবশ্যক। আমার স্ত্রী কন্যা আগেই দ্রুত উঠে গেলো। মালপত্র নিয়ে চলে গেলো ক্যাম্পের লোকজন। এদের পরিশ্রম কাবিলে তারিফ। আমি মিনিট ১৫ সময় নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। রাস্থার পাশেই গাড়ি রাখা ছিল। সবাই উঠে যেতে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। একটু এগোতেই রাস্থার ধারে পাইনের সারি জানান দিলো এটাই ধনৌলটি ইকোপার্ক। এখানেই পাইনের সারির ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঝলমলিয়ে ওঠে। ব্যাকগ্রাউন্ডে পর্বতরাজী। যেন এক স্বপ্নপুরী।
আবার গাড়ি চলতে লাগলো। প্রায় ঘন্টা তিনেক চলার পর চাম্বা পেরতেই একদিকে একে বেঁকে ভাগীরথী। এখানে বাঁধ আছে। এই বাঁধ তৈরির সময় অনেককে পুনর্বাসন দিতে হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে সেই গল্প শুনলাম। ফলে পুরাতন তেহরি এখন বসবাস অযোগ্য। তাদের নিয়েই একটু ওপরে তৈরি হয়েছে নতুন তেহরি। এখানে একটি ছোট জলের ধারা এসে ভাগীরথীতে মিশেছে। এবং জলাধার মিশ্রিত এক সুন্দর লেকের সৃষ্টি করেছে। জলের গতি বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এখানে ভাগীরথী ধির স্থির। কিন্তু চারিদিকে উচ্চ পর্বতমালা বেষ্টিত হয়ে লেকের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের দলের বেশীরভাগের আজকে থাকার জায়গা হোটেল মানাআর। ১২০০ টাকা রুম প্রতি ভাড়ায় এখানে প্রায় সবাই থাকলেও দুটি পরিবারের জন্য অন্যত্র ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়োয়াল মন্ডলের এখানে সুন্দর কটেজ আছে। কিন্তু ভাড়া কম করে ৫০০০ টাকা। এছাড়া সরকারি পরিকল্পনায় এখানে টুরিসম বৃদ্ধির উদ্যেশ্যে তৈরি হয়েছে ভাসমান কটেজ। সেগুলি লেকের ওপরে তৈরি ভেলায় ভাসমান। পারে যাতায়াতের জন্য নৌকা আছে। দাম? আকাশছোঁয়া। প্রায় ৬০০০ দিন প্রতি দুজনের জন্য। একটু চেপে খরচ করা আমাদের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমরা গেলাম তেহরি বাঁধ কর্তৃপক্ষের হোটেলে। এখানে থাকার রুম পাওয়া মুশকিল হলেও ফাঁকা থাকলে দিয়ে দেয়। আমাদের এক কলকাতার বন্ধুর মাধ্যমে চেষ্টা করেও পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওখানে গিয়ে কথা বলতে দুটি ঘর পাওয়া গেলো। ভাড়া ঘর প্রতি ২৫০ টাকা। সব থেকে সস্থা ও অকল্পনীয়। ঘরগুলি সাজানো এবং একদম নদীর পাশেই। একটু অযত্নের ছাপ আছে। তবে সামনের বিস্তৃত খোলা অঞ্চলে এবং পেছনের ফুলের বাগানের পাশেই ভাগীরথী বহমান ধারা এবং একটু দূরে বাঁধ যেন এক স্বর্গীয় অনুভুতি। খাওয়া এখানে সম্ভব হল না। দশেরার ছুটির কারনে আমাদের খেতে হল হোটেল মানাআরে।হোটেল মানাআর থেকে দৃশ্য একটু আলাদা। অনেকটা পাখির চোখের দৃশ্য এখানে ফুটে ওঠে। কিন্তু দুজায়গা থেকেই সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। 
আমরা বিকেলে গেলাম জলক্রিয়ায়। এখানে বোটে করে ভাগীরথীর এপার ওপার করায়, আধ ঘণ্টা জনপ্রতি ৪০০ টাকায়। এছাড়া ওয়াটার স্কুটার থেকে শুরু করে ভাসমান রেস্টুরেন্ট, সব এখানে উপস্থিত। দাম একটু চড়া এই যা। ছাউনিদেওয়া সাধারণ মটর বোটে লেকতুল্য নদীতে এপার ওপার করে পড়ন্ত সূর্যালোকে মোহময় তেহরি যেন মায়ালোকে পরিণত। এখানে জলকেলি শেষ হতেই একটু দৃশ্য দর্শন করে আবার গাড়িতে উঠে পরা। ঠাণ্ডা পড়তে শুরু সূর্যডোবার সাথে সাথে। তাই অন্ধকারের সাথে সাথে আমাদের কাজ কম্ম সবই ঘরে বন্দী হয়ে গেলো। পরের দিন অনেক কাজ। যাবো উত্তরকাশি। 
উত্তরকাশি 
ঘন্টা ৪ এর রাস্থা কিন্তু আশেপাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভোলাবেই। ভোর ভোর বেড়িয়ে এলাম। চিনিয়ালসর হয়ে ধরাসু বেন্ড দিয়ে উত্তরকাশির হোটেল গঙ্গাশ্রয় আজকে আমাদের গন্তব্য। কিন্তু গাড়ি গতি প্রায় কি করে? চিনিয়ালসরের রাস্থা ধরতেই যেন স্বর্গে প্রবেশ। ধীরে ধীরে সূর্যদেবতার আগমন, ডান দিকে নীচে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, দূরে দেখতে পাওয়াযাচ্ছে গাড়োয়াল মণ্ডলের ভাসমান কটেজ। পাহাড়েঘেরা ভাগীরথীর পাখিরচোখে দৃশ্যায়ন। পূর্বআকাশ রক্তিম। পুরো অঞ্চল্টাই আমাদের সামনে। বাঁকে বাঁকে শিহরন। বার বার গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা আর চোখের আরাম। দেরি হয়ে গেলে উত্তরকাশিতে আমাদের পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানে সমস্যা হতে পারে। তাই একটা তাড়া ছিলই। নাহলে এখানেই থেকে যাওয়া যায় জন্মের পর জন্ম। এই ভাবেই ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম ধরাসু বেন্ড। এখানে রাস্থা দুভাগ হয়ে একভাগ গেছে বারকোট হয়ে যমুনেত্রী বা দেহরাদুন আর একভাগ উত্তরকাশি হয়ে হরসিল এবং গঙ্গোত্রী। আমরা আজকে ডানদিকের উত্তরকাশির রাস্থা ধরলাম। তার আগে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। তবে অপরিস্কারের ধারা এখানেও বজায় আছে। সুলভ সৌচালয়ে প্রবেশ খুবই কষ্টকর।
গাড়ি চলতে শুরু তো করলো কিন্তু আবার গাড়ি থামতে হল। প্রথম একা একা ধরা দিলেন মাউন্ট বান্দরপুঞ্ছ। একটা বাঁক পেরতেই। বাঁদরের লেজের মত বলে এনার নাম বান্দরপুঞ্ছ। তিনটি শিখর নিয়ে দাঁড়িয়ে। ছবি তোলার শত্রু ইলেকট্রিক তারের বাঁধা টপকে মনের মত ছবি হয়ত তোলা গেলো না, কিন্তু চোখের আরাম ষোলোআনা। আবার গাড়ি এগিয়ে চলল। ঘণ্টা চারেক পড়ে প্রধান উত্তরকাশি শহরে প্রবেশ। এখানে প্রায় আধুনিক সুযোগসুবিধা সবই পাওয়া যায়। তবেই এখানেই শেষ। এর পরে সবই কষ্টের। আমরা এখানে প্রথম দাঁড়ালাম কৈলাস আশ্রমে। এখানে পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল আমাদের। সেখানে সাধুসন্তদের "ভান্ডারা" প্রদান করা হবে। সেই মত কয়েকঘন্টার অনুষ্ঠান সমাধা করে অনেকেই লাঞ্চ সেরে নিলেন আশ্রমেই। আশ্রমের পাশেই গঙ্গার ধারা যা ভাগীরথী হিসেবে পরিচিত, বয়ে চলেছে। এর পর আবার প্রায় ৮ কিলোমিটার গাড়ি চলার পর পৌঁছলাম আমাদের আজকের আস্থানা হোটেল গঙ্গাআশ্রয়। এখানে রুমপ্রতি ভাড়া ১২০০। হোটেলটি একদম নদীর ধারেই। এখানে নদী নিচু দিয়েই প্রবাহিত। ১০-২০ ফুট নামলেই জলধারা স্পর্শ করা যায়। রুমের পাশে লনে দাঁড়ালেই দেখা যায় এঁকে বেঁকে নদী এসেই আবার পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গেলো। কয়েকধরনের মাছরাঙার সঙ্গে দেখা হল।
একটু বিশ্রাম নিয়েই চলে গেলাম পাশেই মানুষসৃষ্ট ঝর্না খেঁদি ফলস দেখতে। এটা একটি উপ-জলধারা, যা ভাগীরথীতে এসে মিশেছে, তাকে ব্যাবহার করে সম্ভবত জলবিদ্যুত তৈরি হচ্ছে। জলপ্রপাতের পাশে রামধনু তৈরি হয়েছে। শেষ বিকেলে এখানে পৌছনোর মজাই আলাদা। ফিরে এসে নামলাম নদীর বুকে। জল ভালো ঠাণ্ডা। একে তো বরফগলা, তায় এখানে তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ঠাণ্ডার দাপট। ভোরের দিকে শূন্যের নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। আমাদের স্বপ্নের যাত্রা চালু রয়েছে। পরের দিনে আমার স্বপ্নের গন্তব্য হরসিল। তাড়াতাড়ি রাতের আহার শেষ করেই সারাদিনের ক্লান্তি দূরে করতে বিশ্রামের আশ্রয় নিলাম। তবে তার আগে একপ্রস্থ গানের লড়াই খেলে নিতে অসুবিধা হল না। এই স্বর্গীয় ভুমিতে মন আনন্দে গুন গুন করে উথবেই "এ কাহা আ গায়ে হাম, তেরে সাথ ...।"    

গাড়োয়ালের আলিগলি

উত্তরকাশি গঙ্গাআশ্রয় হোটেল নিঃসন্দেহে ভালো। শহর থেকে একটু দূরে, কিন্তু নিরিবিলি। তবে খাবারের দাম নিয়ে দড়াদড়ি আবশ্যক। নাহলে বেশী দামে কম খাবার। এছাড়া একটা সংখ্যা বা অঙ্কগত সমস্যা এদের দেখতে পাচ্ছি। হিসেবে ভুল করা, সর্বমোট রুটির সংখ্যা নির্ণয়ে ভুল, এবং খাবারের বিল কম বেশী করে ফেলা, এখন অবধি সরকারি বেসরকারি সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। তাই নজর রাখতে হচ্ছে। 

বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা পাখির আগমন সকাল সকাল। ঠাণ্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের সকাল সকাল উঠতেই হবে। সেই মত ৬ টা নাগাদ আবার গাড়ি চলতে শুরু করে দিলো। আজকে যাবো রাজ কাপুরের স্বপ্নের হরসিল। উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফিট। ঠাণ্ডাও জম্পেশ লাগবে। সকালেই ১০ এর নীচে থাকার সম্ভাবনা। এখানে আমাদের থাকার জায়গা গাড়োয়াল মণ্ডলের লজে। গাড়ি চলতে থাকলে আমাদের পাশে পাশে ভাগীরথীও চলতে থাকে। আগের দিন যাওয়া খেঁদি ফলসের একটু আগে উত্তরাখন্ড পুলিশ প্রত্যাক গাড়ির তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। গতকাল একবার তথ্য দেবার পরেও আজকে আবার দিতে হল। কিছুটা সময় নষ্ট। আবার খেঁদি ফলস পেরিয়ে মানেরি বাঁধ পেরিয়ে চলেতে লাগলাম। মানেরি বাঁধের সৌন্দর্য অপরিসীম। তেহরির মত না হলেও খুব সুন্দর। সাধারনের প্রবেশ নিষেধ। তবে আমাদের গ্রুপ ক্যপ্টেনের "ম্যনেজ স্কিলে" ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছিল। ছবি তোলার নয়। মাঝে ভাটয়ারি বলে একটা জায়গায় গাড়ির চাকা ঠিক করানো হল। তেল আগেই নেওয়া হয়েছিল। এর পরে আর গাড়ির সারাইয়ের জন্য বা তেল ভরার আর কোন দোকান পাওয়া যাবে না। 
এই রাস্থার সর্বত্র পর্বত যেন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেখ্যা করে আছে। তাই যেখানে দাঁড়ানো সেখানেই ছবি তোলা আর গাড়ির গতি থাম্মিয়ে বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য আরোহণ আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের দুটি গাড়ি। আমাদের বড় গাড়ি এমনি ধীর তায় আমাদের অত্যাচারে গতি তোলার ক্ষমতা নেই। পেছনের ছোট গাড়ি দেরি করে বেরিয়েও আমাদের সঙ্গেই পৌঁছে যেতে থাকল। তাই মাত্র ৬৭ কিলোমিটার হরসিল পৌছতেও কম করে ৪ ঘন্টা লেগে গেলো। 
ভাগীরথী একটু ডান দিকে মোচর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে এই ভাবে একটা সুন্দর উপত্যকা বানিয়ে ফেলবে হরসিলে গাড়ি থেকে নেমেও কল্পনা করতে পারি নি। কারন সেনা বাহিনীর ক্যাম্প পেরিয়ে, ছোট নদীর ওপর দিয়ে এগিয়ে হরসিল গ্রামে প্রবেশ করার পর্যন্ত চারিদিকে বরফপড়া পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিলো ঠিকই কিন্তু ভাগীরথী দেখতে আমাদের হরসিল গাড়োয়াল মন্ডলের লজ অবধি যেতেই হত। মালপত্র বয়ে নিয়ে আসার জন্য কুলির ব্যাবস্থা করেই ঘরের দাবী পেশ করার মত বাজে কাজ গুলি আমাকেই করতে হল। কারন আমার নামেই অনলাইনে বুকিং ছিল। সেই কাজ ঝটাপট মিটিয়ে, আমাদের ঘরে মালপত্র প্রবেশ করিয়ে আমি ছুটলাম লজের লনে। সেখানে চমক। ঘরে বসে সব পাওয়া যাবে না। সামনের দিকের ঘর গুলি বা ওপরের ঘরগুলি থেকে কিছু দৃশ্য পাওয়া গেলেও বেশীরভাগ ঘরেই দৃশ্য নেই। তবে লনে জায়গায় জায়গায় কাঁচ ঘেরা ঘর কম করে দুটি। বসে আড্ডা মারা ও সঙ্গে ভাগীরথী দর্শন। সাথী হিমালয়ের কিছু বরফাবৃত চুড়া, যাদের নাম নেই আর কিছু নামী চূড়া, যেমন বান্দরপুঞ্ছ(আগে দেখেছি), শিভলিং, সুনদর্শন। একটু যেন কম কম বরফ। গলে গেছে হবে। কিন্তু প্রকৃতি দেবী একটু বেলা বারতেই মেঘ নিয়ে এসে সেই খামতি মিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা দূর থেকে সেই হোয়াইট ওয়াশ দেখতে লাগলাম। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ভাগীরথী এঁকে বেঁকে, লজের সীমা চুম্বন করে, দূরের পাহাড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। নদীর উচ্চ গতি। ফলে স্রোত ভয়ানক বেশী কিন্তু জল কম। নদীর ধারে অসংখ নুরি পাথর আর পাখির সমাহার। লালঝুটি থেকে সাধারণ বুন পায়রা, উপস্থিত সবাই। কারন? নদীর ধারে ভেসে আসা আপেলের সারি। এবছর আপেলের চাষ ভালো হয়েছে। এখানে আপেলের চাষ হয়। লজের নিজস্ব গাছে আপেল পেরে খেতে আপত্তি নেই, কিন্তু গ্রামের মানুষের ফল পারা যাবে না। আপেলের দাম ২০ টাকা প্রতি কেজি। কল্পনা করা যায় আমাদের শহরে? 
হরসিল বলিউড খ্যাত। গল্প শুনেছি রাজ কাপুর সাহেব হরসিলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বানিয়েছিলেন রাম তেরি গঙ্গা মেইলির মত সিনেমা। যার বেশীরভাগ এখানেই শুটিং। মন্দাকিনীর নামে একটা ঝর্নার নাম ও আছে, কিন্তু খুঁজে পেতে একটু কষ্ট। তিনি কেন মুগ্ধ হয়েছিলেন তা এসেই বুঝতে পারছি। চারিদিকে বরফ সাদা পাহাড়ের মাঝে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া ভাগীরথীর গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আপেলের গাছের সাড়ি নিয়ে অবস্থান করা এক অপূর্ব উপত্যকা এই এত্ত উঁচুতে।
  গল্প আছে, এক ইংরেজ সাহেব সিপাহী বিদ্রোহের সময় সমতল থেকে পালিয়ে তেহরি মহারাজের আশ্রয় চান। মহারাজ আশ্রয় না দিলে তিনি এই হরসিলের গ্রামে লুকিয়ে থাকেন। বিয়ে করেন এক স্থানীয় ভদ্রমহিলাকে। তারপর তাদের আপেলের চাষের উপায় বাতলে ও গাছের গুঁড়ির ব্যাবসা করে ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে যান রাজা। পত্তন করেন এই জনপদের। লোক মুখে এই কথাই ঘোরে। এখানে বেশীরভাগ মানুষ গাড়োয়ালী হলেও কিছু নেপালি মানুষ আছেন। বেশীরভাগ কুলিরা তাই হন। 
মালপত্র ঘরে ঢুকিয়ে ক্যমেরা নিয়ে নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। নামা যেত। তবে অপরিস্কার থাকায় ও আমার ব্যালেন্স খুব ভালো না হওয়ায় নামিনি। তবে চোখ ভরে দেখে নিয়েছি প্রকৃতি। বেলা বারতেই হু হু করে হাওয়ার দাপট। মেঘে ভরে গেলো আকাশ। মাঝারী বৃষ্টি শুরু হল। আশা জাগল যদি বরফ পড়ে। এই বৃষ্টিতে ভেজা উচিত নয়। এখানে প্রকৃতি এখন এরকমই। সকালে পরিষ্কার, বেলা বাড়তে থাকলে মেঘ এসে হাজির হবে। তার পর বৃষ্টি হয়ে আবার রাতের দিকে পরিষ্কার। আজকে একটু বেশীসময় বৃষ্টি হল। যেন আশেপাশের সবুজ পাহাড় স্নান করে আরও সুন্দর হল। ফাঁকা থাকায় হাওয়ার দাপট খুব বেশী ছিল। ফলে ঘরবন্দি। সন্ধের আগে ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকল। আর চোখের সামনে দেখতে পেলাম সামনের উচ্চ শৃঙ্গগুলি আরও সাদা। অনেক নীচে পর্যন্ত বরফ পড়েছে। তবে আমাদের কপালে জুটল না। তবে মাউন্ট সুদর্শনের দিকটা অন্ধকার না হওয়া অবধি পরিষ্কার হল না। চাঁদ উঠেছে। তবে মাথার ওপরে। লজের আলোয় আলাদা করে খুব বেশী না হলেও সামান্য সামান্য দেখা যেতে লাগলো। কলকাতার সংস্থা ওয়েদার আল্টিমা আসার আগে আমাকে বলে দিয়েছিল যে এই সময় পশ্চিমী ঝঞ্জার কারনে হরসিল গঙ্গোত্রীর মত উঁচু অংশে বৃষ্টি থাকবে, বরফ পড়তে পারে। তাই আশায় বুক বাঁধলেও শেষ মেশ হতাশ হলাম। রাতের ঠান্ডা ভয়ংকর। শূন্যের কয়েক ডিগ্রী নীচে। বাঁচোয়া যে রুমের হিটার চালু করা গেছিল ও বিদ্যুতের সমস্যা হয় নি। না হলে কি হত পরের দিনের গল্পে পড়ুন। রাতে আজকের মেনু ছিল মটন। আর একটি খবর যা শুনে এসেছিলাম, মিলল না। শুনেছিলাম এই রাস্থায় কোথাও আমিষ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হরিদ্বার ছাড়া প্রায় সর্বত্র কম করে ডিম পেয়েছি। দেখা যাক সামনে কি পাওয়া যায়। চিকেন তো পাওয়া যাচ্ছেই। এখানের রান্নার স্বাদ খুব ভালো। তবে সেই লোক কম থাকার সমস্যা আছেই। ফলে ঘর পরিষ্কার থেকে খাওয়া সবেতেই দেরি হচ্ছে। 
আমার হরসিলে দু রাত থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনায় এক রাত। ঠাণ্ডায় কষ্ট করে একরাত কাটিয়ে দেওয়া যায় শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখানে প্রকৃতি যেন একটু বেশী সুন্দর সেজেছে। বৃষ্টি না হলে হয়তো গ্রাম ঘুরে দেখতাম। তবে পরের দিন সকালে উঠে বেড়িয়ে পরার তাড়ার মধ্যেও সকালের পরিষ্কার আকাশে আরও কয়েকবার উপত্যকার সৌন্দর্য আহরন করে নিতে ভুলি নি। আবার কবে আসব কে জানে আমার এই স্বপ্নপুরিতে।   

গাড়োয়ালের আলিগলি

গাড়োয়ালের আলিগলি যেন এক স্বপ্নের শুরু শেষ আর এক স্বপ্নের উৎপত্তি। আমরা তুষারপাত পেলাম না। এই গল্প লেখার সময় হরসিলে ভালো তুষারপাত হয়েছে বলে শুনতে পেলাম। বিধি বাম। তবে তুষারপাত হলে পরিষ্কার সকাল উপভোগ করা যেত না। আজকেও সকাল ৭ টা নাগাদ বেড়িয়ে পরলাম গঙ্গোত্রীর দিকে। বেশী রাস্থা নয়, ঘণ্টা খানেক। কিন্তু আমরা থেমে থেমে যাবো বলে একটু তাড়াতাড়ি বেরচ্ছি প্রত্যেকদিন। আর থামবো নাই বা কেন? এক এক মোর ঘুরতেই বরফ সাদা পাহাড় চূড়া এসে আমাদের দৃষ্টি স্বার্থক করে দিচ্ছে। আজকেও ব্যাতিক্রম নয়। একটু এগোতেই মাউন্ট শিবলিঙ্গ, সুদর্শন এনারা দেখা দিতে লাগলেন। যেন ডেকে নিয়ে যেতে চান। কালকে রাতে ঠাণ্ডার ধাক্কা এখনো সহযাত্রীরা সামলাতে পারেন নি। তাই গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলার লোক আজকে ২-৩ জন। বাকিরা গরম গাড়ির ভেতরেই। কাল রাতের উষ্ণতা শূন্যের বেশখানিক নিচেই ছিল। বেরনোর সময় জমে থাকা জল জেলি বা সাদা সাদা হয়ে যেতে দেখেছি। যাকে গ্রাউন্ড ফ্রস্টিং বলে। আজকে সকালেও সেই ঠান্ডা কমার কোন লক্ষন নেই। উলটে আজকে রাতে আরও বেশী ঠাণ্ডা পড়বে। তবে কি বরফ পাবো? 
 অচিরেই আমরা গঙ্গোত্রী মন্দিরের থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের গেটে এসে পৌছলাম। এখানেই গাড়ি থেমে যাবে। আর এগোনর অনুমতি দেবে না উত্তারাখন্ড পুলিশ। আবার কুলি নিয়ে মালপত্র নিয়ে যেতে হবে। খরচ পড়বে ১১০ টাকা প্রতিবার প্রতিকুলি। এখানেও আমাদের গাড়োয়াল মন্ডলের গেস্টহাউস নেওয়া আছে। পাঠক এখানে মনে রাখবেন দুটি   গাড়োয়াল মন্ডলের ব্যাবস্থাপনায় থাকার জায়গা আছে। একটি একদম গঙ্গোত্রী মায়ের মন্দিরের লাগোয়া ছোট, অন্যটি বড় ও ৫০০ মিটার দূরে, নদীর অন্যপ্রান্তে। আমাদের বড় প্রধান  গেস্টহাউস বুকিং ছিল। খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। তবে একটু দূরে এই যা। নদীর ওপরে তৈরি ব্রিজ পেরতে হবে এবং একটু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তবেই  গেস্টহাউস পৌঁছন সম্ভব। বয়স্কদের অসুবিধা হওয়ার কথা। তবে সারা হরসিলে মোবাইলে বি এস এন এল ছাড়া কারো সংযোগ ছিল না। গঙ্গোত্রী পৌছতে আমার এয়ারটেল কাজ করতে শুরু করলো। আমাদের দুটি পরিবারের জন্য একটি রুম ব্যাবস্থা হয়েছে। তাকে এফএএম বা ফ্যামিলিরুম নাম দিয়েছে। ভাড়া ১৬০০ মত। অন্যদের প্রত্যেক পরিবারের ডিলাক্স রুম। ডিলাক্স রুমে প্রাতরাশ বিনা পয়সায়। রুম থেকে কোন পর্বত দেখতে পাওয়া যায় না, কিন্তু সামনের লনে এলেই কেদার ও সুদর্শন হাজির রুপের ডালি নিয়ে।  গেস্টহাউসটি এত সুন্দর জায়গায় যে ডান দিকে এগোলেই কয়েক পা গেলেই সূর্য কুন্ড নামের ঝর্না। যেখানে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা ভাগীরথী নীচে নেমে আসছে। আর এক প্রান্তে সীতাকুণ্ড। সেটিও তাই। 
পুরাণ অনুসারে সগর রাজার ৬০০০০ সন্তান কপিলমুনির অভিশাপে ভস্ম হয়ে গেলে তাদের পুত্র ভগিরথ, তপস্যা বলে মা গঙ্গাকে মর্তে আগমন ঘটান। সেই পুণ্য গঙ্গার স্রোতে ৬০০০০ সন্তানের ভস্ম ধুয়ে যাওয়ায় তাদের মুক্তিলাভ ঘটে। এই গঙ্গোত্রীতেই মা গঙ্গার মর্তে আগমন। এখানে ভাগীরথী নামে পরিচিত ভগিরথের নাম অনুসারে। প্রয়াগে আলকানন্দার সঙ্গে মিশে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হন। কিন্তু তেজী মা গঙ্গার স্রোত ধারা মহাদেবের জটায় ধারন ছাড়া মর্তের বিনাশ আটকানো সম্ভব ছিল না। তাই মনে করা হয় এই সূর্যকুন্ডে মহাদেব গঙ্গামা কে জটায় ধারন করেন। পবিত্রভুমি গঙ্গোত্রী তাই ছোটা চারধাম। বিজ্ঞান বলছে অনেক আগে গঙ্গোত্রী হিমবাহ গঙ্গোত্রী পর্যন্ত ছিল। ধীরে ধীরে গোমুখ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। এখন আরও পিছিয়ে গেছে। যার নাম গোমুখ -২। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ, গোমুখ -২ ট্রেক করে যাওয়া যায় বা ঘোড়ায় চড়ে। হেঁটে গেলে ৩ দিন মত লাগবে -১ পর্যন্ত। এছাড়া ভাগীরথী, কেদারতাল, প্রভৃতি অনেক রকমের অভিযান এখান থেকেই যেতে হয়। এর পরে আর গাড়ি যায় না।   
রুমে মালপত্র রেখে কুলিভাড়া মিটিয়ে আমরা এগলাম গঙ্গামায়ের মন্দির দর্শনে। সূর্যকুন্ডে রামধনু দেখা যায়। কিন্তু আজকে অদৃশ্য। সূর্যকুন্ড থেকে মাউন্ট সুদর্শন দেখে ছবি তুলে আমরা এগলাম মন্দিরের দিকে। এক কিলোমিটারের কম রাস্থা পেরিয়ে, ভাগীরথী নদীর একটি ধারা পেরিয়ে প্রধান ধারার ওপরের ব্রিজে পৌছনোর আগে ভাগীরথী শিলা। মনে করা হয় এখানেই ভগিরথ শিবের তপস্যা করেছিলেন। তারপর ব্রিজ পেরিয়ে মন্দির। মন্দিরে প্রধান বিগ্রহ গঙ্গামাইয়া। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে এখানে পূজা দেন। আমিও ব্যতিক্রম নই। জল মাথায় দিলাম। ভালো ঠাণ্ডা, কিন্তু কেমন যেন সহ্য হয়ে গেলো। ওখানে ছোট ছোট ১০০ মিলির বোতল বিক্রি হয়। ১০ টাকায় কিনে জল ভরে নিলাম। বড় বোতল ছিল। কিন্তু লাগেজের ভয়ে নিলাম না। পুজর প্রসাদ খই ও নকুলদানা। ভক্তিভরে খেয়ে নিলাম। ইতিহাস মতে মন্দির তৈরি করেন নেপালি জেনারেল অমর সিং থাপা। নদীর এঁকে বেঁকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এক পাশে মন্দির। মন্দির উঠানে দাঁড়ালে উল্টোদিকে মাউন্ট সুদর্শন উপস্থিত সঙ্গে কেদার। যেন পাহারা দিচ্ছেন। অপরুপ দৃশ্য। একটু থেকে বেড়িয়ে এলাম। এবার ফেরার পালা। এক পথে ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম বনবিভাগের রেস্টহাউস এখানেই আছে। একটু আগে। ফিরে এসেও থেমে গেলাম না। দুপুরের খাবারের একটু দেরি আছে। তাই বেড়িয়ে পরলাম দেড় কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া পান্দব গুহা দেখতে। প্রথম দিকে ভালো চড়াই উৎরাই থাকলেও শেষের দিকে প্রায় সমতল রাস্থা দিয়ে দেড়কিমি থেকে একটু বেশী রাস্থা হেঁটে যেতে ভালই লাগে। জঙ্গলের ভেতরে গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাখির ডাক শুনে এগিয়ে চলা। নীচে দিয়ে বয়ে চলা ভাগীরথীর গর্জন। শেষের দিকে বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু পৌছে গেলাম। একটা বড় পাথরের ভেতরে ছোট গুহায় কয়েকজন সাধুর বসবাস। রান্নার ধোঁয়ায় এমনি ভেতর বড্ড কষ্টকর। রাস্থার সৌন্দর্যের সঙ্গে এখানের তুলনা চলে না। তাই একটু হতোদ্যম হয়েই ফিরে চললাম। সর্বত্র ফেরার সময় কম লাগে। এবারেও তাই। তার মধ্যে গেস্ট হাউসে থেকে যাওয়া সহযাত্রীদের ফোন, আরও গতি বাড়াতে সাহায্য করলো। দুপুরের গরম গরম নিরামিষ খাবার ডাকছে। ২০ মিনিটে ফিরে এলাম। এসেই খিদে পেটে গোগ্রাসে গিলে তো নিলাম। কিন্তু খাবার পর থেকেই ঠাণ্ডা লাগতে লাগলো বেমাক্কা। হাঁটাচলার জন্য যে গা গরম হয়েছিল তা কিছুক্ষনেই ঠাণ্ডা হয়ে শরীরের হারগুলি ঠোকাঠুকি করতে লাগলো। যেন সহ্য ক্ষমতা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত। সূর্য ডুবতেই উষ্ণতা একদম নিশ্চিত শূন্যের নীচে। ওদের অফিসরুমের বাইরে লাগানো থার্মোমিটার জানা দিচ্ছে -২ ডিগ্রী এখনি। রুমহিটারে
খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেলো না। নিয়েও লাভ হত না। সারাদিন বিদ্যুতের দেখা নেই। সন্ধের পর থেকেই জেনারেটরে ১১টা অবধি আলো জ্বালিয়ে রাখলেও তারপরে অন্ধকার। তার মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়েপরা ছাড়া আর কোন কাজ করার উপায় নেই। সেই সঙ্গে কনকনে হাওয়া। বরফের পাহাড়গুলো খুব কাছে হওয়ায় ঠান্ডা মাত্রারিক্ত। রাতের উষ্ণতা -১০ এর কাচকাছি ছিল। কারন পরের দিন সকাল সকাল ছবি তুলেই পালিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। ৬ টা নাগাদ সব তোরজোড় করে বেড়িয়ে আসার সময় উষ্ণতা দেখা গেলো -২। ফলে তারাহুর করে বেড়িয়ে পরলাম। আজকে যাবো বারসু। প্রসঙ্গত বলে রাখি গঙ্গোত্রীর উচ্চতা ১০ হাজার ফুটের একটু বেশী। সাধারণত শ্বাস নিতে অসুবিধা না হলেও, উত্তেজনা, ক্রোধ ইত্যাদি করলে শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই পারে। দরকারে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হবে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে চকলেট বা গা গরম রাখার খাবার খাওয়া প্রয়োজন। তবে নিরামিষ একমাত্র ভরসা হওয়ায় মাংস অমিল। ওতেই মানিয়ে নিতে হবে।
 চলবে

বারসু।

--------------------------
ইচ্ছাছিল বা বলাযায় প্রায় নিশ্চিত ছিলাম বরফ পড়বে, অথবা বরফ পড়ে থাকবে, কিন্তু বিধি বাম। গঙ্গোত্রীতেও তুষারপাত দেখা হল না। তবে সুগতদা চিন্তিত ছিলেন যে বরফ পড়লে ঠাণ্ডায় আমাদের আরও কষ্ট হবে। সঙ্গে প্রাকৃতিক যে দৃশ্য আমরা দুচোখ ভরে গিলছি, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল অন্তত এই অভিজ্ঞতা হয়ে যাক। ব্যাজার মুখে গাড়িতে চলতে লাগলাম। প্রায় এক রাস্থায় নেমে আসতে হবে ভাটয়ারি পেরিয়ে গংনানি অবধি। গংনানির একটু আগে ডান দিকে রাস্থা উঠে যাবে। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার মত গেলেই বারসু গ্রাম। বারসু গ্রাম হল দায়রা বা দরিয়া বুগিয়ালের বেস ক্যাম্প। এখানে সবাই ট্রেক করতেই আসে। কিন্তু আমাদের দলে সেই লোক হাতে গোনা ৪-৫। তাই ট্রেক নয়, আমরা সৌন্দর্য দেখতেই এসেছি।
   গংনানির পর বারসুর রাস্থা ওপরে উঠতেই চোখের সামনে হই হই করে চলে এলো একের পর এক সাদা শৃঙ্গ। কেউ কেউ নাম করা যেমন কেদার, কেউ অনামি। সদ্য কাল রাতে বরফ পড়ে সাদা হয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থাৎ সেই আমাদের গাড়ির গতি রুদ্ধ হয়ে গেলো। আজকে মোট যাওয়ার ছিল ৪০ কিমি মত। তার শেষ ১০ কিমি আমাদের ছবি তোলার ধুমে যেতে লেগে গেলো প্রায় ১ ঘন্টা। লাগবেই না কেন। এক এক বাঁকে এক এক শুভ্র হিমশীতল চূড়া আমাদের অভ্যর্থনা করছে যে। না নেমে উপায় কি? আমাদের গাড়ি হিমাচল থেকে আনানো হয়েছিল। স্থানীয় নন। তবে তার কোন অসুবিধাতো হইয়নি, বরং আমাদের খুব পরিচিত যোগরাজ ভাই যেখানে যেমন খুশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে সাহায্য করেছেন। স্থানীয় চালক কেপির থেকে অনেক ভালো। হয়তো দ্রষ্টব্য স্থান আমাদের খুঁজে নিতে হয়েছে, কিন্তু কোনওসময় তাড়াহুরো করেননি। ফলে ক্যামেরা ভরে ভরে ছবি এসেছে বাড়িতে।
  আমরা পৌঁছলাম গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউসে। এই প্রথম গাড়ি একদম রেস্ট হাউসের সামনে আমাদের পৌঁছে দিতে পারলো। অন্যগুলির মত এরও ঘর থেকে কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য সেভাবে নেই। তবে ঘর পরিষ্কার যতই পুরনো হোক। রান্নাও ভালো। বিপদ হতে পারত। অন্যসব রেস্ট হাউসগুলির মত এখানে আমাদের আগমনের অগ্রিম খবর সরকার এনাদের পাঠায় নি। ফলে আমাদের আগে কোন ট্রেকারদল এসে গেলে আমাদের ঘর তাদের হয়ে যেত। এখানে প্রধান আবাসের মোট ৭ টি ঘর ও সুন্দর তাঁবু সদৃশ দুটি ঘর নেওয়া হয়েছে। তাঁবুগুলি থেকে সরাসরি দূরে বরফ চূড়া দেখা যায়।
  আসার পথে ভাটয়ারির আগে প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিলাম। ভারি খাবার খেয়েছিলাম। আমাদের একটা উদেশ্য ছিলই। যেখানে যা খাবার পাওয়া যাবে, পেট ভরে খেয়ে নাও, আর যেখানে প্রথম তুষারশৃঙ্গ দেখা যাবে, ছবি তুলে চোখ ভরে দেখে নাও। দুখেত্রেই পরে আর নাও পেতে পারো। আজকে সেই মন্ত্র কাজে দিলো। এদের খাবার পরিবেশনে একটু দেড়ি হল। তৈরি ছিল না যে ১৯ জনের দল এখানে আসবে। তবে মানুষজন খুব ভালো। যথাসাধ্য সাহায্য করা এদের ধর্ম। সুন্দর প্রকৃতির মানুষ সুন্দর।
 আসে পাশে জঙ্গল আছে। একটু দূরে উঁচুতে ভোলানাথের মন্দির। দলের কয়েকজন সেখানে ঘুরেও এলেন। আমরা দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় দেখতে লাগলাম আর রোদ গায়ে লাগাতে লাগলাম। এখানে ঠাণ্ডা দশের (যেদিন কলকাতায় শীতলতম দিন হয়, সেদিন দশের আশেপাশে থাকে তাপমাত্রা) আশেপাশে থাকলেও গঙ্গোত্রী হরসিলের পরে এখানে সেভাবে লাগছিল না। ফলে লেপের তলায় ঢুকতে সবার আপত্তি। বিকেলে চায়ের আসরে শুনলাম এখানে অনেক ছায়াছবির শুটিং হয়েছে। তবে বেশীরভাগ নেপালি ছবি। শুটিং শেষ হলে জায়গাটা নেপাল দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে ছবিতে। ক্যন্টিনের ইনচার্জ আমাদের গল্প শোনালেন এসব। এখন অবধি যেখানে যেখানে গেছি, আমার মনে হয় সর্বত্র শুটিং করাই যায়। কেন এখনো হলিউড এখানে পদার্পণ করেনি সেটাই বিস্ময়।
  বিকেলে আকাশ মেঘাছন্ন হয়ে পরেছে। ঠান্ডাও শূন্যের নীচে নেমে যেতে লাগলো রাত বাড়তেই। তবেকি বরফ পরবে? এর মধ্যে শুনতে পেলাম সব থেকে দুঃখের খবর। আমাদের দলের এক সদস্যের পরিচিত কয়েকজন আজকে গঙ্গোত্রী গেছেন। গেছেন ঠিক, কিন্তু থাকতে পারেন নি। কারন? তুষারপাত। আমরা বেরনোর কয়েকঘন্টা পরেই শুরু হয়েছে তুষারপাত। সেনাবাহিনী সব গাড়ি কম করে দশ কিমি নীচে নামিয়ে দিয়েছেন। হায় কপাল। কয়েকঘন্টার তফাতে আমি জীবনের প্রথম তুষারপাত মিস করলাম। ভাগ্যে ছিল না, বা অন্যভাবে ভাগ্য ভালো ছিল। কারন বরফে রাস্থা আটকে পড়লে আমাদের নামা মুশকিল হয়ে যেত, থাকা মুশকিল হত। এর পর দুঃখীমন নিয়েই রাতের নিদ্রা। ব্যাবস্থা ভালই। এখানে তিনটে বেড ছিল। ফলে আমাদের শুতে অসুবিধা হয় নি। অতিরিক্ত টাকা দিতেও হয় নি।
 সকালে মন ভালো হয়ে গেলো। কালকের বরফ ঢাকা এবং নেড়া সব পাহাড়গুলি রাতে অনেক অনেক বরফ পড়ে একদম সাদা। যেন আইসক্রিম। খুশির শেষ নেই। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে তুলতে বুঝতে পারলাম এদের দূরত্ব খুব বেশী নয়। এমনকি বরফ শেষ যেখানে পড়েছে তার থেকে এই বাড়ির দূরত্ব সামান্যই। অর্থাৎ সেই হরসিলের মত আবার কাছে এসেও এলো না। আমরা বেড়িয়ে পরলাম সকাল সকাল। আজকে উত্তরকাশি হয়ে বারকোট যাবো। উত্তরকাশিতে সময় লাগবে, এবং রাস্থাও অনেক। তাই ৭ টায় বেড়িয়ে পরা ছাড়া উপায় নেই। তখন সবে পাহাড়ের মাথায় ধীরে ধীরে সূর্যের আলো এসে পৌঁছেছে। অপূর্ব বরফ ঢাকা পাহাড়গুলি যেন ঝলসে উঠছে। ঘোড়ায় চড়ে দিনের কাজে বেড়িয়ে পরেছেন গ্রামবাসীরা। কালকে রাতে পরিচিত হওয়া এক বাঙ্গালি ভদ্রলোক তার গাইড নিয়ে দরিয়া বুগিয়াল চলে গেলেন। আমরা গংনানি হয়ে উত্তরকাশি নেমে আসতে লাগলাম।   

উত্তরকাশিতে আবার

-------------
এক রাস্থায় ফিরতে হবে বলে , কাশিতে বিশ্বনাথ মন্দির ফেরার পথে রাখব ঠিক ছিল। সেই মত ৯টা নাগাদ এখানে পৌঁছে মন্দির দর্শনে গেলাম। মন্দিরে শিব ও শক্তি। আগে শক্তির পূজা করে চলে গেলাম শিবের মন্দিরে, পাশাপাশি। বলা হয় গঙ্গার ধারা যেখানে উত্তরবাহিনী, অর্থাৎ সাধারণ নদীর তুলনায় একটু অন্যমুখি, সেই সব পীঠস্থান কাশি নামে পরিচিত। যেমন বরানসী, উত্তরকাশি, গুপ্তকাশি প্রভৃতি। এখানে হিন্দু ধর্মের জ্ঞ্যান লাভের চর্চা হয়। প্রচুর সন্যাসি এখানে থাকেন ও বেদের জ্ঞ্যানলাভ করেন ও প্রদান করেন। এখানে ভাগীরথী তেজী কিন্তু জলের ধারা এখন শরু। মন্দিরে আমাদের পূজা ভালমতই সম্পন্ন হল। মনে শান্তি এলো। শিবের দর্শন না পাওয়া পর্যন্ত আমার মন খুতখুত করছিল। এখানে এসে যেন প্রায় সম্পূর্ণ। এরপর বাকি শুধু যমুনেত্রী। এখানে প্রাতরাশ সেরে শহর ঘুরে দেখতে লাগলাম। সবরকম আধুনিক সুবিধা প্রায় সমমুল্যে এখানে পাওয়া যাচ্ছে দেখতে পেলাম। এরপরে আর পাওয়া যাবে না আগেই লিখেছিলাম। গাড়ি সারাই হয়ে চলে এলো। আমরা উঠে বসলাম, ধারাসু বেন্ড যাবো, সেখান থেকে নতুন রাস্থায় বারকোট।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

-------------------------------
উত্তরকাশি থেকে বেড়িয়ে একটু দ্রুত এগোতে লাগলাম। কিন্তু ধরাসু বেন্ডে এসে আবার দাঁড়িয়ে পরতে হল। সামনে গাড়ির সাড়ি জানান দিলো ধস নেমেছে। খুব বড়সড় নয়। ঘন্টা খানেকের অপেখ্যা। আবার গাড়ি ধরাসু বেন্ড পেরিয়ে এবার নতুন রাস্থা নিল। ফেলে আসা তেহরির দিকে না গিয়ে ডান দিকে ঘুরে আবার চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গাড়ি চলতে লাগলো। এখানে সাধারণ পার্বত্য পথ। সেভাবে কিছু দেখার নেই। একজায়গায় মন্দিরে শিবের উপাসনা হয়, গুম্ফা আছে। ব্যাস আর কিছু নেই। বিরক্তির ঘন্টা ২ চলার পর আমরা পেয়ে গেলাম বারকোট বেন্ড। প্রধান বারকোট শহর আমাদের সামনে আসবে যখন আমরা মুসৌরির দিকে যাবো। কিন্তু আমরা ডান দিকে ঘুরে যমুনেত্রীর দিকে যাবো। তাই ফেরার পথে প্রধান শহর পাবো।
এই বেন্ডে আমাদের আজকের ঠিকানা হোটেল আদিত্য প্যালেস । প্যালেস শুনে চমকে যাওয়ার নেই। ভাড়া মাত্র ৭০০। রুম বা সমগ্র হোটেল কখনোই মনে হয় নি অন্তত প্যালেস। হটাত উঠে দাঁড়ানো শুরুতেই শেষ, দোতলা আবাস। তবে ঘর খুব সুন্দর ওপরেরগুলি। নিচেরগুলি একটু ছোট। তাই কথা বলে ভাড়া কমিয়ে ৫০০ করা হল। এখানে এক রাত থেকে দূর থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা পরের দিন ভোরে উঠে জানকীচট্টী যান। সেখান থেকে ট্রেক করে যমুনেত্রী মন্দিরে পূজা দিয়ে আবার রাতের আগেই বারকোট ফিরে আসেন। জানকীচট্টীর হিমশীতল পরিবেশ থেকে এর ফলে বাঁচা যায়। আমাদের উদ্দেশ্য তাই। ৫-৬ ঘন্টার পথ পেরিয়ে বিশ্রাম নেওয়াই উদ্দেশ্য। একটু দূরে নদীর পারে তাঁবু করে থাকাই যেত। কিন্তু পকেট অনুমতি দেয় নি। সেখান থেকে যমুনেত্রী হিমবাহের পাহাড়ের দেখা মেলে।
এই বারকোটেই আমাদের আধার কার্ড দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হল। তবে দুপুরের খাওয়ার পরে। ছবিও তুলে রেখে দিলো। একটি পাস জাতিয় কাগজ প্রত্যেককে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। যদিও কোথাও কাজে লাগে নি। তবে দেখানোর দরকার পরলে বা বিপদে কাজে লাগবে। এখানে ঠাণ্ডা অনেক কম। উচ্চতাও অনেক কমে গেছে। কাল প্রায় ৩০০০ ফুট আবার উঠবো গাড়িতে। তবে দুপুরের বৃষ্টি আমাদের পিছু ছাড়েননি। বৃষ্টি হয়ে একটু ঠাণ্ডা বাড়িয়ে দিলো। না হলে আমি গায়ে গরম জামা ছাড়াই ঘুরছিলাম।
 পরের দিন ভোরে উঠে পরলাম। ৫ টায় বেড়িয়ে পরলাম। কারন অনেকেই যমুনেত্রী মন্দিরে যাবেন। কেউ কেউ ঘোড়ায়, কেউ হয়তো হেঁটে। একটু এগিয়ে দুটো বাঁক নিতেই চমক। যমুনেত্রী হিমবাহের সঙ্গে আরও নাম না জানা দু একজন হাজির রুপের ডালি নিয়ে। এ যেন শেষ না হওয়া রুপকথা। ঘন্টা ৩ গাড়িতে থাকার পর আবার ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে গেলাম হনুমানচট্টী। এখানেও অনেকে থাকেন। এখান থেকেও হেঁটে যান। গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউস এখানেও দেখলাম। কিন্তু আমরা শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাবো। একটু চা খেয়ে পুলিশের তল্লাশি পেরিয়ে আমরা এসে গেলাম জানকীচট্টী। এটা যমুনেত্রীর বেস ক্যাম্প। এখানেও আমাদের গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউসে বুকিং। কিন্ত এই প্রথম ঘর নিয়ে ধাক্কা খেলাম। ম্যনেজার নেই। একজন কেয়ারটেকার। একটু বয়স্ক। আমাদের ৯টা রুম দেখাতে দেখাতে হাঁপিয়ে উঠলেন। তায় আমাদের দুটো ঘর পছন্দ না হওয়ায় ইকো থেকে ডিলাক্স রুমে পরিবর্তন করে নিলাম। বাকি ঘর গুলি আশ্বাস ছিল ১২ টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তবে প্রত্যেক রুম দুইজনের হলেও অতিরিক্ত একটি খাট আছে। আমাদের সমস্যা হল না। এই প্রথম আমাদের ঘর থেকেই দেখা দিলেন যমুনেত্রী হিমবাহ, একধারে কুলকুল করে বয়ে চলেছে যমুনা নদী। অনুভুতি স্বর্গীয় কিন্তু ঘর বড্ড নোংরা। খাবার ব্যাবস্থা ভালই। যাদের যাবার তারা চটপট আলুর পরঠা খেয়ে ঘোড়ার দাম দস্তুর করে বেড়িয়ে পরল। সংখ্যায় ৭। ঘোড়া প্রতি যাওয়া আসা নিয়ে ১০০০ টাকা। ডুলি চেপে যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল আমার স্ত্রীর। কিন্তু তারা ৮০০০ চেয়ে বসায় আমার বৌ রনে ভঙ্গ দেয়। মনটা খারাপ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। আমরা আরও জনা ছয়েক টিফিন করে বেড়িয়ে পরলাম জানকীচট্টী ঘুরে দেখতে। মন্দিরের রাস্থা ৫ কিমি হলেও প্রথমেই খাঁড়াই। তাই ওদিকে না গিয়ে রেস্ট হাউসের খাবারের দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোকের কথা মত বেরলাম সরস্বতী শিব মন্দির দেখতে। সাধারণ পথ একটু বেশী বলে আমরা চড়াইয়ের রাস্থা ধরে উঠে গেলাম। একটু কষ্ট হলেও সৌন্দর্য কিছুই কম নয়। প্রায় ২ কিমি হেঁটে মন্দিরে পৌঁছলাম। এই মন্দিরে যমুনামাতা কার্ত্তিক পূর্ণিমার পরেই নেমে আসেন যমুনেত্রী টপ থেকে। ঠান্ডার কারনে।  যমুনেত্রী টপের মন্দির তখন বন্ধ থাকে। মন্দিরে একটি উষ্ণপ্রস্রবণ আছে। সেখানে প্রসাদ ফেলে ফুটিয়ে নেওয়া হয়। বোতলে করে জল নিয়ে আসা হয়। আর মন্দিরে পূজা দেওয়া হয়। যারা গেলেন তারা এই আচার পালন করলেন, আর আমরা মায়ের শীতকালীন আবাসে সরস্বতী মায়ের ও শিবের পূজা দিলাম। ঠাণ্ডা যমুনার জলে ছেটা আর গুরুগম্ভির মন্ত্রোচ্চারণে পরিবেশ মধুর করে ফিরে গেলাম প্রধান রাস্থায়। এখান থেকে দেখা গেলো মন্দিরের ঠিক মাথায় যমুনেত্রী হিমবাহ। আর পাশে বয়ে চলেছে যমুনানদী। হু হু করে বয়ে চলা হাওয়া, সেরকম ঠাণ্ডা পরিবেশ।
 আমরা চললাম গাড়োয়ালী গ্রাম দেখতে এরপর। গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্থা পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে পৌঁছলাম শনি-নাগ দেবতা মন্দিরে। মুল মন্দিরটি চারশ বছরের পুরনো। পাথর ও কাঠ দিয়ে তৈরি। সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ভেতরে আলো খুব কম। মন্দিরের নীচে স্থানীয় রামলীলার আয়োজন হচ্ছে। একটু দুরেই নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। ভেতরে ঢোকার জায়গা দেখলাম না। বাইরে থেকে প্রণাম সারলাম। শুনলাম শনি দেবতা এখন বদ্রি মহারাজের ওখানে গেছেন। নাগদেবতা আছেন। মন্দিরের পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে তুষারশুভ্র পর্বতের উপস্থিতির বিরাম নেই। দেখা শেষে ফিরতে লাগলাম। এখন অপেখ্যাকৃত সহজ লাগলো উৎরাই বলে। নীচে একটা ঝুলন্ত সেতু আছে। সেটা পেরিয়ে যমুনা পেরতে হয়। দেখলাম এখানেই যমুনার দূষণ শুরু। ক্লান্ত পদযুগলকে টেনে নিয়ে রেস্টহাউসে ফিরে দেখি এখনো ঘর বসবাস যোগ্য হতে দেড়ি আছে। অগত্যা সামনের উঠানে বসেই হিমবাহ দর্শন। এত কাছ থেকে হিমবাহ অনেকেই দেখেন নি। এখন একটু ঠাণ্ডা কম তাই পাহাড়ের গায়ে বরফ গলে যাচ্ছে। যারা ওপরে গেছিলেন তারাও ধীরে ধীরে ঘোড়ায় ফিরলেন। তবে ততক্ষণে আমাদের দুপুরের খাবার হয়ে গেছে। তাড়া ফিরে এসে জানালো ওপর থেকে ঝর্না দেখা যায়, কিন্তু পর্বতমালা আর নতুন কিছু দেখা যায় না। অনেকে মন্দির থেকে হিমবাহ অভিযান করেন। কিন্তু সেই দলে আমাদের কেউ ছিল না।
সব ঘর পরিষ্কার হতে হতে বিকেল হয়ে গেলো। বিকেলে সবার যে যার ঘরে ব্যাগ রেখে একটি ঘরে মেয়েরা ও একটি ঘরে ছেলেরা গল্প, তাস সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিতে থাকল। আমি একবার ওই ঠান্ডায় বাইরে এসেছিলাম। চাঁদের আলোয় অপার সৌন্দর্যের রুপ আমার সামনে বিকশিত হয়েছিল হিমবাহের। যমুনার কুলকুল শব্দ এখন যেন গর্জন। শুনলাম এখানে কয়েকমাস আগে মেঘফাটা বৃষ্টি ও সঙ্গে হড়কা বানের কবলে পড়ে এই রেস্ট হাউস বরাত জোরে বেঁচে যায়। হারিয়ে যায় সামনের একটি হোটেল। আজকেও উষ্ণতা শূন্যের নীচে। তাই বেশী দেরী না করে শুয়ে পরাই মঙ্গল। কাল ফিরব মুসৌরি। অনেক পথ।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

------------------------------
সকালের প্রথম আলোয় ঝলমলে যমুনেত্রী হিমাবাহ চোখ ধাঁধানো রুপ নিয়ে সামনে হাজির। কাল রাতে পাহাড়ের চুড়ায় বরফ পড়েছে। আরও সুন্দর আরও মসৃণ। কিন্তু আমরা একটু জলদি বেড়িয়ে পরছি প্রত্যেকদিন। আজকেও ব্যাতিক্রম নয়। আজকে আমাদের দুই সহযাত্রী দেবেশ-মনিকা আমাদের ছেড়ে পারি দিচ্ছেন কেদারনাথের পথে। তাদের বারকোট নামিয়ে দিয়ে যাবো। সেখানে বাসে করে উত্তরকাশি ফিরতে হবে তাদের। উত্তরকাশি থেকে শ্রীনগর হয়ে গুপ্তকাশির পথে চলে যাবেন। আমরা এগিয়ে যাবো মুশৌরির পথে। সেই মত আবার ঘন্টা দুই চলারপর বারকোট বেন্ডে পৌঁছে ধরাসুর দিকের রাস্থায় না গিয়ে দেহরাদুনের দিকে গাড়ি চলতে লাগলো। এসে পৌঁছলাম বারকোট শহরে। বারকোট বেন্ড থেকে ৮ কিমি দূরে। এখানে খাবারদাবারের ভালই ব্যাবস্থা আছে। কিন্তু অপরিচ্ছনতা ও অস্বাভাবিক দাম যেন সর্বত্র। এর মধ্যে খবর এলো চরম অব্যাবস্থা সম্পন্ন জানকীচাট্টী গাড়োয়াল মণ্ডলের রেস্ট হাউসে, স্নানকরার সময় পড়ে গিয়ে রুদ্রাণী(দত্ত) মামির হাতের হাড় সম্ভবত চিড় ধরেছে। তাঁরা অন্য গাড়িতে আমাদের পেছনে আসছেন। আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে এক্সরের দোকান পেয়ে গেলাম ঠিক, কিন্তু খুলতে দেরী। তবে মুশৌরিতে হোটেলে ফোন করে সেখানে এক্সরে করার ব্যাবস্থা করা হল। আমরা প্রাতরাশ সেরে নিলাম। দেবশদাদের বাসে তুলে দেওয়া হল। আমাদের দুটি গাড়ি একত্রিত হয়ে এগিয়ে গেলাম  মুশৌরির পথে। আবার ঘন্টা ৪ এর বিরক্তিকর গাড়ি যাত্রা। ঘণ্টা তিনেকের কিছু সময় পর আমাদের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতরাশি উন্মুক্ত হল। গাড়োয়াল রেঞ্জের প্রায় সবকটি পর্বত এখান থেকে দেখা যায়। তবে আজকে একটু বেলা হয়ে যাওয়াতে মেঘে ঢাকা। ফলে আমাদের একটু দমেই থাকতে হল। এরপর এলো কেম্পটি ফলস। এখানে আজকে নামলাম না। এগিয়ে চললাম শহরের দিকে। আরও প্রায় ৪৫ মিনিট গাড়ি চলার পর ম্যাল রোডের সামনে এসে গেলাম। কিন্তু আমাদের হোটেল দ্বীপ ক্যামেল ব্যাক রোডে। সেটি ম্যালের শেষ প্রান্তে। তাই পাশের গাড়ি চলার রাস্থা দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে একদম পেছনের দিকে নিয়ে দাড় করানো হল। এখান থেকে বাকি প্রায় ৭০০ মিটার হেঁটেই যেতে হবে। প্রায় সমতল রাস্থায় হেঁটে যাওয়া সমস্যার নয়। কিন্তু সঙ্গের মালপত্র কুলি ছাড়া নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কুলি ভাড়া ১১০ টাকা, গাড়িতে উঠিয়ে দিলে আর একটু বেশী। আমাদের ১৩ জনের মালপত্র একদম কম নয়। পাঁচজন কুলির দরকার পরল।
হোটেল দ্বীপ ভালই লাগলো। আমাদের ঘর ছিল ৪ তলায়। তবে লিফট আছে। সামনে খোলা বারান্দা। সেখান থেকে কেদার পর্বত দেখা যায়। তবে আজ বিকেল হয়ে যাওয়ায় আমাদের ভাগ্যে কিছু নেই মেঘের জন্য।
দুপুরের খাবার খেতে বিকেল হয়ে গেলো। পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, বারান্দায় বসে হাল্কা শীতের আমেজে আমাদের খাবার শেষ হল। আজকে সন্দীপ মামারা বেড়িয়ে যাবেন কলকাতার উদ্দ্যেশে, দিল্লী হয়ে, মামির হাত কালকে সকালে দিল্লীতে দেখিয়ে বিমানে চেপে বসবেন। সন্ধের আগেই মামারা বেড়িয়ে পরলেন দেহরাদুনের উদ্দেশ্যে। আমাদের মহিলাকুল ও তাদের স্বামীরা গেলেন বাজার করতে। এই ভ্রমণের শেষ দিন কাল। তাই যার যা বেঁচে আছে পকেটে সেটা খরচ জরুরী। আমি ভাগ্যক্রমে সঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেলাম। রেহাই পেলেন গ্রুপের নেতা সুগত বসুও। কিন্তু দুজনে মিলে পরশু ফেরার পরিবর্তিত স্থান নিয়ে চালক সাহেবের সাথে কথা বলে নিলাম। একটু বেশী (২০০০ মত) দিতে হবে, কারন আমরা হরিদ্বার নামবো বলে এসেছিলাম, কিন্তু টিকিট কুম্ভ এক্সপ্রেসে না পাওয়ায় সাহারানপুর হয়ে যাওয়া পাঞ্জাব থেকে আসা গুরুমুখী এক্সপ্রেস আমাদের গতি। ফলে পরশু আমরা উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর যাবো। ফলে রোড ট্যাক্স অতিরিক্ত লাগবেই।
পরের দিন সকাল হতেই ঝলমলে কেদার শৃঙ্গ আমাদের সামনে, হোটেল দ্বীপের ছাদের থেকে দৃশ্যমান। তবে সব পাহাড়ি শহরের মত মুশৌরিও দূষণে আক্রান্ত। ফলে একটা কুয়াশা-ধোঁয়াশা ভাব রয়েছে।একদিকে ঘড়িঘর, সেইদিকেই সূর্য উঠলো। সকালের খাবার বাইরেই খাবো। তাই সূর্যদয়ের একটু পরেই বেরলাম। আজকে মুশৌরি ঘুরে দেখবো। শেষে ম্যাল হয়ে কেনাকাটা করে বাড়ির জন্য প্রস্থুত হবো। এক স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে। মুশৌরি শহর সম্পর্কে বলি, ইংরেজ জেনারেল ফেড্রিক ইয়ং এর শখ হয়েছিল শুটিং গেম খেলতে, তিনি এখানে এসে মুশৌরি ও ল্যন্ডর নামে দুটি হাওড়া - কলকাতার মত জমজ শহর মত্তন করেন এই প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায়। এখানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানেই থেকে যান। প্রথম গোর্খা বাহিনী তৈরি করেন ও আলুর চাষ করেন। আমরা যে ক্যমেল ব্যাক রোডে আছি সেখানেই উনি একটি শুটিং স্পট তৈরি করেন। সাহেবি শখ। পরে এখানে ক্যন্টন্মেন্ট তৈরি হয়। ঘড়িঘর তৈরি হয়। মানে ইতিহাসের পুরো এক প্যকেজ। আমাদের পরের দিনের যাত্রা শুরু ঘড়িঘর দিয়ে। শরু রাস্থায় একটু এগিয়েই কাছেই ঘড়িঘর দেখে মনটা ঐতিহাসিক করে যখন কেম্পটি ফলস এর দিকে এগলাম তার মাঝে দেখে নিলাম সর্বচ্চ পয়েন্ট লাল টিব্বা। এখান থেকে হিমালয়ের দৃশ্য বড়ই মধুর। তবে হাল্কা কুয়াশা আছেই।ক্যামেল ব্যাক রোড এখান থেকে দেখতে অনেকটা উঠের পিঠের মতই। তাই এই নাম।
কেম্পটি পৌছতে ৪৫ মিনিট লাগলো। সেখানে খানিক নামার পর কেবল কারে চেপে ঝর্নার পতন স্থানে নামা ও ওঠা সম্ভব। ফলে ওঠা নামার হ্যাপা এড়ানো যায়। শুধু উঠতে ১০০, ওঠা নামা ১৫০। আমরা ওঠা নামা কেটে চেপে বসলাম। মিনিট খানেকের যাত্রায় একদম নীচে নিয়ে আসে। তবে মুল স্নান করার জায়গা আর একটু ওপরে। আবার উঠতে হয়। সেখানে স্নান করার ব্যাবস্থা আছে। আছে ব্রিজে দাড়িয়ে ছবি তোলার উপায়। এছাড়া যেখানে কেবল কার থেকে নামলাম, সেখানে চা খাওয়া সম্ভব, সম্ভব গাড়োয়ালি পোশাকে সজ্জিত হয়ে ছবিতোলা। আমরা ঘন্টা খানেক সব করলাম। তারপর উঠে এসে একটি হোটেল দেখে দুপুরের খাবার সারলাম। বিশ্রামের সময় নেই, গাড়ি ফিরে এসে নামিয়ে দিলো ম্যালরোডের মুখে। এখান থেকে হেঁটে বা রিক্সায় হোটেল ফিরতে হবে। আমরা পদব্রজে কেনাকাটা করতে করতে এগিয়ে চললাম। দাম এমনকিছু কম নয়। বরং বেশী। খানিক বিশ্রামে কফিশপে কফি পান। আবার হন্টন। এবার পৌঁছলাম "গান হিল" যাবার কেবেল কারের নীচে। কয়েকজন ওপরে উঠলো এতে চেপে। কিন্তু আমরা বিরত থাকলাম।  "গান হিল"থেকে সমগ্র  মুশৌরি এবং দেহরাদুন শহর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিকেলের দিকে কুয়াশার দাপট বেশী থাকায় দেখা সম্ভব নয় দেখেই আর অতিরিক্ত খরচ করি নি। এরপর হেঁটে হোটেল ফিরে আসা আর রাত কাটিয়ে পরের দিন ট্রেন ধরার প্রস্তুতি।
এখানেই কাহিনী শেষ হতে পারত। কারন পরের দিন ৬ টায় বেড়িয়ে আমরা ১১ঃ৩০ এর ট্রেন ধরতে ছোটায় দেহরাদুন শহর ঘোরার বা সহস্রধারা জলপ্রপাত দেখার সময় পাই নি। কিন্তু দেহরাদুন শহর পেরতেই, সাহারানপুরের রাস্থা ধরতেই আবার সমতল ছেড়ে উঁচুতে উঠলাম ও নামলাম। মাঝে পেরিয়ে এলাম একটা জাতীয় উদ্যান। যার নাম রাজাজী জাতীয় উদ্যান। এটি সম্পূর্ণ ধারনার বাইরে ছিল। ভেবেছিলাম একটা জঙ্গল পেরতে হবে। সেটা যে রাজাজী জাতীয় উদ্যান তা বোর্ড দেখে জানতে পারলাম ও উৎসাহিত হলাম। তবে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্থা হলেও সেভাবে কিছু নজরে আসে নি হনুমানের দল ছাড়া। জঙ্গলের গন্ধ নিয়েই সমতলে নামতে হল। সমতলের রাস্থাও বেশ খানিকটা খুব বাজে।  সাহারানপুরের একটু আগে থেকে রাস্থা ভালো হয়েছে। যাই হোক গুরুমুখী এক্সপ্রেস সঠিক সময় এসেছিল। তাতে চেপে ৩ ঘণ্টা দেরিতে কলকাতা স্টেশন পৌঁছে আমাদের যাত্রা শেষ হয়। এক স্বপ্ন যা এখনো মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে। সারা জীবনের সম্পদ হিসেবে।

আমাদের যাত্রাপথ আর একবারঃ কল্কাতা-দিল্লী-হরিদ্বার-ধনৌল্

টি-টিহরি-উত্তরকাশি-হরসিল-গঙ্গোত্রী-বারসু-উত্তরকাশি-ধরাসু বেন্ড-বারকোট বেন্ড-যমুনেত্রী-বারকোট শহর-মুশৌরি-দেহরাদুন-সাহারানপুর-কলকাতা।