Amazon

Uttarakhand Tour লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Uttarakhand Tour লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮

গাড়োয়ালের আলিগলি


প্রথম পর্ব

হরিদ্বার

গাড়োয়াল শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে উঁচু উঁচু বরফাবৃত গাড়োয়াল হিমালয়ের শৃঙ্গ সঙ্গে নীচে দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী গঙ্গার বা যমুনার উপনদীগুলি। স্বপ্নের কাছাকাছি এই অঞ্চলে যাওয়ার জন্য আমাদের পরিকল্পনা প্রায় ১ বছরের। সুগত বসুর নেতৃত্বে আমাদের ১৯ জনের দল ১৮ সালের অষ্টমীর দিন ১৭ই অক্টোবর হরিদ্বারে মিলিত হব। হরিদ্বার গাড়োয়ালের প্রবেশদ্বার বলা যায়। এখান থেকে শুরু করা যায় গাড়োয়াল হিমালয় ভ্রমন। সেই মত বিমানে দমদম থেকে দিল্লী, সেখানে রাতে পৌঁছে পরের দিন ভোরে দেরাদুন শতাব্দী ট্রেনে সাড়েএগারটা নাগাদ হরিদ্বারে পৌঁছলাম। হরির দ্বার মানেই সেখানে ধর্মীয় ভাব থাকবেই। হর কি পউরি ঘাট এর প্রানকেন্দ্র। আমাদের হোটেলের নামও হোটেল হরকিপউরি। একদম ঘাটের পাশে। এছারা আরও অনেক হোটেল ঘাটের আশেপাশে আছে, যেমন "গঙ্গা বেসিন"। শহর এবং হোটেল পরিষ্কার নয় খুব একটা। এখানে সেখানে নোংরা। গঙ্গা লাগোয়া হোটেলগুলির দাম খুব চড়া। স্টেশন থেকে পৌছতে অটো বা টোটো ভরসা। নো এন্ট্রি ভয় দেখিয়ে প্রথমেই অনেক দাম চাইবে, দামাদামিতে কমবে। নিরমিষ খাবার। তবে হৃষীকেশের দিকে রাস্থায় কিছু আমিষ পাওয়া যায়। খাবারের মান খারাপ নয়, দাম বেশী, বেশীরভাগ খাবারের হোটেল পরিষ্কার নয় তবে আমাদের হোটেল পরিষ্কার। জনপ্রতি ১০০-১২০ টাকা লাগবেই এক এক বেলা খেতে। আমরা পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেড়িয়ে পরলাম ঘাট দেখতে। ঘাটে পৌছনোর জন্য ব্রিজ আছে, ব্রিজ থেকে দূরে ঘড়িঘর দেখা যায়। ঘাটে পৌঁছে একটু মাথায় গঙ্গা জল দিলাম। গঙ্গা এখানে স্রোতস্বিনী, কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে চ্যানেল দিয়ে দ্রুত বয়ে চলেছে। দূরে মহাদেবের সুউচ্চ মন্দির। এখানেই বিকেলে আরতি ও পুজাপাঠ হবে। ইচ্ছা হোল "কঙ্খল" যাওয়ার। ২৫০ টাকা অটো ভাড়া করে আমরা ৫ জন চলে গেলাম সেখানে। "কঙ্খল" শহরের দক্ষিণে অবস্থিতঅঞ্চল। এখানে দক্ষেশ্বর মহাদেব মন্দির, সতী কুণ্ড, মা মনসা মন্দির, আনন্দময়ী মায়ের মন্দির। দক্ষেশ্বর আমাদের প্রথম গন্তব্য। এই মন্দিরের পাশদিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। এখানে পুজাপাঠের পর বলা হয় স্ত্রী স্বামীর পা ধুয়ে পুণ্য অর্জন করতে। দক্ষযজ্ঞ ঘটনার উল্লেখে নিবেদিত এই মন্দির। পাশেই সতিকুন্ড (বলা হয় এখানেই সতীমা জীবন ত্যাগ করেন) ও মামনসা মন্দির। সেখান থেকে একটু এগিয়ে মাআনন্দময়ী আশ্রম। বাঙালি অধ্যুষিত এই আশ্রমে ঢুকলে মন শান্তিতে ভোরে যায়। 
কঙ্খল থেকে ফিরে আবার গঙ্গার ধারে। খানিক সিগাল জাতীয় পাখির আনাগোনা দেখেই  আসন গ্রহন করতে হল হর কি পৌরি ঘাটের ঠিক উল্টো দিকে। ভালো ভিড় এর মধ্যেই। পূজার সময় গোনা শুরু। উল্টোদিকের ঘাটের সিঁড়িতে বসেপরে প্রথমে গঙ্গাপূজা দেখতে লাগলাম। সাড়ে পাঁচটা থেকে আধঘণ্টা মত পুজাপাঠ হওয়ার পর শুরু আরতি। এর মধ্যে অনেকেই নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন পাতার ভেলায় প্রদীপ। এক স্বর্গীয় অনুভুতি। ১৫ মিনিট ধরে কম করে ১০ জন পুরোহিত গঙ্গামাকে আরতি করলেন। সঙ্গে ঘণ্টা ও স্ত্রোতর শব্দ পরিবেশকে ভাবগম্ভির করে তুলল। লোহার শিকল ঝোলানো আছে, সেগুলো ধরে স্নান করা যায়। কিন্তু আরতি দেখায় প্রধান বাঁধা এগুলি। তবে প্রায় ১৫-২০ মিনিট চলা এই ধর্মীয় আচার মনকে শান্ত ও গম্ভির করবেই। "জয় গঙ্গা মাইয়া" ধ্বনিতে শেষ হওয়ার পর আর বিশেষ কিছু করার ছিল না হোটেলে ফিরে পরের দিনের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া। দুঃখ একটাই, এই ভ্রমণসূচিতে আমরা হৃষীকেশ রাখিনি, তাই রামঝুলা লক্ষণঝুলা অন্য সময়। তবে হরিদ্বারে বা দেরাদুনে দুইদিন থাকলে হৃষীকেশ দেখে আসা সম্ভব। 
ধনৌলটি
গাড়োয়াল সুন্দরী ধনৌলটি এই অঞ্চলের মধ্যে সব থেকে সুন্দর বলেই মনে হয়। সেই উদেশ্যে ১৭ই অক্টোবর সকাল ৮ টায় সবাই হরিদ্বারে ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে মিলিত হয়ে সেখান থেকে টেম্পোট্রাভেলারে চেপে দেরাদুন হয়ে চললাম ধনৌলটি। দেরাদুন পেরতেই চড়াই শুরু।তার আগে রাস্তায় প্রাতরাশ সেরে নিলাম। এখানে ডিম পাওয়া গেলো। ধনৌলটি বিখ্যাত লালিগুরাস বা রডদেন্ড্রন সহ বিভিন্য ফুল ও দিগন্ত বিস্তৃত বরফাবৃত পর্বতমালার দর্শনের জন্য। আমাদের প্রায় চার ঘন্টা সফর জুড়ে উন্মাদনা সঙ্গে নতুন স্বপ্ন বোনা শুরু। পথমধ্যে হনুমানকুলকে বাই বাই করে, অজস্রবার ছবি তুলে আমরা পৌঁছলাম ধনৌলটি ইকোপার্ক সংলগ্ন আওারা ক্যাম্পের ওপরে। এই "আওারা ক্যাম্প" আজকে আমাদের বাসস্থান। রাস্থা থেকে প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট নীচে পর পর তাঁবু খাটানো অঞ্চল নামা ওঠার জন্য একদম মসৃণ নয়। বরং একটু বিপদসঙ্কুল। নামা ওঠার রাস্থা একটু খাঁড়া ও সাবধানে না নামলে স্লিপ করে পড়ে চোট লাগার সম্ভাবনা আছেই। কিন্তু অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত তাঁবুর সাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার পর মজাই আলাদা। ঠাণ্ডা কনকনে। সঙ্গে চারিদিক খোলা থাকায় হাওয়ার দাপট। ১৮০ডিগ্রি খোলা অঞ্চলে পর পর শ্রীকান্ত(6133 m), গঙ্গোত্রীর তিনটি চূড়া(6672 m max), জাওনলি (6630 m), খাতলিং গ্লেসিয়ার ও থায়াল সাগর( 6361 m) দেখা দেবে।
এক ধাপ উঁচুতে এদের রান্নঘর। বুকিং এর সময় আমাদের থাকা খাওয়া ধরা ছিল। পৌঁছেই সুন্দর পানীয় মাধ্যমে স্বাগতম জানালো। অনেকটা নামার কষ্ট এক নিমিষে উধাও। দুপুরের খাওয়া ভালো ছিল। খাওয়া শেষে যে যার তাঁবুতে গিয়ে হাল্কা বিশ্রাম নিয়েই বেড়িয়ে পরলাম বিকেলের দৃশ্য দর্শনে। মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে কেউ কেউ দর্শন দিলেন আমাদের। আমার মনে হল  শ্রীকান্ত, গঙ্গোত্রীর তিনটি চূড়া ও থায়াল সাগরআমাদের দর্শন দিয়েছেন। সোনালি রঙের আবিরের খেলায় মেতে উঠলো দিগন্ত। অবগুণ্ঠন খুলে ধীরে ধীরে স্বপ্নপুরী বানিয়ে ফেললেন হিমালয়। দোলনা খাটানো ছিল। সেখানে বসে দোল খেতে খেতে সূর্যাস্তের পর্বতমালা দর্শন যেন শুরুতেই জানিয়ে দিলো কি হতে চলেছে এই ভ্রমন। এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু আওারা ক্যম্প আমাদের জন্য রাতে আরও একটু নীচে ক্যম্পফায়ার, নাচাগানা আয়োজন করে ওই ঠাণ্ডার রাতকে আরও মায়াবি করে তুলল।     
তাঁবুগুলির সঙ্গে টয়লেট যুক্ত। খুব একটা পরিষ্কার না হলেও সেদিকে আমাদের নজর ছিল না। আমার মেয়ে বউয়ের এই প্রথম তাঁবুতে রাত কাটান। প্রত্যেক তাঁবুতে ৩ টি করে খাট পাতা। রাতে ঠান্ডা ভালই লাগবে। কিন্তু রাত কাটলেই যে দৃশ্য সামনে আসবে তা ভুলিয়ে দেবে সব কষ্ট। উপরে বর্ণিত সব চুড়া খানিখনের জন্য সবার সামনে আবার উন্মুক্ত হল। কিন্তু বিধিবাম। বেশিক্ষণ থাকলেন না। আবার মেঘের আড়ালে। যেন লুকোচুরি খেলা। এদিকে আজকে তেহরি যাওয়ার তাড়া আছে। সঙ্গে আবার উঠতে হবে প্রায় ৫০০-৬০০ ফুট। তাই প্রাতরাশ সেরে নিয়েই শুরু হল পরের দিনের প্রস্তুতি।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

ধনৌলটি- তেহরি

প্রাতরাশ সেরে আবার ৫০০-৬০০ ফুট চড়াই ভেঙ্গে ওপরে উঠে আসা সহজ ছিল না। বড্ড বুকে চাপ লাগে। উচ্চতা কম হওয়ায় সমস্যা হল না। তবে বয়স্কদের একটু সময় বেশী লাগলো। খাঁড়াই হওয়ায় পা হরকে যাওয়ার ভয় থাকে। ভালো গ্রিপের জুতো পরে আসা অবশ্যক। আমার স্ত্রী কন্যা আগেই দ্রুত উঠে গেলো। মালপত্র নিয়ে চলে গেলো ক্যাম্পের লোকজন। এদের পরিশ্রম কাবিলে তারিফ। আমি মিনিট ১৫ সময় নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। রাস্থার পাশেই গাড়ি রাখা ছিল। সবাই উঠে যেতে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। একটু এগোতেই রাস্থার ধারে পাইনের সারি জানান দিলো এটাই ধনৌলটি ইকোপার্ক। এখানেই পাইনের সারির ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঝলমলিয়ে ওঠে। ব্যাকগ্রাউন্ডে পর্বতরাজী। যেন এক স্বপ্নপুরী।
আবার গাড়ি চলতে লাগলো। প্রায় ঘন্টা তিনেক চলার পর চাম্বা পেরতেই একদিকে একে বেঁকে ভাগীরথী। এখানে বাঁধ আছে। এই বাঁধ তৈরির সময় অনেককে পুনর্বাসন দিতে হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে সেই গল্প শুনলাম। ফলে পুরাতন তেহরি এখন বসবাস অযোগ্য। তাদের নিয়েই একটু ওপরে তৈরি হয়েছে নতুন তেহরি। এখানে একটি ছোট জলের ধারা এসে ভাগীরথীতে মিশেছে। এবং জলাধার মিশ্রিত এক সুন্দর লেকের সৃষ্টি করেছে। জলের গতি বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় এখানে ভাগীরথী ধির স্থির। কিন্তু চারিদিকে উচ্চ পর্বতমালা বেষ্টিত হয়ে লেকের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের দলের বেশীরভাগের আজকে থাকার জায়গা হোটেল মানাআর। ১২০০ টাকা রুম প্রতি ভাড়ায় এখানে প্রায় সবাই থাকলেও দুটি পরিবারের জন্য অন্যত্র ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়োয়াল মন্ডলের এখানে সুন্দর কটেজ আছে। কিন্তু ভাড়া কম করে ৫০০০ টাকা। এছাড়া সরকারি পরিকল্পনায় এখানে টুরিসম বৃদ্ধির উদ্যেশ্যে তৈরি হয়েছে ভাসমান কটেজ। সেগুলি লেকের ওপরে তৈরি ভেলায় ভাসমান। পারে যাতায়াতের জন্য নৌকা আছে। দাম? আকাশছোঁয়া। প্রায় ৬০০০ দিন প্রতি দুজনের জন্য। একটু চেপে খরচ করা আমাদের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমরা গেলাম তেহরি বাঁধ কর্তৃপক্ষের হোটেলে। এখানে থাকার রুম পাওয়া মুশকিল হলেও ফাঁকা থাকলে দিয়ে দেয়। আমাদের এক কলকাতার বন্ধুর মাধ্যমে চেষ্টা করেও পাচ্ছিলাম না। কিন্তু ওখানে গিয়ে কথা বলতে দুটি ঘর পাওয়া গেলো। ভাড়া ঘর প্রতি ২৫০ টাকা। সব থেকে সস্থা ও অকল্পনীয়। ঘরগুলি সাজানো এবং একদম নদীর পাশেই। একটু অযত্নের ছাপ আছে। তবে সামনের বিস্তৃত খোলা অঞ্চলে এবং পেছনের ফুলের বাগানের পাশেই ভাগীরথী বহমান ধারা এবং একটু দূরে বাঁধ যেন এক স্বর্গীয় অনুভুতি। খাওয়া এখানে সম্ভব হল না। দশেরার ছুটির কারনে আমাদের খেতে হল হোটেল মানাআরে।হোটেল মানাআর থেকে দৃশ্য একটু আলাদা। অনেকটা পাখির চোখের দৃশ্য এখানে ফুটে ওঠে। কিন্তু দুজায়গা থেকেই সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। 
আমরা বিকেলে গেলাম জলক্রিয়ায়। এখানে বোটে করে ভাগীরথীর এপার ওপার করায়, আধ ঘণ্টা জনপ্রতি ৪০০ টাকায়। এছাড়া ওয়াটার স্কুটার থেকে শুরু করে ভাসমান রেস্টুরেন্ট, সব এখানে উপস্থিত। দাম একটু চড়া এই যা। ছাউনিদেওয়া সাধারণ মটর বোটে লেকতুল্য নদীতে এপার ওপার করে পড়ন্ত সূর্যালোকে মোহময় তেহরি যেন মায়ালোকে পরিণত। এখানে জলকেলি শেষ হতেই একটু দৃশ্য দর্শন করে আবার গাড়িতে উঠে পরা। ঠাণ্ডা পড়তে শুরু সূর্যডোবার সাথে সাথে। তাই অন্ধকারের সাথে সাথে আমাদের কাজ কম্ম সবই ঘরে বন্দী হয়ে গেলো। পরের দিন অনেক কাজ। যাবো উত্তরকাশি। 
উত্তরকাশি 
ঘন্টা ৪ এর রাস্থা কিন্তু আশেপাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভোলাবেই। ভোর ভোর বেড়িয়ে এলাম। চিনিয়ালসর হয়ে ধরাসু বেন্ড দিয়ে উত্তরকাশির হোটেল গঙ্গাশ্রয় আজকে আমাদের গন্তব্য। কিন্তু গাড়ি গতি প্রায় কি করে? চিনিয়ালসরের রাস্থা ধরতেই যেন স্বর্গে প্রবেশ। ধীরে ধীরে সূর্যদেবতার আগমন, ডান দিকে নীচে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, দূরে দেখতে পাওয়াযাচ্ছে গাড়োয়াল মণ্ডলের ভাসমান কটেজ। পাহাড়েঘেরা ভাগীরথীর পাখিরচোখে দৃশ্যায়ন। পূর্বআকাশ রক্তিম। পুরো অঞ্চল্টাই আমাদের সামনে। বাঁকে বাঁকে শিহরন। বার বার গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা আর চোখের আরাম। দেরি হয়ে গেলে উত্তরকাশিতে আমাদের পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানে সমস্যা হতে পারে। তাই একটা তাড়া ছিলই। নাহলে এখানেই থেকে যাওয়া যায় জন্মের পর জন্ম। এই ভাবেই ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম ধরাসু বেন্ড। এখানে রাস্থা দুভাগ হয়ে একভাগ গেছে বারকোট হয়ে যমুনেত্রী বা দেহরাদুন আর একভাগ উত্তরকাশি হয়ে হরসিল এবং গঙ্গোত্রী। আমরা আজকে ডানদিকের উত্তরকাশির রাস্থা ধরলাম। তার আগে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। তবে অপরিস্কারের ধারা এখানেও বজায় আছে। সুলভ সৌচালয়ে প্রবেশ খুবই কষ্টকর।
গাড়ি চলতে শুরু তো করলো কিন্তু আবার গাড়ি থামতে হল। প্রথম একা একা ধরা দিলেন মাউন্ট বান্দরপুঞ্ছ। একটা বাঁক পেরতেই। বাঁদরের লেজের মত বলে এনার নাম বান্দরপুঞ্ছ। তিনটি শিখর নিয়ে দাঁড়িয়ে। ছবি তোলার শত্রু ইলেকট্রিক তারের বাঁধা টপকে মনের মত ছবি হয়ত তোলা গেলো না, কিন্তু চোখের আরাম ষোলোআনা। আবার গাড়ি এগিয়ে চলল। ঘণ্টা চারেক পড়ে প্রধান উত্তরকাশি শহরে প্রবেশ। এখানে প্রায় আধুনিক সুযোগসুবিধা সবই পাওয়া যায়। তবেই এখানেই শেষ। এর পরে সবই কষ্টের। আমরা এখানে প্রথম দাঁড়ালাম কৈলাস আশ্রমে। এখানে পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল আমাদের। সেখানে সাধুসন্তদের "ভান্ডারা" প্রদান করা হবে। সেই মত কয়েকঘন্টার অনুষ্ঠান সমাধা করে অনেকেই লাঞ্চ সেরে নিলেন আশ্রমেই। আশ্রমের পাশেই গঙ্গার ধারা যা ভাগীরথী হিসেবে পরিচিত, বয়ে চলেছে। এর পর আবার প্রায় ৮ কিলোমিটার গাড়ি চলার পর পৌঁছলাম আমাদের আজকের আস্থানা হোটেল গঙ্গাআশ্রয়। এখানে রুমপ্রতি ভাড়া ১২০০। হোটেলটি একদম নদীর ধারেই। এখানে নদী নিচু দিয়েই প্রবাহিত। ১০-২০ ফুট নামলেই জলধারা স্পর্শ করা যায়। রুমের পাশে লনে দাঁড়ালেই দেখা যায় এঁকে বেঁকে নদী এসেই আবার পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গেলো। কয়েকধরনের মাছরাঙার সঙ্গে দেখা হল।
একটু বিশ্রাম নিয়েই চলে গেলাম পাশেই মানুষসৃষ্ট ঝর্না খেঁদি ফলস দেখতে। এটা একটি উপ-জলধারা, যা ভাগীরথীতে এসে মিশেছে, তাকে ব্যাবহার করে সম্ভবত জলবিদ্যুত তৈরি হচ্ছে। জলপ্রপাতের পাশে রামধনু তৈরি হয়েছে। শেষ বিকেলে এখানে পৌছনোর মজাই আলাদা। ফিরে এসে নামলাম নদীর বুকে। জল ভালো ঠাণ্ডা। একে তো বরফগলা, তায় এখানে তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ঠাণ্ডার দাপট। ভোরের দিকে শূন্যের নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। আমাদের স্বপ্নের যাত্রা চালু রয়েছে। পরের দিনে আমার স্বপ্নের গন্তব্য হরসিল। তাড়াতাড়ি রাতের আহার শেষ করেই সারাদিনের ক্লান্তি দূরে করতে বিশ্রামের আশ্রয় নিলাম। তবে তার আগে একপ্রস্থ গানের লড়াই খেলে নিতে অসুবিধা হল না। এই স্বর্গীয় ভুমিতে মন আনন্দে গুন গুন করে উথবেই "এ কাহা আ গায়ে হাম, তেরে সাথ ...।"    

গাড়োয়ালের আলিগলি

উত্তরকাশি গঙ্গাআশ্রয় হোটেল নিঃসন্দেহে ভালো। শহর থেকে একটু দূরে, কিন্তু নিরিবিলি। তবে খাবারের দাম নিয়ে দড়াদড়ি আবশ্যক। নাহলে বেশী দামে কম খাবার। এছাড়া একটা সংখ্যা বা অঙ্কগত সমস্যা এদের দেখতে পাচ্ছি। হিসেবে ভুল করা, সর্বমোট রুটির সংখ্যা নির্ণয়ে ভুল, এবং খাবারের বিল কম বেশী করে ফেলা, এখন অবধি সরকারি বেসরকারি সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। তাই নজর রাখতে হচ্ছে। 

বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা পাখির আগমন সকাল সকাল। ঠাণ্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের সকাল সকাল উঠতেই হবে। সেই মত ৬ টা নাগাদ আবার গাড়ি চলতে শুরু করে দিলো। আজকে যাবো রাজ কাপুরের স্বপ্নের হরসিল। উচ্চতা প্রায় ৮০০০ ফিট। ঠাণ্ডাও জম্পেশ লাগবে। সকালেই ১০ এর নীচে থাকার সম্ভাবনা। এখানে আমাদের থাকার জায়গা গাড়োয়াল মণ্ডলের লজে। গাড়ি চলতে থাকলে আমাদের পাশে পাশে ভাগীরথীও চলতে থাকে। আগের দিন যাওয়া খেঁদি ফলসের একটু আগে উত্তরাখন্ড পুলিশ প্রত্যাক গাড়ির তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। গতকাল একবার তথ্য দেবার পরেও আজকে আবার দিতে হল। কিছুটা সময় নষ্ট। আবার খেঁদি ফলস পেরিয়ে মানেরি বাঁধ পেরিয়ে চলেতে লাগলাম। মানেরি বাঁধের সৌন্দর্য অপরিসীম। তেহরির মত না হলেও খুব সুন্দর। সাধারনের প্রবেশ নিষেধ। তবে আমাদের গ্রুপ ক্যপ্টেনের "ম্যনেজ স্কিলে" ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছিল। ছবি তোলার নয়। মাঝে ভাটয়ারি বলে একটা জায়গায় গাড়ির চাকা ঠিক করানো হল। তেল আগেই নেওয়া হয়েছিল। এর পরে আর গাড়ির সারাইয়ের জন্য বা তেল ভরার আর কোন দোকান পাওয়া যাবে না। 
এই রাস্থার সর্বত্র পর্বত যেন সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেখ্যা করে আছে। তাই যেখানে দাঁড়ানো সেখানেই ছবি তোলা আর গাড়ির গতি থাম্মিয়ে বাঁকে বাঁকে সৌন্দর্য আরোহণ আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের দুটি গাড়ি। আমাদের বড় গাড়ি এমনি ধীর তায় আমাদের অত্যাচারে গতি তোলার ক্ষমতা নেই। পেছনের ছোট গাড়ি দেরি করে বেরিয়েও আমাদের সঙ্গেই পৌঁছে যেতে থাকল। তাই মাত্র ৬৭ কিলোমিটার হরসিল পৌছতেও কম করে ৪ ঘন্টা লেগে গেলো। 
ভাগীরথী একটু ডান দিকে মোচর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে এই ভাবে একটা সুন্দর উপত্যকা বানিয়ে ফেলবে হরসিলে গাড়ি থেকে নেমেও কল্পনা করতে পারি নি। কারন সেনা বাহিনীর ক্যাম্প পেরিয়ে, ছোট নদীর ওপর দিয়ে এগিয়ে হরসিল গ্রামে প্রবেশ করার পর্যন্ত চারিদিকে বরফপড়া পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিলো ঠিকই কিন্তু ভাগীরথী দেখতে আমাদের হরসিল গাড়োয়াল মন্ডলের লজ অবধি যেতেই হত। মালপত্র বয়ে নিয়ে আসার জন্য কুলির ব্যাবস্থা করেই ঘরের দাবী পেশ করার মত বাজে কাজ গুলি আমাকেই করতে হল। কারন আমার নামেই অনলাইনে বুকিং ছিল। সেই কাজ ঝটাপট মিটিয়ে, আমাদের ঘরে মালপত্র প্রবেশ করিয়ে আমি ছুটলাম লজের লনে। সেখানে চমক। ঘরে বসে সব পাওয়া যাবে না। সামনের দিকের ঘর গুলি বা ওপরের ঘরগুলি থেকে কিছু দৃশ্য পাওয়া গেলেও বেশীরভাগ ঘরেই দৃশ্য নেই। তবে লনে জায়গায় জায়গায় কাঁচ ঘেরা ঘর কম করে দুটি। বসে আড্ডা মারা ও সঙ্গে ভাগীরথী দর্শন। সাথী হিমালয়ের কিছু বরফাবৃত চুড়া, যাদের নাম নেই আর কিছু নামী চূড়া, যেমন বান্দরপুঞ্ছ(আগে দেখেছি), শিভলিং, সুনদর্শন। একটু যেন কম কম বরফ। গলে গেছে হবে। কিন্তু প্রকৃতি দেবী একটু বেলা বারতেই মেঘ নিয়ে এসে সেই খামতি মিটিয়ে দিতে লাগলেন। আমরা দূর থেকে সেই হোয়াইট ওয়াশ দেখতে লাগলাম। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ভাগীরথী এঁকে বেঁকে, লজের সীমা চুম্বন করে, দূরের পাহাড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। নদীর উচ্চ গতি। ফলে স্রোত ভয়ানক বেশী কিন্তু জল কম। নদীর ধারে অসংখ নুরি পাথর আর পাখির সমাহার। লালঝুটি থেকে সাধারণ বুন পায়রা, উপস্থিত সবাই। কারন? নদীর ধারে ভেসে আসা আপেলের সারি। এবছর আপেলের চাষ ভালো হয়েছে। এখানে আপেলের চাষ হয়। লজের নিজস্ব গাছে আপেল পেরে খেতে আপত্তি নেই, কিন্তু গ্রামের মানুষের ফল পারা যাবে না। আপেলের দাম ২০ টাকা প্রতি কেজি। কল্পনা করা যায় আমাদের শহরে? 
হরসিল বলিউড খ্যাত। গল্প শুনেছি রাজ কাপুর সাহেব হরসিলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বানিয়েছিলেন রাম তেরি গঙ্গা মেইলির মত সিনেমা। যার বেশীরভাগ এখানেই শুটিং। মন্দাকিনীর নামে একটা ঝর্নার নাম ও আছে, কিন্তু খুঁজে পেতে একটু কষ্ট। তিনি কেন মুগ্ধ হয়েছিলেন তা এসেই বুঝতে পারছি। চারিদিকে বরফ সাদা পাহাড়ের মাঝে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া ভাগীরথীর গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আপেলের গাছের সাড়ি নিয়ে অবস্থান করা এক অপূর্ব উপত্যকা এই এত্ত উঁচুতে।
  গল্প আছে, এক ইংরেজ সাহেব সিপাহী বিদ্রোহের সময় সমতল থেকে পালিয়ে তেহরি মহারাজের আশ্রয় চান। মহারাজ আশ্রয় না দিলে তিনি এই হরসিলের গ্রামে লুকিয়ে থাকেন। বিয়ে করেন এক স্থানীয় ভদ্রমহিলাকে। তারপর তাদের আপেলের চাষের উপায় বাতলে ও গাছের গুঁড়ির ব্যাবসা করে ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে যান রাজা। পত্তন করেন এই জনপদের। লোক মুখে এই কথাই ঘোরে। এখানে বেশীরভাগ মানুষ গাড়োয়ালী হলেও কিছু নেপালি মানুষ আছেন। বেশীরভাগ কুলিরা তাই হন। 
মালপত্র ঘরে ঢুকিয়ে ক্যমেরা নিয়ে নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। নামা যেত। তবে অপরিস্কার থাকায় ও আমার ব্যালেন্স খুব ভালো না হওয়ায় নামিনি। তবে চোখ ভরে দেখে নিয়েছি প্রকৃতি। বেলা বারতেই হু হু করে হাওয়ার দাপট। মেঘে ভরে গেলো আকাশ। মাঝারী বৃষ্টি শুরু হল। আশা জাগল যদি বরফ পড়ে। এই বৃষ্টিতে ভেজা উচিত নয়। এখানে প্রকৃতি এখন এরকমই। সকালে পরিষ্কার, বেলা বাড়তে থাকলে মেঘ এসে হাজির হবে। তার পর বৃষ্টি হয়ে আবার রাতের দিকে পরিষ্কার। আজকে একটু বেশীসময় বৃষ্টি হল। যেন আশেপাশের সবুজ পাহাড় স্নান করে আরও সুন্দর হল। ফাঁকা থাকায় হাওয়ার দাপট খুব বেশী ছিল। ফলে ঘরবন্দি। সন্ধের আগে ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকল। আর চোখের সামনে দেখতে পেলাম সামনের উচ্চ শৃঙ্গগুলি আরও সাদা। অনেক নীচে পর্যন্ত বরফ পড়েছে। তবে আমাদের কপালে জুটল না। তবে মাউন্ট সুদর্শনের দিকটা অন্ধকার না হওয়া অবধি পরিষ্কার হল না। চাঁদ উঠেছে। তবে মাথার ওপরে। লজের আলোয় আলাদা করে খুব বেশী না হলেও সামান্য সামান্য দেখা যেতে লাগলো। কলকাতার সংস্থা ওয়েদার আল্টিমা আসার আগে আমাকে বলে দিয়েছিল যে এই সময় পশ্চিমী ঝঞ্জার কারনে হরসিল গঙ্গোত্রীর মত উঁচু অংশে বৃষ্টি থাকবে, বরফ পড়তে পারে। তাই আশায় বুক বাঁধলেও শেষ মেশ হতাশ হলাম। রাতের ঠান্ডা ভয়ংকর। শূন্যের কয়েক ডিগ্রী নীচে। বাঁচোয়া যে রুমের হিটার চালু করা গেছিল ও বিদ্যুতের সমস্যা হয় নি। না হলে কি হত পরের দিনের গল্পে পড়ুন। রাতে আজকের মেনু ছিল মটন। আর একটি খবর যা শুনে এসেছিলাম, মিলল না। শুনেছিলাম এই রাস্থায় কোথাও আমিষ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হরিদ্বার ছাড়া প্রায় সর্বত্র কম করে ডিম পেয়েছি। দেখা যাক সামনে কি পাওয়া যায়। চিকেন তো পাওয়া যাচ্ছেই। এখানের রান্নার স্বাদ খুব ভালো। তবে সেই লোক কম থাকার সমস্যা আছেই। ফলে ঘর পরিষ্কার থেকে খাওয়া সবেতেই দেরি হচ্ছে। 
আমার হরসিলে দু রাত থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনায় এক রাত। ঠাণ্ডায় কষ্ট করে একরাত কাটিয়ে দেওয়া যায় শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখানে প্রকৃতি যেন একটু বেশী সুন্দর সেজেছে। বৃষ্টি না হলে হয়তো গ্রাম ঘুরে দেখতাম। তবে পরের দিন সকালে উঠে বেড়িয়ে পরার তাড়ার মধ্যেও সকালের পরিষ্কার আকাশে আরও কয়েকবার উপত্যকার সৌন্দর্য আহরন করে নিতে ভুলি নি। আবার কবে আসব কে জানে আমার এই স্বপ্নপুরিতে।   

গাড়োয়ালের আলিগলি

গাড়োয়ালের আলিগলি যেন এক স্বপ্নের শুরু শেষ আর এক স্বপ্নের উৎপত্তি। আমরা তুষারপাত পেলাম না। এই গল্প লেখার সময় হরসিলে ভালো তুষারপাত হয়েছে বলে শুনতে পেলাম। বিধি বাম। তবে তুষারপাত হলে পরিষ্কার সকাল উপভোগ করা যেত না। আজকেও সকাল ৭ টা নাগাদ বেড়িয়ে পরলাম গঙ্গোত্রীর দিকে। বেশী রাস্থা নয়, ঘণ্টা খানেক। কিন্তু আমরা থেমে থেমে যাবো বলে একটু তাড়াতাড়ি বেরচ্ছি প্রত্যেকদিন। আর থামবো নাই বা কেন? এক এক মোর ঘুরতেই বরফ সাদা পাহাড় চূড়া এসে আমাদের দৃষ্টি স্বার্থক করে দিচ্ছে। আজকেও ব্যাতিক্রম নয়। একটু এগোতেই মাউন্ট শিবলিঙ্গ, সুদর্শন এনারা দেখা দিতে লাগলেন। যেন ডেকে নিয়ে যেতে চান। কালকে রাতে ঠাণ্ডার ধাক্কা এখনো সহযাত্রীরা সামলাতে পারেন নি। তাই গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলার লোক আজকে ২-৩ জন। বাকিরা গরম গাড়ির ভেতরেই। কাল রাতের উষ্ণতা শূন্যের বেশখানিক নিচেই ছিল। বেরনোর সময় জমে থাকা জল জেলি বা সাদা সাদা হয়ে যেতে দেখেছি। যাকে গ্রাউন্ড ফ্রস্টিং বলে। আজকে সকালেও সেই ঠান্ডা কমার কোন লক্ষন নেই। উলটে আজকে রাতে আরও বেশী ঠাণ্ডা পড়বে। তবে কি বরফ পাবো? 
 অচিরেই আমরা গঙ্গোত্রী মন্দিরের থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের গেটে এসে পৌছলাম। এখানেই গাড়ি থেমে যাবে। আর এগোনর অনুমতি দেবে না উত্তারাখন্ড পুলিশ। আবার কুলি নিয়ে মালপত্র নিয়ে যেতে হবে। খরচ পড়বে ১১০ টাকা প্রতিবার প্রতিকুলি। এখানেও আমাদের গাড়োয়াল মন্ডলের গেস্টহাউস নেওয়া আছে। পাঠক এখানে মনে রাখবেন দুটি   গাড়োয়াল মন্ডলের ব্যাবস্থাপনায় থাকার জায়গা আছে। একটি একদম গঙ্গোত্রী মায়ের মন্দিরের লাগোয়া ছোট, অন্যটি বড় ও ৫০০ মিটার দূরে, নদীর অন্যপ্রান্তে। আমাদের বড় প্রধান  গেস্টহাউস বুকিং ছিল। খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। তবে একটু দূরে এই যা। নদীর ওপরে তৈরি ব্রিজ পেরতে হবে এবং একটু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তবেই  গেস্টহাউস পৌঁছন সম্ভব। বয়স্কদের অসুবিধা হওয়ার কথা। তবে সারা হরসিলে মোবাইলে বি এস এন এল ছাড়া কারো সংযোগ ছিল না। গঙ্গোত্রী পৌছতে আমার এয়ারটেল কাজ করতে শুরু করলো। আমাদের দুটি পরিবারের জন্য একটি রুম ব্যাবস্থা হয়েছে। তাকে এফএএম বা ফ্যামিলিরুম নাম দিয়েছে। ভাড়া ১৬০০ মত। অন্যদের প্রত্যেক পরিবারের ডিলাক্স রুম। ডিলাক্স রুমে প্রাতরাশ বিনা পয়সায়। রুম থেকে কোন পর্বত দেখতে পাওয়া যায় না, কিন্তু সামনের লনে এলেই কেদার ও সুদর্শন হাজির রুপের ডালি নিয়ে।  গেস্টহাউসটি এত সুন্দর জায়গায় যে ডান দিকে এগোলেই কয়েক পা গেলেই সূর্য কুন্ড নামের ঝর্না। যেখানে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা ভাগীরথী নীচে নেমে আসছে। আর এক প্রান্তে সীতাকুণ্ড। সেটিও তাই। 
পুরাণ অনুসারে সগর রাজার ৬০০০০ সন্তান কপিলমুনির অভিশাপে ভস্ম হয়ে গেলে তাদের পুত্র ভগিরথ, তপস্যা বলে মা গঙ্গাকে মর্তে আগমন ঘটান। সেই পুণ্য গঙ্গার স্রোতে ৬০০০০ সন্তানের ভস্ম ধুয়ে যাওয়ায় তাদের মুক্তিলাভ ঘটে। এই গঙ্গোত্রীতেই মা গঙ্গার মর্তে আগমন। এখানে ভাগীরথী নামে পরিচিত ভগিরথের নাম অনুসারে। প্রয়াগে আলকানন্দার সঙ্গে মিশে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হন। কিন্তু তেজী মা গঙ্গার স্রোত ধারা মহাদেবের জটায় ধারন ছাড়া মর্তের বিনাশ আটকানো সম্ভব ছিল না। তাই মনে করা হয় এই সূর্যকুন্ডে মহাদেব গঙ্গামা কে জটায় ধারন করেন। পবিত্রভুমি গঙ্গোত্রী তাই ছোটা চারধাম। বিজ্ঞান বলছে অনেক আগে গঙ্গোত্রী হিমবাহ গঙ্গোত্রী পর্যন্ত ছিল। ধীরে ধীরে গোমুখ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। এখন আরও পিছিয়ে গেছে। যার নাম গোমুখ -২। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ, গোমুখ -২ ট্রেক করে যাওয়া যায় বা ঘোড়ায় চড়ে। হেঁটে গেলে ৩ দিন মত লাগবে -১ পর্যন্ত। এছাড়া ভাগীরথী, কেদারতাল, প্রভৃতি অনেক রকমের অভিযান এখান থেকেই যেতে হয়। এর পরে আর গাড়ি যায় না।   
রুমে মালপত্র রেখে কুলিভাড়া মিটিয়ে আমরা এগলাম গঙ্গামায়ের মন্দির দর্শনে। সূর্যকুন্ডে রামধনু দেখা যায়। কিন্তু আজকে অদৃশ্য। সূর্যকুন্ড থেকে মাউন্ট সুদর্শন দেখে ছবি তুলে আমরা এগলাম মন্দিরের দিকে। এক কিলোমিটারের কম রাস্থা পেরিয়ে, ভাগীরথী নদীর একটি ধারা পেরিয়ে প্রধান ধারার ওপরের ব্রিজে পৌছনোর আগে ভাগীরথী শিলা। মনে করা হয় এখানেই ভগিরথ শিবের তপস্যা করেছিলেন। তারপর ব্রিজ পেরিয়ে মন্দির। মন্দিরে প্রধান বিগ্রহ গঙ্গামাইয়া। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে এখানে পূজা দেন। আমিও ব্যতিক্রম নই। জল মাথায় দিলাম। ভালো ঠাণ্ডা, কিন্তু কেমন যেন সহ্য হয়ে গেলো। ওখানে ছোট ছোট ১০০ মিলির বোতল বিক্রি হয়। ১০ টাকায় কিনে জল ভরে নিলাম। বড় বোতল ছিল। কিন্তু লাগেজের ভয়ে নিলাম না। পুজর প্রসাদ খই ও নকুলদানা। ভক্তিভরে খেয়ে নিলাম। ইতিহাস মতে মন্দির তৈরি করেন নেপালি জেনারেল অমর সিং থাপা। নদীর এঁকে বেঁকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এক পাশে মন্দির। মন্দির উঠানে দাঁড়ালে উল্টোদিকে মাউন্ট সুদর্শন উপস্থিত সঙ্গে কেদার। যেন পাহারা দিচ্ছেন। অপরুপ দৃশ্য। একটু থেকে বেড়িয়ে এলাম। এবার ফেরার পালা। এক পথে ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম বনবিভাগের রেস্টহাউস এখানেই আছে। একটু আগে। ফিরে এসেও থেমে গেলাম না। দুপুরের খাবারের একটু দেরি আছে। তাই বেড়িয়ে পরলাম দেড় কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া পান্দব গুহা দেখতে। প্রথম দিকে ভালো চড়াই উৎরাই থাকলেও শেষের দিকে প্রায় সমতল রাস্থা দিয়ে দেড়কিমি থেকে একটু বেশী রাস্থা হেঁটে যেতে ভালই লাগে। জঙ্গলের ভেতরে গাছের ফাঁকে ফাঁকে পাখির ডাক শুনে এগিয়ে চলা। নীচে দিয়ে বয়ে চলা ভাগীরথীর গর্জন। শেষের দিকে বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু পৌছে গেলাম। একটা বড় পাথরের ভেতরে ছোট গুহায় কয়েকজন সাধুর বসবাস। রান্নার ধোঁয়ায় এমনি ভেতর বড্ড কষ্টকর। রাস্থার সৌন্দর্যের সঙ্গে এখানের তুলনা চলে না। তাই একটু হতোদ্যম হয়েই ফিরে চললাম। সর্বত্র ফেরার সময় কম লাগে। এবারেও তাই। তার মধ্যে গেস্ট হাউসে থেকে যাওয়া সহযাত্রীদের ফোন, আরও গতি বাড়াতে সাহায্য করলো। দুপুরের গরম গরম নিরামিষ খাবার ডাকছে। ২০ মিনিটে ফিরে এলাম। এসেই খিদে পেটে গোগ্রাসে গিলে তো নিলাম। কিন্তু খাবার পর থেকেই ঠাণ্ডা লাগতে লাগলো বেমাক্কা। হাঁটাচলার জন্য যে গা গরম হয়েছিল তা কিছুক্ষনেই ঠাণ্ডা হয়ে শরীরের হারগুলি ঠোকাঠুকি করতে লাগলো। যেন সহ্য ক্ষমতা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত। সূর্য ডুবতেই উষ্ণতা একদম নিশ্চিত শূন্যের নীচে। ওদের অফিসরুমের বাইরে লাগানো থার্মোমিটার জানা দিচ্ছে -২ ডিগ্রী এখনি। রুমহিটারে
খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেলো না। নিয়েও লাভ হত না। সারাদিন বিদ্যুতের দেখা নেই। সন্ধের পর থেকেই জেনারেটরে ১১টা অবধি আলো জ্বালিয়ে রাখলেও তারপরে অন্ধকার। তার মধ্যেই রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়েপরা ছাড়া আর কোন কাজ করার উপায় নেই। সেই সঙ্গে কনকনে হাওয়া। বরফের পাহাড়গুলো খুব কাছে হওয়ায় ঠান্ডা মাত্রারিক্ত। রাতের উষ্ণতা -১০ এর কাচকাছি ছিল। কারন পরের দিন সকাল সকাল ছবি তুলেই পালিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। ৬ টা নাগাদ সব তোরজোড় করে বেড়িয়ে আসার সময় উষ্ণতা দেখা গেলো -২। ফলে তারাহুর করে বেড়িয়ে পরলাম। আজকে যাবো বারসু। প্রসঙ্গত বলে রাখি গঙ্গোত্রীর উচ্চতা ১০ হাজার ফুটের একটু বেশী। সাধারণত শ্বাস নিতে অসুবিধা না হলেও, উত্তেজনা, ক্রোধ ইত্যাদি করলে শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই পারে। দরকারে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে হবে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে চকলেট বা গা গরম রাখার খাবার খাওয়া প্রয়োজন। তবে নিরামিষ একমাত্র ভরসা হওয়ায় মাংস অমিল। ওতেই মানিয়ে নিতে হবে।
 চলবে

বারসু।

--------------------------
ইচ্ছাছিল বা বলাযায় প্রায় নিশ্চিত ছিলাম বরফ পড়বে, অথবা বরফ পড়ে থাকবে, কিন্তু বিধি বাম। গঙ্গোত্রীতেও তুষারপাত দেখা হল না। তবে সুগতদা চিন্তিত ছিলেন যে বরফ পড়লে ঠাণ্ডায় আমাদের আরও কষ্ট হবে। সঙ্গে প্রাকৃতিক যে দৃশ্য আমরা দুচোখ ভরে গিলছি, কিছুই পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল অন্তত এই অভিজ্ঞতা হয়ে যাক। ব্যাজার মুখে গাড়িতে চলতে লাগলাম। প্রায় এক রাস্থায় নেমে আসতে হবে ভাটয়ারি পেরিয়ে গংনানি অবধি। গংনানির একটু আগে ডান দিকে রাস্থা উঠে যাবে। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার মত গেলেই বারসু গ্রাম। বারসু গ্রাম হল দায়রা বা দরিয়া বুগিয়ালের বেস ক্যাম্প। এখানে সবাই ট্রেক করতেই আসে। কিন্তু আমাদের দলে সেই লোক হাতে গোনা ৪-৫। তাই ট্রেক নয়, আমরা সৌন্দর্য দেখতেই এসেছি।
   গংনানির পর বারসুর রাস্থা ওপরে উঠতেই চোখের সামনে হই হই করে চলে এলো একের পর এক সাদা শৃঙ্গ। কেউ কেউ নাম করা যেমন কেদার, কেউ অনামি। সদ্য কাল রাতে বরফ পড়ে সাদা হয়ে সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থাৎ সেই আমাদের গাড়ির গতি রুদ্ধ হয়ে গেলো। আজকে মোট যাওয়ার ছিল ৪০ কিমি মত। তার শেষ ১০ কিমি আমাদের ছবি তোলার ধুমে যেতে লেগে গেলো প্রায় ১ ঘন্টা। লাগবেই না কেন। এক এক বাঁকে এক এক শুভ্র হিমশীতল চূড়া আমাদের অভ্যর্থনা করছে যে। না নেমে উপায় কি? আমাদের গাড়ি হিমাচল থেকে আনানো হয়েছিল। স্থানীয় নন। তবে তার কোন অসুবিধাতো হইয়নি, বরং আমাদের খুব পরিচিত যোগরাজ ভাই যেখানে যেমন খুশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে সাহায্য করেছেন। স্থানীয় চালক কেপির থেকে অনেক ভালো। হয়তো দ্রষ্টব্য স্থান আমাদের খুঁজে নিতে হয়েছে, কিন্তু কোনওসময় তাড়াহুরো করেননি। ফলে ক্যামেরা ভরে ভরে ছবি এসেছে বাড়িতে।
  আমরা পৌঁছলাম গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউসে। এই প্রথম গাড়ি একদম রেস্ট হাউসের সামনে আমাদের পৌঁছে দিতে পারলো। অন্যগুলির মত এরও ঘর থেকে কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য সেভাবে নেই। তবে ঘর পরিষ্কার যতই পুরনো হোক। রান্নাও ভালো। বিপদ হতে পারত। অন্যসব রেস্ট হাউসগুলির মত এখানে আমাদের আগমনের অগ্রিম খবর সরকার এনাদের পাঠায় নি। ফলে আমাদের আগে কোন ট্রেকারদল এসে গেলে আমাদের ঘর তাদের হয়ে যেত। এখানে প্রধান আবাসের মোট ৭ টি ঘর ও সুন্দর তাঁবু সদৃশ দুটি ঘর নেওয়া হয়েছে। তাঁবুগুলি থেকে সরাসরি দূরে বরফ চূড়া দেখা যায়।
  আসার পথে ভাটয়ারির আগে প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিলাম। ভারি খাবার খেয়েছিলাম। আমাদের একটা উদেশ্য ছিলই। যেখানে যা খাবার পাওয়া যাবে, পেট ভরে খেয়ে নাও, আর যেখানে প্রথম তুষারশৃঙ্গ দেখা যাবে, ছবি তুলে চোখ ভরে দেখে নাও। দুখেত্রেই পরে আর নাও পেতে পারো। আজকে সেই মন্ত্র কাজে দিলো। এদের খাবার পরিবেশনে একটু দেড়ি হল। তৈরি ছিল না যে ১৯ জনের দল এখানে আসবে। তবে মানুষজন খুব ভালো। যথাসাধ্য সাহায্য করা এদের ধর্ম। সুন্দর প্রকৃতির মানুষ সুন্দর।
 আসে পাশে জঙ্গল আছে। একটু দূরে উঁচুতে ভোলানাথের মন্দির। দলের কয়েকজন সেখানে ঘুরেও এলেন। আমরা দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় দেখতে লাগলাম আর রোদ গায়ে লাগাতে লাগলাম। এখানে ঠাণ্ডা দশের (যেদিন কলকাতায় শীতলতম দিন হয়, সেদিন দশের আশেপাশে থাকে তাপমাত্রা) আশেপাশে থাকলেও গঙ্গোত্রী হরসিলের পরে এখানে সেভাবে লাগছিল না। ফলে লেপের তলায় ঢুকতে সবার আপত্তি। বিকেলে চায়ের আসরে শুনলাম এখানে অনেক ছায়াছবির শুটিং হয়েছে। তবে বেশীরভাগ নেপালি ছবি। শুটিং শেষ হলে জায়গাটা নেপাল দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে ছবিতে। ক্যন্টিনের ইনচার্জ আমাদের গল্প শোনালেন এসব। এখন অবধি যেখানে যেখানে গেছি, আমার মনে হয় সর্বত্র শুটিং করাই যায়। কেন এখনো হলিউড এখানে পদার্পণ করেনি সেটাই বিস্ময়।
  বিকেলে আকাশ মেঘাছন্ন হয়ে পরেছে। ঠান্ডাও শূন্যের নীচে নেমে যেতে লাগলো রাত বাড়তেই। তবেকি বরফ পরবে? এর মধ্যে শুনতে পেলাম সব থেকে দুঃখের খবর। আমাদের দলের এক সদস্যের পরিচিত কয়েকজন আজকে গঙ্গোত্রী গেছেন। গেছেন ঠিক, কিন্তু থাকতে পারেন নি। কারন? তুষারপাত। আমরা বেরনোর কয়েকঘন্টা পরেই শুরু হয়েছে তুষারপাত। সেনাবাহিনী সব গাড়ি কম করে দশ কিমি নীচে নামিয়ে দিয়েছেন। হায় কপাল। কয়েকঘন্টার তফাতে আমি জীবনের প্রথম তুষারপাত মিস করলাম। ভাগ্যে ছিল না, বা অন্যভাবে ভাগ্য ভালো ছিল। কারন বরফে রাস্থা আটকে পড়লে আমাদের নামা মুশকিল হয়ে যেত, থাকা মুশকিল হত। এর পর দুঃখীমন নিয়েই রাতের নিদ্রা। ব্যাবস্থা ভালই। এখানে তিনটে বেড ছিল। ফলে আমাদের শুতে অসুবিধা হয় নি। অতিরিক্ত টাকা দিতেও হয় নি।
 সকালে মন ভালো হয়ে গেলো। কালকের বরফ ঢাকা এবং নেড়া সব পাহাড়গুলি রাতে অনেক অনেক বরফ পড়ে একদম সাদা। যেন আইসক্রিম। খুশির শেষ নেই। ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে তুলতে বুঝতে পারলাম এদের দূরত্ব খুব বেশী নয়। এমনকি বরফ শেষ যেখানে পড়েছে তার থেকে এই বাড়ির দূরত্ব সামান্যই। অর্থাৎ সেই হরসিলের মত আবার কাছে এসেও এলো না। আমরা বেড়িয়ে পরলাম সকাল সকাল। আজকে উত্তরকাশি হয়ে বারকোট যাবো। উত্তরকাশিতে সময় লাগবে, এবং রাস্থাও অনেক। তাই ৭ টায় বেড়িয়ে পরা ছাড়া উপায় নেই। তখন সবে পাহাড়ের মাথায় ধীরে ধীরে সূর্যের আলো এসে পৌঁছেছে। অপূর্ব বরফ ঢাকা পাহাড়গুলি যেন ঝলসে উঠছে। ঘোড়ায় চড়ে দিনের কাজে বেড়িয়ে পরেছেন গ্রামবাসীরা। কালকে রাতে পরিচিত হওয়া এক বাঙ্গালি ভদ্রলোক তার গাইড নিয়ে দরিয়া বুগিয়াল চলে গেলেন। আমরা গংনানি হয়ে উত্তরকাশি নেমে আসতে লাগলাম।   

উত্তরকাশিতে আবার

-------------
এক রাস্থায় ফিরতে হবে বলে , কাশিতে বিশ্বনাথ মন্দির ফেরার পথে রাখব ঠিক ছিল। সেই মত ৯টা নাগাদ এখানে পৌঁছে মন্দির দর্শনে গেলাম। মন্দিরে শিব ও শক্তি। আগে শক্তির পূজা করে চলে গেলাম শিবের মন্দিরে, পাশাপাশি। বলা হয় গঙ্গার ধারা যেখানে উত্তরবাহিনী, অর্থাৎ সাধারণ নদীর তুলনায় একটু অন্যমুখি, সেই সব পীঠস্থান কাশি নামে পরিচিত। যেমন বরানসী, উত্তরকাশি, গুপ্তকাশি প্রভৃতি। এখানে হিন্দু ধর্মের জ্ঞ্যান লাভের চর্চা হয়। প্রচুর সন্যাসি এখানে থাকেন ও বেদের জ্ঞ্যানলাভ করেন ও প্রদান করেন। এখানে ভাগীরথী তেজী কিন্তু জলের ধারা এখন শরু। মন্দিরে আমাদের পূজা ভালমতই সম্পন্ন হল। মনে শান্তি এলো। শিবের দর্শন না পাওয়া পর্যন্ত আমার মন খুতখুত করছিল। এখানে এসে যেন প্রায় সম্পূর্ণ। এরপর বাকি শুধু যমুনেত্রী। এখানে প্রাতরাশ সেরে শহর ঘুরে দেখতে লাগলাম। সবরকম আধুনিক সুবিধা প্রায় সমমুল্যে এখানে পাওয়া যাচ্ছে দেখতে পেলাম। এরপরে আর পাওয়া যাবে না আগেই লিখেছিলাম। গাড়ি সারাই হয়ে চলে এলো। আমরা উঠে বসলাম, ধারাসু বেন্ড যাবো, সেখান থেকে নতুন রাস্থায় বারকোট।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

-------------------------------
উত্তরকাশি থেকে বেড়িয়ে একটু দ্রুত এগোতে লাগলাম। কিন্তু ধরাসু বেন্ডে এসে আবার দাঁড়িয়ে পরতে হল। সামনে গাড়ির সাড়ি জানান দিলো ধস নেমেছে। খুব বড়সড় নয়। ঘন্টা খানেকের অপেখ্যা। আবার গাড়ি ধরাসু বেন্ড পেরিয়ে এবার নতুন রাস্থা নিল। ফেলে আসা তেহরির দিকে না গিয়ে ডান দিকে ঘুরে আবার চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গাড়ি চলতে লাগলো। এখানে সাধারণ পার্বত্য পথ। সেভাবে কিছু দেখার নেই। একজায়গায় মন্দিরে শিবের উপাসনা হয়, গুম্ফা আছে। ব্যাস আর কিছু নেই। বিরক্তির ঘন্টা ২ চলার পর আমরা পেয়ে গেলাম বারকোট বেন্ড। প্রধান বারকোট শহর আমাদের সামনে আসবে যখন আমরা মুসৌরির দিকে যাবো। কিন্তু আমরা ডান দিকে ঘুরে যমুনেত্রীর দিকে যাবো। তাই ফেরার পথে প্রধান শহর পাবো।
এই বেন্ডে আমাদের আজকের ঠিকানা হোটেল আদিত্য প্যালেস । প্যালেস শুনে চমকে যাওয়ার নেই। ভাড়া মাত্র ৭০০। রুম বা সমগ্র হোটেল কখনোই মনে হয় নি অন্তত প্যালেস। হটাত উঠে দাঁড়ানো শুরুতেই শেষ, দোতলা আবাস। তবে ঘর খুব সুন্দর ওপরেরগুলি। নিচেরগুলি একটু ছোট। তাই কথা বলে ভাড়া কমিয়ে ৫০০ করা হল। এখানে এক রাত থেকে দূর থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা পরের দিন ভোরে উঠে জানকীচট্টী যান। সেখান থেকে ট্রেক করে যমুনেত্রী মন্দিরে পূজা দিয়ে আবার রাতের আগেই বারকোট ফিরে আসেন। জানকীচট্টীর হিমশীতল পরিবেশ থেকে এর ফলে বাঁচা যায়। আমাদের উদ্দেশ্য তাই। ৫-৬ ঘন্টার পথ পেরিয়ে বিশ্রাম নেওয়াই উদ্দেশ্য। একটু দূরে নদীর পারে তাঁবু করে থাকাই যেত। কিন্তু পকেট অনুমতি দেয় নি। সেখান থেকে যমুনেত্রী হিমবাহের পাহাড়ের দেখা মেলে।
এই বারকোটেই আমাদের আধার কার্ড দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করতে হল। তবে দুপুরের খাওয়ার পরে। ছবিও তুলে রেখে দিলো। একটি পাস জাতিয় কাগজ প্রত্যেককে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল। যদিও কোথাও কাজে লাগে নি। তবে দেখানোর দরকার পরলে বা বিপদে কাজে লাগবে। এখানে ঠাণ্ডা অনেক কম। উচ্চতাও অনেক কমে গেছে। কাল প্রায় ৩০০০ ফুট আবার উঠবো গাড়িতে। তবে দুপুরের বৃষ্টি আমাদের পিছু ছাড়েননি। বৃষ্টি হয়ে একটু ঠাণ্ডা বাড়িয়ে দিলো। না হলে আমি গায়ে গরম জামা ছাড়াই ঘুরছিলাম।
 পরের দিন ভোরে উঠে পরলাম। ৫ টায় বেড়িয়ে পরলাম। কারন অনেকেই যমুনেত্রী মন্দিরে যাবেন। কেউ কেউ ঘোড়ায়, কেউ হয়তো হেঁটে। একটু এগিয়ে দুটো বাঁক নিতেই চমক। যমুনেত্রী হিমবাহের সঙ্গে আরও নাম না জানা দু একজন হাজির রুপের ডালি নিয়ে। এ যেন শেষ না হওয়া রুপকথা। ঘন্টা ৩ গাড়িতে থাকার পর আবার ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে গেলাম হনুমানচট্টী। এখানেও অনেকে থাকেন। এখান থেকেও হেঁটে যান। গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউস এখানেও দেখলাম। কিন্তু আমরা শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাবো। একটু চা খেয়ে পুলিশের তল্লাশি পেরিয়ে আমরা এসে গেলাম জানকীচট্টী। এটা যমুনেত্রীর বেস ক্যাম্প। এখানেও আমাদের গাড়োয়াল মন্ডলের রেস্ট হাউসে বুকিং। কিন্ত এই প্রথম ঘর নিয়ে ধাক্কা খেলাম। ম্যনেজার নেই। একজন কেয়ারটেকার। একটু বয়স্ক। আমাদের ৯টা রুম দেখাতে দেখাতে হাঁপিয়ে উঠলেন। তায় আমাদের দুটো ঘর পছন্দ না হওয়ায় ইকো থেকে ডিলাক্স রুমে পরিবর্তন করে নিলাম। বাকি ঘর গুলি আশ্বাস ছিল ১২ টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তবে প্রত্যেক রুম দুইজনের হলেও অতিরিক্ত একটি খাট আছে। আমাদের সমস্যা হল না। এই প্রথম আমাদের ঘর থেকেই দেখা দিলেন যমুনেত্রী হিমবাহ, একধারে কুলকুল করে বয়ে চলেছে যমুনা নদী। অনুভুতি স্বর্গীয় কিন্তু ঘর বড্ড নোংরা। খাবার ব্যাবস্থা ভালই। যাদের যাবার তারা চটপট আলুর পরঠা খেয়ে ঘোড়ার দাম দস্তুর করে বেড়িয়ে পরল। সংখ্যায় ৭। ঘোড়া প্রতি যাওয়া আসা নিয়ে ১০০০ টাকা। ডুলি চেপে যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল আমার স্ত্রীর। কিন্তু তারা ৮০০০ চেয়ে বসায় আমার বৌ রনে ভঙ্গ দেয়। মনটা খারাপ হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। আমরা আরও জনা ছয়েক টিফিন করে বেড়িয়ে পরলাম জানকীচট্টী ঘুরে দেখতে। মন্দিরের রাস্থা ৫ কিমি হলেও প্রথমেই খাঁড়াই। তাই ওদিকে না গিয়ে রেস্ট হাউসের খাবারের দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোকের কথা মত বেরলাম সরস্বতী শিব মন্দির দেখতে। সাধারণ পথ একটু বেশী বলে আমরা চড়াইয়ের রাস্থা ধরে উঠে গেলাম। একটু কষ্ট হলেও সৌন্দর্য কিছুই কম নয়। প্রায় ২ কিমি হেঁটে মন্দিরে পৌঁছলাম। এই মন্দিরে যমুনামাতা কার্ত্তিক পূর্ণিমার পরেই নেমে আসেন যমুনেত্রী টপ থেকে। ঠান্ডার কারনে।  যমুনেত্রী টপের মন্দির তখন বন্ধ থাকে। মন্দিরে একটি উষ্ণপ্রস্রবণ আছে। সেখানে প্রসাদ ফেলে ফুটিয়ে নেওয়া হয়। বোতলে করে জল নিয়ে আসা হয়। আর মন্দিরে পূজা দেওয়া হয়। যারা গেলেন তারা এই আচার পালন করলেন, আর আমরা মায়ের শীতকালীন আবাসে সরস্বতী মায়ের ও শিবের পূজা দিলাম। ঠাণ্ডা যমুনার জলে ছেটা আর গুরুগম্ভির মন্ত্রোচ্চারণে পরিবেশ মধুর করে ফিরে গেলাম প্রধান রাস্থায়। এখান থেকে দেখা গেলো মন্দিরের ঠিক মাথায় যমুনেত্রী হিমবাহ। আর পাশে বয়ে চলেছে যমুনানদী। হু হু করে বয়ে চলা হাওয়া, সেরকম ঠাণ্ডা পরিবেশ।
 আমরা চললাম গাড়োয়ালী গ্রাম দেখতে এরপর। গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্থা পেরিয়ে অনেকটা হেঁটে পৌঁছলাম শনি-নাগ দেবতা মন্দিরে। মুল মন্দিরটি চারশ বছরের পুরনো। পাথর ও কাঠ দিয়ে তৈরি। সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ভেতরে আলো খুব কম। মন্দিরের নীচে স্থানীয় রামলীলার আয়োজন হচ্ছে। একটু দুরেই নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। ভেতরে ঢোকার জায়গা দেখলাম না। বাইরে থেকে প্রণাম সারলাম। শুনলাম শনি দেবতা এখন বদ্রি মহারাজের ওখানে গেছেন। নাগদেবতা আছেন। মন্দিরের পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে তুষারশুভ্র পর্বতের উপস্থিতির বিরাম নেই। দেখা শেষে ফিরতে লাগলাম। এখন অপেখ্যাকৃত সহজ লাগলো উৎরাই বলে। নীচে একটা ঝুলন্ত সেতু আছে। সেটা পেরিয়ে যমুনা পেরতে হয়। দেখলাম এখানেই যমুনার দূষণ শুরু। ক্লান্ত পদযুগলকে টেনে নিয়ে রেস্টহাউসে ফিরে দেখি এখনো ঘর বসবাস যোগ্য হতে দেড়ি আছে। অগত্যা সামনের উঠানে বসেই হিমবাহ দর্শন। এত কাছ থেকে হিমবাহ অনেকেই দেখেন নি। এখন একটু ঠাণ্ডা কম তাই পাহাড়ের গায়ে বরফ গলে যাচ্ছে। যারা ওপরে গেছিলেন তারাও ধীরে ধীরে ঘোড়ায় ফিরলেন। তবে ততক্ষণে আমাদের দুপুরের খাবার হয়ে গেছে। তাড়া ফিরে এসে জানালো ওপর থেকে ঝর্না দেখা যায়, কিন্তু পর্বতমালা আর নতুন কিছু দেখা যায় না। অনেকে মন্দির থেকে হিমবাহ অভিযান করেন। কিন্তু সেই দলে আমাদের কেউ ছিল না।
সব ঘর পরিষ্কার হতে হতে বিকেল হয়ে গেলো। বিকেলে সবার যে যার ঘরে ব্যাগ রেখে একটি ঘরে মেয়েরা ও একটি ঘরে ছেলেরা গল্প, তাস সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিতে থাকল। আমি একবার ওই ঠান্ডায় বাইরে এসেছিলাম। চাঁদের আলোয় অপার সৌন্দর্যের রুপ আমার সামনে বিকশিত হয়েছিল হিমবাহের। যমুনার কুলকুল শব্দ এখন যেন গর্জন। শুনলাম এখানে কয়েকমাস আগে মেঘফাটা বৃষ্টি ও সঙ্গে হড়কা বানের কবলে পড়ে এই রেস্ট হাউস বরাত জোরে বেঁচে যায়। হারিয়ে যায় সামনের একটি হোটেল। আজকেও উষ্ণতা শূন্যের নীচে। তাই বেশী দেরী না করে শুয়ে পরাই মঙ্গল। কাল ফিরব মুসৌরি। অনেক পথ।

 গাড়োয়ালের আলিগলি

------------------------------
সকালের প্রথম আলোয় ঝলমলে যমুনেত্রী হিমাবাহ চোখ ধাঁধানো রুপ নিয়ে সামনে হাজির। কাল রাতে পাহাড়ের চুড়ায় বরফ পড়েছে। আরও সুন্দর আরও মসৃণ। কিন্তু আমরা একটু জলদি বেড়িয়ে পরছি প্রত্যেকদিন। আজকেও ব্যাতিক্রম নয়। আজকে আমাদের দুই সহযাত্রী দেবেশ-মনিকা আমাদের ছেড়ে পারি দিচ্ছেন কেদারনাথের পথে। তাদের বারকোট নামিয়ে দিয়ে যাবো। সেখানে বাসে করে উত্তরকাশি ফিরতে হবে তাদের। উত্তরকাশি থেকে শ্রীনগর হয়ে গুপ্তকাশির পথে চলে যাবেন। আমরা এগিয়ে যাবো মুশৌরির পথে। সেই মত আবার ঘন্টা দুই চলারপর বারকোট বেন্ডে পৌঁছে ধরাসুর দিকের রাস্থায় না গিয়ে দেহরাদুনের দিকে গাড়ি চলতে লাগলো। এসে পৌঁছলাম বারকোট শহরে। বারকোট বেন্ড থেকে ৮ কিমি দূরে। এখানে খাবারদাবারের ভালই ব্যাবস্থা আছে। কিন্তু অপরিচ্ছনতা ও অস্বাভাবিক দাম যেন সর্বত্র। এর মধ্যে খবর এলো চরম অব্যাবস্থা সম্পন্ন জানকীচাট্টী গাড়োয়াল মণ্ডলের রেস্ট হাউসে, স্নানকরার সময় পড়ে গিয়ে রুদ্রাণী(দত্ত) মামির হাতের হাড় সম্ভবত চিড় ধরেছে। তাঁরা অন্য গাড়িতে আমাদের পেছনে আসছেন। আমরা একটু খোঁজাখুঁজি করে এক্সরের দোকান পেয়ে গেলাম ঠিক, কিন্তু খুলতে দেরী। তবে মুশৌরিতে হোটেলে ফোন করে সেখানে এক্সরে করার ব্যাবস্থা করা হল। আমরা প্রাতরাশ সেরে নিলাম। দেবশদাদের বাসে তুলে দেওয়া হল। আমাদের দুটি গাড়ি একত্রিত হয়ে এগিয়ে গেলাম  মুশৌরির পথে। আবার ঘন্টা ৪ এর বিরক্তিকর গাড়ি যাত্রা। ঘণ্টা তিনেকের কিছু সময় পর আমাদের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পর্বতরাশি উন্মুক্ত হল। গাড়োয়াল রেঞ্জের প্রায় সবকটি পর্বত এখান থেকে দেখা যায়। তবে আজকে একটু বেলা হয়ে যাওয়াতে মেঘে ঢাকা। ফলে আমাদের একটু দমেই থাকতে হল। এরপর এলো কেম্পটি ফলস। এখানে আজকে নামলাম না। এগিয়ে চললাম শহরের দিকে। আরও প্রায় ৪৫ মিনিট গাড়ি চলার পর ম্যাল রোডের সামনে এসে গেলাম। কিন্তু আমাদের হোটেল দ্বীপ ক্যামেল ব্যাক রোডে। সেটি ম্যালের শেষ প্রান্তে। তাই পাশের গাড়ি চলার রাস্থা দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে একদম পেছনের দিকে নিয়ে দাড় করানো হল। এখান থেকে বাকি প্রায় ৭০০ মিটার হেঁটেই যেতে হবে। প্রায় সমতল রাস্থায় হেঁটে যাওয়া সমস্যার নয়। কিন্তু সঙ্গের মালপত্র কুলি ছাড়া নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কুলি ভাড়া ১১০ টাকা, গাড়িতে উঠিয়ে দিলে আর একটু বেশী। আমাদের ১৩ জনের মালপত্র একদম কম নয়। পাঁচজন কুলির দরকার পরল।
হোটেল দ্বীপ ভালই লাগলো। আমাদের ঘর ছিল ৪ তলায়। তবে লিফট আছে। সামনে খোলা বারান্দা। সেখান থেকে কেদার পর্বত দেখা যায়। তবে আজ বিকেল হয়ে যাওয়ায় আমাদের ভাগ্যে কিছু নেই মেঘের জন্য।
দুপুরের খাবার খেতে বিকেল হয়ে গেলো। পড়ন্ত সূর্যের আলোয়, বারান্দায় বসে হাল্কা শীতের আমেজে আমাদের খাবার শেষ হল। আজকে সন্দীপ মামারা বেড়িয়ে যাবেন কলকাতার উদ্দ্যেশে, দিল্লী হয়ে, মামির হাত কালকে সকালে দিল্লীতে দেখিয়ে বিমানে চেপে বসবেন। সন্ধের আগেই মামারা বেড়িয়ে পরলেন দেহরাদুনের উদ্দেশ্যে। আমাদের মহিলাকুল ও তাদের স্বামীরা গেলেন বাজার করতে। এই ভ্রমণের শেষ দিন কাল। তাই যার যা বেঁচে আছে পকেটে সেটা খরচ জরুরী। আমি ভাগ্যক্রমে সঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেলাম। রেহাই পেলেন গ্রুপের নেতা সুগত বসুও। কিন্তু দুজনে মিলে পরশু ফেরার পরিবর্তিত স্থান নিয়ে চালক সাহেবের সাথে কথা বলে নিলাম। একটু বেশী (২০০০ মত) দিতে হবে, কারন আমরা হরিদ্বার নামবো বলে এসেছিলাম, কিন্তু টিকিট কুম্ভ এক্সপ্রেসে না পাওয়ায় সাহারানপুর হয়ে যাওয়া পাঞ্জাব থেকে আসা গুরুমুখী এক্সপ্রেস আমাদের গতি। ফলে পরশু আমরা উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর যাবো। ফলে রোড ট্যাক্স অতিরিক্ত লাগবেই।
পরের দিন সকাল হতেই ঝলমলে কেদার শৃঙ্গ আমাদের সামনে, হোটেল দ্বীপের ছাদের থেকে দৃশ্যমান। তবে সব পাহাড়ি শহরের মত মুশৌরিও দূষণে আক্রান্ত। ফলে একটা কুয়াশা-ধোঁয়াশা ভাব রয়েছে।একদিকে ঘড়িঘর, সেইদিকেই সূর্য উঠলো। সকালের খাবার বাইরেই খাবো। তাই সূর্যদয়ের একটু পরেই বেরলাম। আজকে মুশৌরি ঘুরে দেখবো। শেষে ম্যাল হয়ে কেনাকাটা করে বাড়ির জন্য প্রস্থুত হবো। এক স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে। মুশৌরি শহর সম্পর্কে বলি, ইংরেজ জেনারেল ফেড্রিক ইয়ং এর শখ হয়েছিল শুটিং গেম খেলতে, তিনি এখানে এসে মুশৌরি ও ল্যন্ডর নামে দুটি হাওড়া - কলকাতার মত জমজ শহর মত্তন করেন এই প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায়। এখানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানেই থেকে যান। প্রথম গোর্খা বাহিনী তৈরি করেন ও আলুর চাষ করেন। আমরা যে ক্যমেল ব্যাক রোডে আছি সেখানেই উনি একটি শুটিং স্পট তৈরি করেন। সাহেবি শখ। পরে এখানে ক্যন্টন্মেন্ট তৈরি হয়। ঘড়িঘর তৈরি হয়। মানে ইতিহাসের পুরো এক প্যকেজ। আমাদের পরের দিনের যাত্রা শুরু ঘড়িঘর দিয়ে। শরু রাস্থায় একটু এগিয়েই কাছেই ঘড়িঘর দেখে মনটা ঐতিহাসিক করে যখন কেম্পটি ফলস এর দিকে এগলাম তার মাঝে দেখে নিলাম সর্বচ্চ পয়েন্ট লাল টিব্বা। এখান থেকে হিমালয়ের দৃশ্য বড়ই মধুর। তবে হাল্কা কুয়াশা আছেই।ক্যামেল ব্যাক রোড এখান থেকে দেখতে অনেকটা উঠের পিঠের মতই। তাই এই নাম।
কেম্পটি পৌছতে ৪৫ মিনিট লাগলো। সেখানে খানিক নামার পর কেবল কারে চেপে ঝর্নার পতন স্থানে নামা ও ওঠা সম্ভব। ফলে ওঠা নামার হ্যাপা এড়ানো যায়। শুধু উঠতে ১০০, ওঠা নামা ১৫০। আমরা ওঠা নামা কেটে চেপে বসলাম। মিনিট খানেকের যাত্রায় একদম নীচে নিয়ে আসে। তবে মুল স্নান করার জায়গা আর একটু ওপরে। আবার উঠতে হয়। সেখানে স্নান করার ব্যাবস্থা আছে। আছে ব্রিজে দাড়িয়ে ছবি তোলার উপায়। এছাড়া যেখানে কেবল কার থেকে নামলাম, সেখানে চা খাওয়া সম্ভব, সম্ভব গাড়োয়ালি পোশাকে সজ্জিত হয়ে ছবিতোলা। আমরা ঘন্টা খানেক সব করলাম। তারপর উঠে এসে একটি হোটেল দেখে দুপুরের খাবার সারলাম। বিশ্রামের সময় নেই, গাড়ি ফিরে এসে নামিয়ে দিলো ম্যালরোডের মুখে। এখান থেকে হেঁটে বা রিক্সায় হোটেল ফিরতে হবে। আমরা পদব্রজে কেনাকাটা করতে করতে এগিয়ে চললাম। দাম এমনকিছু কম নয়। বরং বেশী। খানিক বিশ্রামে কফিশপে কফি পান। আবার হন্টন। এবার পৌঁছলাম "গান হিল" যাবার কেবেল কারের নীচে। কয়েকজন ওপরে উঠলো এতে চেপে। কিন্তু আমরা বিরত থাকলাম।  "গান হিল"থেকে সমগ্র  মুশৌরি এবং দেহরাদুন শহর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বিকেলের দিকে কুয়াশার দাপট বেশী থাকায় দেখা সম্ভব নয় দেখেই আর অতিরিক্ত খরচ করি নি। এরপর হেঁটে হোটেল ফিরে আসা আর রাত কাটিয়ে পরের দিন ট্রেন ধরার প্রস্তুতি।
এখানেই কাহিনী শেষ হতে পারত। কারন পরের দিন ৬ টায় বেড়িয়ে আমরা ১১ঃ৩০ এর ট্রেন ধরতে ছোটায় দেহরাদুন শহর ঘোরার বা সহস্রধারা জলপ্রপাত দেখার সময় পাই নি। কিন্তু দেহরাদুন শহর পেরতেই, সাহারানপুরের রাস্থা ধরতেই আবার সমতল ছেড়ে উঁচুতে উঠলাম ও নামলাম। মাঝে পেরিয়ে এলাম একটা জাতীয় উদ্যান। যার নাম রাজাজী জাতীয় উদ্যান। এটি সম্পূর্ণ ধারনার বাইরে ছিল। ভেবেছিলাম একটা জঙ্গল পেরতে হবে। সেটা যে রাজাজী জাতীয় উদ্যান তা বোর্ড দেখে জানতে পারলাম ও উৎসাহিত হলাম। তবে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্থা হলেও সেভাবে কিছু নজরে আসে নি হনুমানের দল ছাড়া। জঙ্গলের গন্ধ নিয়েই সমতলে নামতে হল। সমতলের রাস্থাও বেশ খানিকটা খুব বাজে।  সাহারানপুরের একটু আগে থেকে রাস্থা ভালো হয়েছে। যাই হোক গুরুমুখী এক্সপ্রেস সঠিক সময় এসেছিল। তাতে চেপে ৩ ঘণ্টা দেরিতে কলকাতা স্টেশন পৌঁছে আমাদের যাত্রা শেষ হয়। এক স্বপ্ন যা এখনো মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে। সারা জীবনের সম্পদ হিসেবে।

আমাদের যাত্রাপথ আর একবারঃ কল্কাতা-দিল্লী-হরিদ্বার-ধনৌল্

টি-টিহরি-উত্তরকাশি-হরসিল-গঙ্গোত্রী-বারসু-উত্তরকাশি-ধরাসু বেন্ড-বারকোট বেন্ড-যমুনেত্রী-বারকোট শহর-মুশৌরি-দেহরাদুন-সাহারানপুর-কলকাতা।

শুক্রবার, ৫ মে, ২০১৭

কুমায়ুনের খাতা

পর্ব-১
প্রায় ৮ মাস আগে যখন বাবন - লিপির হানিমুনের সঙ্গে নিজেকে জুড়েছিলাম তখন বুঝিনি, আমাদের থাকা কত জরুরি ছিল। ধীরে ধীরে সব লিখবো। মুন্সিয়ারি যেতে না পারার আক্ষেপ করেছিলেন রশনি মুখার্জি। চলুন বলে ডাক দিয়েই ফেললাম। সংশয় ছিলই। একদম চিনিনা, পছন্দ-অপছন্দ, বায়না, মানিয়ে চলার ক্ষমতা, কোনটাই একদম জানি না। "দেখা যাবে যা হবে" ভেবে শুরু হল আয়োজন। সুকুর থেকে প্ল্যান নিয়ে নিজে খানিকটা পরিবর্তন করে সাজিয়ে ফেললাম সব কিছু। ব্যাবস্থা মত, কিছুটা আমি কিছুটা অর্নবদা মিলে রাজধানী শতাব্দী লাল কুয়া গাড়ি গুলর টিকিট কেটে নিলাম। তার পর দিন গোনা শুরু।
দেখতে দেখতে এসে গেলো ৪র্থ এপ্রিল। বিকেলে চেপে গেলাম রাজধানী। শতাব্দি অনেক উঠলেও রাজধানী প্রথম। মনে একটা আনন্দ শুরু হয়ে গেলো। সঙ্গে থাকুন, ধীরে ধীরে এগতে থাকব।


পর্ব-২
রাজধানী চলতে শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও। রিতিমত ঝর তুলে এগিয়ে চলেছে। ভেতরে অনেক কষ্টে লিপি বাবুন কে আমাদের কাছে আনতে পারলাম। এক সরদারজি ও এক বিহারী বাবু সিট পরিবর্তন করায় আমরা একসঙ্গে হতে পারলাম। একটু পরেই জামাই আদর শুরু। খাবার - জল - চা সবই জুটল। দুর্গাপুর-আসান্সল-ধানবাদ-গয়া-মুঘল সরাই-কানপুর হয়ে একদম সঠিক সময় আমরা ঢুকে পরলাম দিল্লি। সকাল সকাল। এদিকে গরমের ভয়। শুনলাম উষ্ণতা ৪০ ছুঁয়েছে। নেমেই কুলি ধরে মালপত্র নিয়ে ছুটে "গিঙ্গের"। স্টেশন থেকে দু পা। ঘেমে গেলাম। কিন্তু হোটেল ভারি সুন্দর। খাবার ব্যাবস্থা আছে। ঘর পাওয়া মাত্র বিশ্রাম নিলাম ছোট করে। বাতানকুল যন্ত্র ঘরটিকে হিমেল করে রেখেছে। এই হোটেলে টেবিল-ফিটেড হিটার আছে। যেখানে জল গরম করে চা - কফি খাওয়া যায়। আমি এক কাপ চা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে তৈরি হতে থাকলাম দিল্লি ঘুরব। এক কাপ করে চা ও কফি বিনা পয়সায় প্রত্তেকের জন্য।
একটু সূর্যদেব শান্ত হতেই বেরিয়ে পরলাম. অর্নবদা অসুস্থ হওয়ায় আমরা ৭ জন বেরলাম। ধারনা ছিল দিল্লিতে সব কিছু দামি। দুপুরে খাবার ও বেশ দামি ছিল। যদিও সবকিছু কলকাতা ভাবলে ভুল হবে। যাইহোক, একটা অটো ও একটা ৪ জন বসার গাড়ি মোট ১০০০ টাকায় ঠিক করে ফেললাম। ঘুরে দেখাবে লালকেল্লা, হুমায়ুনের কবর, পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতি ভবন, ইন্ডিয়া গেট, জন্তরমন্তর। সস্থা মনে হল। বেরিয়ে পরলাম লালকেল্লা। মিনিট ১৫ -২০, চোখের সামনে অভূতপূর্ব মুঘল স্থাপত্ত। সাহজাহান তার রাজধানী সাহজাহানাবাদকে সুরক্ষিত করতে লাল পাথরে মোরা এই দুর্গ ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এটি তৈরি করেন। এখন ভারতের গৌরব হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। লাহোরি গেট থেকে ৩৫ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে এক ইতিহাসের পাতা পড়ে ফেললাম। ভেতরে আছে বিভিন্ন মহল। কোনটি সম্রাটের রাজ্যসভা তো কোনটি প্রমদ ভবন। পাথরে পাথরে ইতিহাস। শেষ মুঘল সম্রাটদের এখানেই কোতল করে ইংরেজরা। ঢুকে দেখলাম, প্রচুর ইংরেজ-রাশিয়ান-তুরকি এমন কি বাংলাদেশী সবাই হাজির।
গলায় ক্যামেরা ঝুলতে দেখে দুই রাশিয়ান ললনা তাদের ক্যামেরায় তাদের ছবি তুলে দিতে অনুরধ করে। এই টুকু অথিতি সেবা করা আমার ধর্ম। করেও দিলাম।
লালকেল্লা দেখার পর, এগিয়ে গেলাম হুমায়ুনের কবরের দিকে। মাঝে গাড়ি থেকেই দেখলাম রাজঘাট। কিন্তু বন্ধ ছিল। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন পত্নি হামিদা বানু, তার পতির স্মৃতিতে এই অদ্ভুত ও সুন্দর শিল্পকর্ম নির্মাণ করেন। অনেকটা তাজমহলের মত হলেও শ্বেতপাথরের নয়। ঘুরে দেখলাম। ঢিমেতালে বৃষ্টি শুরু। আবার উঠে পরলাম গাড়িতে।
ঘুরতে ঘুরতে পউছেগেলাম ইন্ডিয়া গেট। মুশলধারে বৃষ্টি। তাই গাড়িথেকেই গেট দর্শন। লিপি বাবুন ভিজে ভিজেই চলে গেলো দেখতে। বাকিরা আইসক্রিম খেতে লাগল। তবে শহর পরিষ্কার নয়। এমন কি কলকাতা আমার মনে হল এর থেকে পরিষ্কার।
ফেরার পথে বৃষ্টির মধ্যেই রাষ্ট্রপতি ভবন ও নর্থ সাউথ ব্লক দেখে নিলাম। ভারি সুন্দর লাগল। বলে রাখি। বিকেলে ধীরে ধীরে পরিবেষ ঠাণ্ডা। বৃষ্টির জন্য হতে পারে। তবে ২-৩ দিন লাগবে দিল্লি দেখতে। আবার আসবো।
ফিরে এলাম হোটেল। গাড়ি সস্থা হলে কি হবে, খাবারের বিল ছেঁকা দিল। গোলাপজামুন ১২০ টাকায় ২ টো। কি আর করা। গরমে বাইরে খেতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিল মিটিয়ে শুয়ে পরলাম। তবে আমরা যাব আর আড্ডা হবে না? বেশ খানিখন আড্ডা দিলাম। দেখলাম অর্নবদা আমাদের মতই মানুষ। জমবে ভালই। রোশনিদি আমুদে। বাবুন লিপি দুই মিষ্টি বাচ্চা।
এক ঝটকায় রাত কাবার। ক্লান্ত শরীর হলে যা হয় আর কি। এদিকে ভোরে হোটেল ছেড়ে দিলাম। পরিবেষ ঠাণ্ডা। কিন্তু কুলি পাওয়া গেল না। অগত্যা নিজেদের বইতে হল। আজকে আমরা শতাব্দী ধরে যাব কাঠগুদাম। এখান থেকেই শুরু হবে পাহার চরা। সঙ্গে থাকুন। এবার ধীরে ধীরে বাড়বে ঠাণ্ডা।






পর্ব-৩
বিরক্তিকর অপেক্ষা। শতাব্দী কিছুতেই প্লাটফর্ম পায় না। মাত্র ২০ মিনিট আগে এলেন। ঝপাঝপ মালপত্র তুলে নিলাম। শতাব্দীতে একটি বড় সমস্যা মালপত্র ঠিকঠাক রাখা। প্রায়শ দেখেছি যাত্রীদের মধ্যে ঝামেলা হতে। কিন্তু এযাত্রায় আমাদের এক গাড়ি মালপত্র উঠে পরল ঝামেলা ছাড়াই। প্রসঙ্গত বলি, রোশনিদি বাড়িতে তৈরি দারুন সুস্বাদু কাপ কেক রাজধানীতে খাইয়েছে। খবর পেলাম তার দু একটি বেঁচে আছে। মাথায় একটু প্ল্যান চলছিলো, কি করে হাতান যায়। কিন্তু শুনলাম ওটা সুফি ও আমার মেয়ের জন্য। নিরস্ত্র হলাম। শতাব্দী খুঁড়িয়ে চলতে লাগল। এই প্রথম দেখলাম এত কম দূরত্বে কোন শতাব্দী এত সময় নিচ্ছে। এত হোঁচট খেয়েও তিনি প্রতি স্টেশনে সঠিক সময় পৌঁছে যাচ্ছেন।
কিন্তু রামপুর স্টেশন ঠিক আমাদের পোষায় নি। যাত্রা শুরু ও শেষে এই স্টেশনে আমাদের ভাল যায় নি। এই স্টেশনে পৌঁছতে শুনলাম শুভাদীপ বমি করছে। অসুস্থ। বমি করলে যা হয়। প্রায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে। শতাব্দীর খাবার হজম হয় নি। এমনিতে শুভাদীপ হল সাত বোন চম্পক। তার একজন সেখানে উপস্থিত। তাই বোঝা যাচ্ছে হুরহুরি কি পর্যায় হবে। তবে আমাদের চন্দন বদ্দির ওষুধ জফার এম ডি ৪ এই সব ক্ষেত্রে অব্যর্থ। কৌষিকী ওষুধ দিতে সামান্য সুস্থ হল। আজকে সিতালাখেত যাব। এই অঞ্চল একটু দুর্গম। রানিখেত থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তাই আগে থেকে ফোন করে আমাকে বলে দিতে হল রাতে ও বিকেলে কি খাব।
ট্রেন থামতেই মালপত্র নিতে ঠেলাগাড়ি হাজির। হাজির আমাদের সারথি চন্দন আরজ। যাকে আমি গতকাল থেকে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে মাত্র একবার সফল হয়েছি।
ভিপিন উপেরেত্তি, জিনি কুমায়ুন ট্রিপ বলে সংস্থার কর্ণধার। তিনিই আমাদের কাঠগুদাম থেকে সব ব্যাবস্থা করেছেন শুধু সিতলাখেত ছাড়া। তার সংস্থার চালক চন্দনজী হাজির স্টেশনে। জানি না আমাদের এত মালপত্র দেখে কিনা, উনি প্রথম আমাকেই জিগ্যাসা করেন যে আমিই ওনার গেস্ট কিনা। তাই খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় নি একটুও। "কুমায়ুন ট্রিপ" আমাদের জন্য ইনভা গাড়ির ব্যাবস্থা করেছে। যদিও আমি ত্রাভেরা চেয়েছিলাম ইনভা দামি বলে। এটা একপ্রকার কমপ্লিমেন্ট। ঝকঝকে নতুন গাড়ির মাথায় শুধু নয়, পেছনের ছোট ডিকিও ভরে গেলো আমাদের ব্যাগে। বেশ গরম লাগছে। একটু পড়ে ঠাণ্ডা হবে।
রোশনিদির ভরে আনা এক পেনড্রাইভ গান চালু হতেই পাহাড় চরা শুরু। প্রাতরাশ শতাব্দীতে হলেও দুপুরের খাবার ঠিক হল কাঞ্ছি মঠের পাশে দোকানে হবে। মন ভরানো গান শুনতে শুনতে প্রথম দাঁড়ালাম ভিমতালের পাশে। এখানে সামান্য অপেক্ষা। কারন শেষে আবার আসব এখানেই। এর পর কাঞ্ছিমঠ। এখানে দুপুরের খাবার ঠিক হল। নিরামিশ। মোটেই ভালো খাবার নয়। এছাড়া উপায় নেই। মঠ দর্শন করেই পেট পুজ। প্রাকৃতিক দৃশ্য বড়ই মধুর। পাহাড় ঘেরা এই মঠে মহারাজের সমাধি দেখে নিলাম। একটি ছোট সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। তলায় মৃতপ্রায় কোশী নদী বলেই শুনলাম। তার ধারেই খাবার দাবার আয়োজন।
শুভাদীপের শরীর খুব খারাপ । উপায় নেই। আমরা রানিখেত পৌঁছলাম। ওখানে মন্সকামন মা কালি মন্দির দেখে সোজা গলফ কোর্স। আকাশের মুখ ভার। কোন শৃঙ্গ নজরে আসছে না। মন খারাপ। গাড়ি ছুটল সিতালাখেত।
সিতালাখেত নামলাম সন্ধে হয় হয়। চারিদিকে জঙ্গল। মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। আগের দিন দিল্লিতে রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। আজকেও পাহাড়ে হবে। বনজঙ্গল যেন অপরূপ সাজে সেজে উঠল।
নিচের তলায় ডিলাক্স ঘর আমাদের জন্য থাকলেও আমরা ২০০ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে ওপরের সুপার ঘরে ঢুকে গেলাম। তিনটে ঘর। চার পাশে বৃষ্টির শব্দ। চূড়ান্ত নির্জন ও মহময়। গরম গরম কফি সহজগে ইংরেজ আমলে তৈরি সুবিশাল ঘর আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। গা ছমছমে পরিবেশে থাকব আজকের রাত।






পর্ব-৪
প্রসঙ্গত বলি, ধীরে ধীরে শুভদীপ সুস্থ হয়ে গেল, কিন্তু মনস্কামনা মন্দির থেকে লিপি দিদিমনি ফীলিং ওয়াক ওয়াক। অর্থাৎ রানিখেত থেকে সিতালাখেত, চন্দন বদ্দির ওষুধ শুভাদীপকে সুস্থ করলেও লিপির কাজ করে নি। পতির বেদনা পত্নী গ্রহন করলো আর কি। তাই হিমেল হাওয়া, গা ছমছমে পরিবেশ সঙ্গে চারদিক ঘেরা বনজঙ্গল, কোন কিছুই প্রাথমিক ভাবে লিপির কাছে ভালো লাগার কথা নয়। তবে ঘরে ঢুকে বিশ্রাম নেওয়া খানিকটা সুস্থ করে তুলল।
এই জঙ্গলে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কোন বন্য শব্দ কানে আসে নি। চিতা আছে, এক দুটি রয়াল বেঙ্গল ও আছে, ওপরে ট্রেক করে যাওয়া মন্দিরের আশে পাশে। বন মোরগ, শূয়র দু চারটি এদিক ওদিক চোখে পড়েছে। আর আছে সবুজ ও সবুজ। পর্বতের সারি এখান থেকে দেখতে পাওয়া যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু আজ মেঘে ঢাকা। রাতবাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডা বেড়ে চলেছে। মাঝে মাঝে মুশল ধারে বৃষ্টি। ব্রিটিশ স্তাপত্তে তৈরি এই বাড়িটি যেন কত রহস্যে মোরা।
রাতে মুরগির ঝোল সহজগে পেটপুজ শেষ হতেই বিছানা লাভ। গরম গরম কম্বল, সে যতই গা কুট কুতে হোক, আরাম দেবেই। এদিকে কোলকাতা ৪০ ডিগ্রিতে ফুটছে। গোল পাকলো রাত ৩ঃ৩০ নাগাদ। আমাদের ঘর গুলির সামনে একটা লম্বা গাড়ি বারান্দা মত বারান্দা আছে। ওখানে আমরা কিছুখন আড্ডা দিয়েছি, পকরা কফি খেয়েছি। বাসন পড়েআছে। সেখানে খুটুর খাটুর শব্দ। একটুপরে দরজায় আঁচড়ানোর শব্দ। আমি উঠে ভেতর থেকে হুস হাস শব্দ করলাম। কিন্তু থামল না। এই শব্দ আমি দুয়ারস এও শুনেছি। তখন জন্তু বলেই ধরেছিলাম। এখন একটু অন্যরকম লাগল। কৌষিকী উঠে পড়েছে। শুনেই বলে "আমি বাড়ি যাব"। ভয় যে একটু করবেই সেটাই স্বাভাবিক। যাই হোক শব্দ আরও কিছুক্ষণ হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো।
সকালে বিনা পয়সার প্রাতরাশ খেতে বসে সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করলো ওটা কুকুর ছিল। কিন্তু, কিছু ব্যাপার, যেমন কুকুর হলে হুস হাস শব্দে পালিয়ে কেন গেলো না বা অন্তত কিছুক্ষণ থেমে থাকত। খাবার বাসন অনেকক্ষণ ওখানে ছিল, তবে এত রাতেই বা কেন খেতে এলো। যাই হোক আমিও সেই সময় এসব বলে ওদের ভয় বাড়াতে চাই নি।
সকালে অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে, কিছু নতুন ধরনের পাখি দেখে ও জঙ্গল সাক্ষী রেখে বিদায় জানালাম সিতালাখেত কে। ভালো লেগেছে। আবার আসবো। কর্মচারিদের আতিথেয়তা মন ভরিয়ে দিল।
চললাম পরবর্তী গন্তব্য কৌশানি। বলা হয়, গাড়োয়াল ও কুমায়ুন হিমালয়ের সব কটি শৃঙ্গ এখানে দৃশ্যমান। কিন্তু আমাদের কপালে নেই। রাস্থায় ঘন মেঘ। ধীরে ধীরে মুশলধারে বৃষ্টি। আনাসক্তি আশ্রম প্রথম পৌঁছলাম। এই আশ্রমে গান্ধীজী থাকতেন। কৌশানি গান্ধীজীর খুব প্রিয় ছিল। উনি একে ভারতের সুইজারল্যান্ড বলেছেন। কিন্তু হায় তার আশ্রম থেকে আমরা শুধু মেঘ আর মেঘ, সঙ্গে মুশলধারে বৃষ্টি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এমন কি ভেতরে ঢোকাও হল না। নিস্ফল প্রচেষ্টা করলাম শৃঙ্গ দেখার। এখানে একটি উঁচু বেদি করা আছে। সেখানে উঠে সব শৃঙ্গ দেখা সম্ভব। বেদিতে দিকনির্দেশ দেওয়া আছে, দিকনির্দেশ দেখে শৃঙ্গ চেনা সম্ভব। আমরা শুধু মেঘ দেখলাম।
গাড়ি এবার সোজা হোটেল উত্তরাখন্ড। এই হোটেলে আজকে রাত থাকবো। ভাবছিলাম একদিন বেশি থাকা যায় নাকি। তবে আকাশ একদম মেঘে ঢাকা। তাই লাভ নেই। এই হোটেল পরিষ্কার হলেও সেই পুরনো আমলের। খাওয়া দাওয়া ভালো। একদিকে উন্মুক্ত। সেদিকেই শৃঙ্গরাজি হাজির থাকার কথা। এখন নেই। বরং এখন আমাদের জন্য গরম গরম কফি ও শিলাবৃষ্টি । মন্দ নয়। পাহাড়ে শিলা পরলে বরফ পড়তে পারে। কিন্তু আজকে পরবে না। ফেব্রুয়ারী বা মার্চ হলে আশা থাকত। এবছর অবশ্য এপ্রিলেও বরফ পড়েছে ১-২ তারিখ। আজ বিকেলের বাদে সব খাবার বিনামুল্যে। অর্থাৎ "কুমায়ুন ট্রিপ" সংস্থার প্যকেজে। তবে নির্ধারিত। সেই মত দুপুরের খাবার খেয়ে বারান্দায় আড্ডা চলল। এর মধ্যে হনুকুল হাজির। রোশনিদি ও কৌষিকী এক প্রস্থ দাঁত খিচানির স্বাদ পেয়েছেন। তবে কামরায় নি। করার কিছু সেভাবে নেই। আছে বসে বসে পাকদণ্ডি রাস্থা দেখা ও পাশের মন্দিরের ঘণ্টা শোনা। মাঝে মিটিয়ে দিতে হল বাকি টাকা।
বিকেলে বৃষ্টি থেমে গেলো। ধীরে ধীরে ত্রিশুল ও নান্দাদেবী পর্বতমালা স্পষ্ট হচ্ছে। সন্ধে থেকে জমিয়ে আড্ডা চালু পকরা ও ডিম ভুজিয়া সহযোগে। রাতে ঠাণ্ডা জমিয়ে পড়েছে। এটা অনেকটা শহর শহর। তাই বন্য পশুর আশা নেই। রুদ্রপ্রয়াগে ভুমিকম্পের খবর পেলাম। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু নেই।
সকালে একটু জলদি ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পাখির আনাগোনা ভালই। লাকি বার্ড বলে এক ধরনের ছোট পাখি দেখলাম। ছবি তোলা খুব মুশকিল। আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। তবে কুয়াশা আছে। ত্রিশুল, নান্দাদেবী, নান্দাকোট হাজির। ৩টে মাথাওলা ত্রিশুল, চ্যাপ্টা মত নান্দাদেবী এবার কামেরায় ও এসে গেল। মনে আনন্দ। তবে আজকে যেতে হবে অনেক পথ। প্রায় ৮ ঘণ্টা পেরিয়ে মুন্সিয়ারি। স্বপ্নের গন্তব্য।












পর্ব-৫
যেহেতু শেষ বেলায় ত্রিশুল ইত্যাদি শৃঙ্গ দর্শন হয়েছে, তাছাড়া চন্দনজী ও আসতে একটু দেড়ি করলেন, তাই কৌশানি থেকে যাত্রা শুরু করতে একটু দেড়ি হয়ে গেলো। প্রায় ১০ঃ২৫, গাড়ি ছাড়ল। গন্তব্য মুন্সিয়ারি। স্বপ্নের গন্তব্য। কিন্তু পথমধ্যে আমরা যাব বাগেশ্বর, বইজনাথ মন্দির, চাকউরি, থল, বিরথি জলপ্রপাত হয়ে। লম্বা ও কঠিন যাত্রা। অনেকটা উঁচুতে উঠব। চিন্তা সুফিকে নিয়েও। বাচ্চা মানুষ। কিন্তু এখন অবধি দারুন সুস্থ। একবার ও বমি করে নি। বমি করে বিখ্যাতরা এখন অবধি সুস্থ, যেমন কৌষিকী, আমার মেয়ে, সুফি। আর পাহাড় চরে চরে হি ম্যান হয়ে যাওয়া শুভদীপ, লিপি এর মধ্যেই খাতা খুলেছে, আমি ও অর্নবদা লজেন্স খেয়ে গা গোলানকে থামিয়ে রেখেছি। রোশনি দি ফিট। বড্ড বেশি পাকদণ্ডি। এই বামে তো এই ডানে। পশ্চিমবঙ্গীয় পর্বতের রাস্থার সঙ্গে চূড়ান্ত অমিল। হটাত হটাত নেমে আসছি অনেক নিচে, আবার উঠে যাচ্ছি। এই ঠাণ্ডা তো এই গরম। সঙ্গে গাছের অপ্রতুলতা। জানি না বসন্ত বলে কিনা, পাহাড় লাল হয়ে অপরুপ সুন্দর, কিন্তু সবুজের বড়ই অভাব। আজকে টের পেতে লাগলাম। মাঝে মধ্যে শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো। হু হু করে বয়ে চলেছে হাওয়া, তবুও নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো।
আজকে আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টির নাম নেই। সূর্য দেব প্রখর কিরন নিয়ে হাজির। প্রথম থামলাম বইজনাথ মন্দির। এটি বাগেশ্বর থেকে একটু আগে। মন্দিরটি একটু নেমে হেঁটে যেতে হয়। পাশে বয়ে চলেছে সরযূ নদী (স্থানীয় মত অনুসারে)। হেঁটে খানিকটা গিয়ে মন্দির দর্শন হল। মন্দিরটি অনেক পুরনো। অস্টম কি নবম শতাব্দীর। মন্দিরে শিল্প অনেকটা উড়িষ্যা বা দক্ষিণ ছোঁয়া। প্রধান বিগ্রহ শিব ও তার সর্পকুল। পাথরে তৈরি মন্দিরের সামনে একটি জলাশয় আছে। যেখানে কুমির আছে বলে মনে হল। ধীরে ধীরে মন্দির দর্শন সম্পন্ন করলাম।
খানিকটা এগিয়ে বাগেশ্বর সঙ্গমে হাজির হলাম, আবার খানিকটা নেমে নদীর ধারে গেলাম। এখানে সরযূ ও গোমোতি নদীর সঙ্গম। সুন্দর মন্দির ও মহাদেবের মূর্তি আছে। দেখে নিলাম। বড্ড গরম। লিপির শরীর খুব খারাপ। রাস্থার পাশেই বসে পরল। চোখে মুখে জল দিয়ে গাড়িতে এ সি চালিয়ে আবার যাত্রা শুরু। বাগেশ্বর একটি পাহাড় ঘেরা উপত্যকা। উচ্চতা ১০০০ মিটারের একটু বেশি। নিচু বলেই গরমে ভালই গরম পরে। গাড়ি একটু পাহাড় চরতেই একবার থেমে সকলে প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে নেমে গেল। একটি হোটেল আমাদের ব্যাবস্থা করে দিলেন নিখরচায়। আপ্লুত হলাম।
সারথি চন্দনজী, লিপির অসুস্থতার কারনে স্বল্প দীর্ঘের রাস্থা ধরলেন। চাউকরি ও থল ফেরার পথে। তবে এ রাস্থাও খুব একটা কম নয়। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের সাথে দেখা রামগঙ্গা নদীর। এঁকে বেঁকে আমাদের সাথে চলতে থাকলো। একটা বাঁক নিতেই দেখতে পেলাম বরফ ঢাকা পিণ্ডারি হিমবাহ। এর থেকেই উতপন্ন পিণ্ডারি ও রামগঙ্গা। দূরে ছাদের মত চ্যাপ্টা বরফ ঢাকা পিণ্ডারি হিমাবাহ। এখন একটু বরফ কম লাগলো।
রাস্থার পরিমান যত দীর্ঘ হচ্ছে, লিপির অসুস্থতা বেরে চলেছে। মাঝে একটি রাস্থার ধারের হোটেলে প্রায় ৪ টের সময় দুপুরের খাবার খেলাম। মাঝে কিছু চোখে পরে নি। খাবার একদম ভালো না। সবাই পেট ভরে খেতে পারে নি। প্রথম মন ভরে গেল বিরথি জলপ্রপাতের সামনে এসে। প্রবল বেগে জলধারা নিচে আছরে পড়ছে। একটি নদীর আকারে বয়ে চলেছে। নেমে মন ভরে দেখে নিলাম। ছবি তোলা শুরু হল। চা পান ও ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবিতোলা। পথের ক্লান্তি খানিকটা কমিয়ে দিল।
নেই নেই শেষ নেই, সন্ধে হতে দেড়িহয় এখানে। প্রায় ৭ টায় সন্ধে নামলো। আমাদের গাড়ি এখন চলেছে। মাঝে একটি ব্রিজ পেরতেই দেখা শিয়াল বাবাজির সঙ্গে, গাড়িতে কেউ চিতা তো কেউ নেকরে বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। আসলে দেখা গেলো শিয়াল। তবে আকৃতি বড়। ওই সামান্য মজা করেই পথের ক্লান্তি ভুলে থাকা। উচ্চতায় ওঠা।
একটা বাঁক সম্পূর্ণ করে চন্দনজী গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন। বললেন দেখিয়ে। আমাদের মুখ হাঁ হয়ে গেলো। চোখের সামনে ইয়া ইয়া বড় সাদা পর্বতমালা। সন্ধের আধোআলোয় ভয়ঙ্কর সুন্দর। আমি এসব খেত্রে দুম করে গাড়িথেকে নামি না। রোশনিদিরা নেমেছিল। নামতেই হাড় ফুটো করে দেওয়া হিমেল হাওয়ার সামনে। মুখ দিয়ে হু হু করে শব্দ বেরিয়ে এলো। বেচারা সুফি, নেমেই এত ঠাণ্ডা পেয়ে হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ির ভেতরে উষ্ণতা অনেক বেশি।
প্রথম পঞ্চচুল্লি দর্শন। পরিষ্কার আকাশ। অল্প চাঁদের আলো। মোহময়। সামনেই মিলাম ইন। আমাদের থাকার জায়গা।










পর্ব-৬
মিলম ইন হোটেলটা খুব ছিমছাম কিন্তু সুন্দর জায়গায়। ঘর থেকে পঞ্চচুল্লি সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। সঙ্গে সঙ্গে হংসলিঙ্গ ও চিতল কেদার পর্বতমালাও দেখা যায়। যেহেতু "কুমায়ুন ট্রিপ" এর নিজস্ব হোটেল, তাই খাতির একটু বেশি। তবে প্রধান কর্মী বসান্তজী তুলনাহীন সারভিস দেন। আপ্যায়ন করলেন কফি দিয়ে। ওপরের ঘর গুলির ৩টি আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। শুভাদীপদের ঘর বেছে নিয়ে আমরা গল্প করতে লাগলাম সেইদিন। এত ধকল কাটিয়ে আড্ডা দেবার ইচ্ছা দমিত হয় নি। গরম গরম পকরা সহযোগে ভুতের গল্প বেশ জমে উঠেছিল। রুমের ভেতর থেকে উঁকি দিতেই একদিক পুরো কাঁচের হওয়ায় সোজা চন্দ্রাহত পঞ্চচুল্লি, অন্যদিকে মন্দিরের ঘণ্টা। স্বর্গ বোধয় একেই বলে।
রাত তখন ৩ঃ৩০। হটাত রুম ফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল। আমি পড়ি মরি করে ফোন ধরতেই অন্যপ্রান্তে শুভাদীপের ভয়ার্ত কন্ঠ। "লিপির খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।" ধরমরিয়ে উঠে বসলাম। একটু সময় নিয়ে বেরনোর আগেই দুজনে হাজির আমাদের রুমে। লিপির খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রায় ৪ টে নাগাদ ফোনে তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। যদি কোন ওষুধ বিশেষ ব্যাবস্থা করা যায়। কাকুর কথা মত ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ান হল। ওই সময় নিচে নামতে বলা হলেও, হিসেব করে দেখলাম ওদের পক্ষে নামা সম্ভব নয়। বাকি সময় আমি ঘুমইনি। ধীরে ধীরে পঞ্চচুল্লির ঠিক পেছন থেকে সূর্য উঠল। শীতকালে অপরুপ কিন্তু এখন একটু দেরিতে। তাই সেই রকম সুন্দর নয়। ধীরে ধীরে কালো থেকে সাদা হয়ে গেলো। এই রুপের সামনে অনবদাও ঘুমতে পারে নি। রাতে উঠে উঠে পঞ্চচুল্লির রুপ দেখেছে। কিন্তু বাকি সবাই কুম্ভকর্ণের বর-প্রাপ্ত। সহজে ঘুম থেকে ওঠে নি। লিপিও ঘুমিয়েছে। আমাদের ঘরে।
আজকে শুভাদীপ লিপির সঙ্গে ছিল। আমরা একটু দেড়িকরেই বেরলাম। উদেশ্য নন্দাদেবী মায়ের মন্দির। সঙ্গে মিউজিয়াম দর্শন। বেশি কিছু দেখার নেই এখানে। যাই হোক, নন্দাদেবী মন্দিরে ঢুকে আমরা হতবাক। এক রুপের ঢালি নিয়ে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ সহ হাজির সবাই। আহা। চোখ জুরিয়ে গেলো। আকাশ একদম পরিষ্কার। আমাদের সামনে আরও সুন্দর হয়ে পঞ্চচুল্লি, চিতল কেদার, হংসলিঙ্গ, এমন কি নন্দাদেবী পর্বতমালাও। মন্দির টি বিরাট সবুজ প্রান্তরের মাঝ খানে। প্রায় সমতল ওই প্রান্তরে নেই কোন ধর্মীয় বাঁধা। বাচ্চারা বেশি খুশি। তারা খেলে বেরাতে লাগলো। প্রান্তরের যেকোনো প্রান্ত থেকে উন্মুক্ত দৃশ্য মোহ এনে দিলো। কিন্তু আমি ভুল করেছি। ক্যামেরার ব্যাটারি চার্জ করতে দিয়েছিলাম। পুনরায় ক্যামেরায় ভরতে ভুলে গেছি। তাই মোবাইলদিয়েই তুলে শান্ত থাকতে হল।
অনেক্ষন কাটিয়ে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে, নন্দাদেবীমা কে প্রনাম জানিয়ে আমরা বিদায় নিলাম। মা খুব জাগ্রত। এবার গন্তব্য স্থানীয় এক মানুষের তৈরি মিউসিয়াম। সেখানে একটু উঁচুতে উঠতে হয় ঠিক, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চমকে উঠতে হয় সংগ্রহে। বহুপুরনো তিব্বতি ত্রিপিটক পাথরে খোদাই থেকে শুরু করে মিলম হিমাবাহের ভিডিও। সব পাওয়া যাবে। আমি একটি বই সংগ্রহ করলাম।
এর পরে আবার হোটেলে ফেরত। সেখানে বসেই সারাদিন পঞ্চচুল্লি দর্শন। পুরনো হবে না কখনই। ধীরে ধীরে সাদা থেকে হাল্কা লাল হয়েই ঘুমের দেশে চলে গেলেন। পুরাণ মতে এই পঞ্চচুল্লি যা কিনা আসলে ৫ টি ভুমি সংযুক্ত প্রায় সম উচ্চতার পর্বতমালা, ছিল পাণ্ডব পত্নী দ্রউপদীর পাঁচ স্বামীর পাঁচটি উনুন। এর মাথায় রান্না করেছেন বলে মহাভারত বা পুরানে নথি আছে। এই পাঁচ শৃঙ্গএর মধ্যে পঞ্চচুল্লি - ২ সব থেকে উঁচু। ৬৯০৪ মিটার। Panchachuli-1 (6,355 m), Panchachuli-3 (6,312 m), Panchachuli-4 (6,334 m), Panchachuli-5 (6,437 m)। মাহেন্দ্রা সিং এর নেত্রিত্বে ইন্দটিবেটান পুলিশের একটি দল প্রথম সব থেকে উঁচু চুড়ায় ওঠে।
আমরা রুমে আলসেমি করে ও সামনের লনে আড্ডা দিয়ে দিন কাটিয়ে দিলাম। আজকে রাতে রিস্ক নি নি। লিপিকে আমাদের ঘরে কৌশীকীর জিন্মায় রেখে আমি শুভাদীপের ঘরে ছিলাম। রাতে সেরকম ঝামেলা হয় নি।
সকালে উঠতেই একটু তাড়াতারি বেরনোর প্রয়াশ করতেও ৯ঃ৩০ এর আগে বেরতে পারলাম না। আজকে আমরা ঠুমরি কুণ্ড ট্রেক করবো। জঙ্গলে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে হেঁটে হ্রদ দেখতে যাবো। পথে মিলতে পারে বন্য জন্তু। রাস্থা কঠিন ও গাছমছমে। সে এক অভিজ্ঞতা। পরের পর্বে।
















পর্ব-৭
ঠুমরীকুণ্ড যাবার জন্য যেখানে হাঁটা শুরু হয় সেখানে আমাদের গাড়ি এসে থামল। বলে রাখি, মুন্সিয়ারি আসা ইস্তক আমার ও একটু একটু শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো সকালের দিকে। গাছপালা কম নেই। তবে কেমন যেন অক্সিজেন কম মনে হতে লাগলো। এখানে নেমে প্রথমেই শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তারপর যখন হেটে যাওয়ার রাস্থা দেখলাম, আমার আশার বেলুন সাথে সাথে সশব্দে ফেটে গেলো। রাস্থা একদম সোজা নয়। বেশ চরাই উৎরাই । সঙ্গে সরু রাস্থা ও একদিকে খাদ। নিরিবিলি প্রকৃতি। মাঝে মাঝেই গাছের ফাঁক থেকে পঞ্চচুল্লি ও অন্যান্য চূড়া উঁকি দিচ্ছে। আরও পরিষ্কার, আরও কাছে। যা আছে কপালে বলে উঠতে ও নামতে লাগলাম। আমি একটু ধীরে। মেয়ে তার মার সঙ্গে। অনব দা ও শুভাদীপ সুঠাম শরীর নিয়ে উঠতে লাগলো। সব থেকে অদ্ভুত পথপ্রদর্শক। তিনি গুনে গুনে ৮০০ টাকা নেবেন, কিন্তু ছুটছেন সবার আগে। সাধারণত এরকম হয় না। অন্তত সারমেয়কুল যদি আপনার পথপ্রদর্শক হয় তো কথাই নেই। কিন্তু এখানে সারমেয়কুল নেই। পথপ্রদর্শক বাবুর নাম মনে নেই। কিন্তু আমাকে একবার ধমক দিতে হল। ধমক খেয়ে উনি শুভাদীপের সঙ্গে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু ওদের হাঁটার গতি অনেক বেশি। আমি সবার শেষে। পুরো দূরত্ব ৩.৫ কিলোমিটার। আমি এক এর একটু কম গিয়ে আর পারলাম না। তার পর কানার মত চলতে গিয়ে খেলাম গুঁত। প্রায় মৃত এক রাস্থা আটকে থাকা গাছে গুঁত খেয়ে মাথা কেটে হাল্কা রক্ত পরল। আমি আর এগোয় নি। মেয়েকে নিয়ে ফিরতে লাগলাম। মেয়ের মাকে ঝারা হাত পায়ে কুণ্ড দর্শন করতে সুযোগ করে দিলাম। মেয়ে পাড়ত। কিন্তু আমি নিয়ে ফিরে এলাম। অনবদা উৎসাহ দিয়েছিল। কিন্তু আমি উৎসাহিত হতে পারি নি। তবে রাস্থার ধারে ফুটে থাকা লাল গুরাস বা রডডেনড্রন, গাছের ফাঁকে উঁকি দেওয়া পাহাড়, ও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিরিবিলি পাথুরে রাস্থা। জঙ্গল ট্রেক হিসেবে এক অপূর্ব স্বর্গ। কুণ্ডটি বরফ গলা জলে পূর্ণ।
উত্তারাখান্ড দেব ভুমি, তাই পদে পদে জড়িয়ে পুরাণ। এই কুণ্ড নিয়ে গল্প হল, এই কুণ্ড একসময় নইনিতালের থেকেও বড় ছিল। স্থানীয় আদিবাসিদের কন্যাকে দেবতারা চক্রান্ত করে এখানে লুকিয়ে রেখেছিলো। তাই স্থানীয় আদিবাসিরা কুণ্ডটি খুঁড়ে দেয়। অনেক জল বেরিয়ে যায়।
ফেরার পথ মোটেই মসৃণ নয়। কখন উঠতে কখন নামতে হচ্ছে। সিঁড়ি বলতে পাথরের খাঁজ। একটু অসতর্ক মানেই পরে যাওয়া। দুটি থাকে উচ্চতা কম নয়। ফলে হামাগুরি দিয়েও উঠতে হতে পারে। এদিকে আমার দম একদম শেষ। রাস্থায় দেখলাম জন্তুর হাগু। ঘোড়া হতে পারে, ভালুক হতে পারে। তবে টাটকা। এদিকে আমরা দুজন। মনে ভয় ধরে গেলো। শেষ শক্তি নিয়ে বাকি রাস্থা কিভাবে পেরিয়েছিলাম আমি নিজেই জানি না। যাওয়ার পথে রাস্থার শোভা দেখেছি। ফেরার পথে দ্রুত রাস্থা শেষ করেছি। তবে বাকিরা কষ্ট করে হলেও কুণ্ডে পৌঁছেছে। কুণ্ড মানে জলাশয়। ঠুমরী খুব সুন্দর একটি কুণ্ড। আর এই রাস্থাও একদম প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে। অপূর্ব লাগবেই। লোক কম, ফলে হুরহুরির সুবিধা নেই। তবে বন্য জন্তু আছে। তাই পথপ্রদর্শক ছাড়া না যাওয়াই ভালো।
আমি আর মেয়ে ফিরে এসে গাড়িতে প্রাতরাশ সারলাম। লিপি শুরুই করে নি। আমি আর লিপি বাজি ধরলাম, কৌষিকী ও রশনি দি এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরবে কিনা তার ওপরে। আমার বিশ্বাস ছিল না। আমরা নিচে অপেখ্যা করতে থাকলাম বিরক্তিকর ভাবে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে ওরা সবাই, মানে কৌষিকী, রোশনিদি, অনবদা, সুফি সবাই কুণ্ড দেখে প্রায় ৩ ঘণ্টা পরে ফিরে এলো। শুভদীপ শেষ করতই। অনবদাও। কিন্তু বাকিদের নিয়ে সংশয় থাকলেও তাড়া শেষ অবধি গিয়ে আবার ফিরেছে। পথপ্রদর্শক বাবু যথারীতি আগে আগে দৌড়েছে, শুভাদীপ সবার আগে আসবেই, ওর গতি বেশি, আর ও পেছনের লোকের জন্য অপেখ্যা করে না। ফলে ভুটানের মত সমস্যাও হয়। তবে এখানে সমস্যা হয়েছে বাকিদের। পথপ্রদর্শক বাবু সুযোগ বুঝে শুভাদীপের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে, ফলে বাকি ধীর গতির ট্রেকাররা একটু সমস্যায় পড়েছে। অনবদা সাহায্য করেছে বলে রক্ষ্যে।
ফিরে এসেই শুভাদীপ গুরাস দিয়ে লিপি কে ছাব্বিক (কাব্বিক থেকে নেওয়া, ব্যাকারন মানি না) ভালোবাসা প্রদান করে বসলো। আমার বউ ও ফিরে এসেছে। মুখে বিজয়ির হাঁসি। সঙ্গে আমি কেন পারলাম না তার এক গুচ্ছ কারন। :) কখন উঠে আসছে ধুম্রপান তো কখন অতিরিক্ত ওজন। আমার সবথেকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে ওজন অতিরিক্ততা। যার ফলে আমি হাপিয়ে গেলাম। আমাদের বিয়ে ১০ বছর হতে চলেছে, কিন্তু এখন আমার বউ ফেরার পথে আমার জন্য গুরাসফুল আনতে ভোলে না। গুরাস ফুল দিলো।
গাড়ি ফিরে এলো হোটেল। এক গামলা খাবার নিমেশে শেষ করে আমাদের আজকে ঘুম দিতেই হল। বিকেলে কষা মুরগি সহযোগে বন-ফায়ার হবে যে। ঘুম ভাঙ্গার একটু পরেই, মিলম ইনের ভেতর দিকের গাড়ি রাখার অঞ্চলে ফাঁকা জায়গায় কাঠ সাজিয়ে রাখা। মুরগি রোস্ট হয়ে আসছে। সব সুদ্ধু ২৪০০ টাকা। একটু পরেই আগুন জলে উঠল। ৬ যুবক-যুবতি ও দুই শিশু আনন্দে মেতে উঠল। হল নাচা গানা। সঙ্গে ফুর্তি চূড়ান্ত, যা দীর্ঘদিন স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যাবে।











পর্ব-৮
মুন্সিয়ারির শেষ রাত সমগ্র ভ্রমনের আয়ুর মধ্যে সব থেকে সুন্দর রাত। লিপিও প্রায় সুস্থ ছিল। সবাই খুব আমোদ করেছি। জ্যোৎস্না রাতের মায়াবি পঞ্চচুল্লির সামনে, মহময় পরিবেশে বন ফায়ার চিরকাল স্মরণীয়। বিশেষ উল্লেখ আমাদের খুদে সদস্য সুফি। সে আজকে এমনি একার চেষ্টায় ৭ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্থা অতিক্রম করেছে, বাবার কোলে খুব কম উঠে। এটা তার প্রথম ট্রেক ছিল। প্রথমেই সফল ওই ৫ এর থেকে কম বয়েশি। এর আগে আর এক খুদে "টিনটিন" যে আরও ছোট, নিজেই হিলে-বারসে ট্রেক করেছিল। গল্প পড়েছি। আজকে দেখলাম। সেই আনন্দ যেন বন ফায়ারে আরও মজা এনে দিলো। তাই পরের দিন সকালে হোটেল ছাড়তে মন চাইছিল না। কিন্তু দীর্ঘ পথ আবার অতিক্রম করতে হবে। থল-চাউকরি হয়ে আমরা যাবো বিন্সার জঙ্গলের পাশ দিয়ে কাসার। অর্থাৎ গভীর জঙ্গল। শেষ বারের মত ছবি তোলা হোল। আজকে এখন পঞ্চচুল্লি দেখা দিচ্ছেন ফুটফুটে।
ফেরার পথে প্রথম বাঁধা, লিপির ফোন ফেলে আসা। গাড়ি ঘুরে আবার চলল হোটেল। প্রায় ৫ কিলমিটার। আমি যাই নি। আমি অনবদা ওখানেই নেমে গেলাম। কারন? চোখের সামনে অপূর্ব দৃশ্য। বসন্তের লালাভ গাছের পাতা যেন এক অনুভুতি। এঁকে বেঁকে চলেছে রাস্থা তার মাঝে। আর ফাকে ফাকে উঁকি দিচ্ছেন ধবল পর্বতমালা। কিছু ছবি চটপট তুলে ফেললাম। ওদের একটু কষ্ট হোল, আমার মন ভরে গেলো। গাড়ি ফিরতেই দ্বিতীয় বাঁধা। আমাদের একটি ব্যাগ ছিঁড়ে রাস্থায়। যদিও পাওয়া গেছে, তবে প্রাথমিক ভাবে বুঝতে আর একটু দেড়ি হলে বা খাদে পরলে দরকারি কাগজপত্র সব নষ্ট হত। তবে সারথি চন্দনজী মুখ বুজে আমাদের পরিষেবা প্রদান করে গেলেন। উনিই দৌরে ব্যাগ নিয়ে এসে শক্ত করে বাঁধলেন। প্রায় আবার ১০ টা বেজে গেলো মুন্সিয়ারি ছাড়তে। আবার আসবো।
মুন্সিয়ারি থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম থল। এখানে রামগঙ্গা দেখা দিল। একদম কাছে। লিপির শরীর লম্বা ভ্রমনে কখনই ঠিক ছিল না। কিন্তু রামগঙ্গা ওকে সতেজতা এনে দিলো। রৌদ্র প্রখর। কিন্তু হিমেল হাওয়া। ফলে গরম লাগছিল না। একটি জায়গায় গিয়ে একদম প্রায় নদীর সমতলে গাড়িটি দাঁড়িয়েগেলো। একটু নামলেই রামগঙ্গা। সবাই নেমে পড়লাম। তিস্তার সঙ্গে তুলনা চলে। অনেকটা এক জলের রঙ। তবে এখানে মাছ আছে। পায়ে সুড়সুড়ি দিতে আসছে। সাহসি। জলে নামতে কেউ ভয় পেল না। আমি নামলাম না। কারন আমি চিত্রগ্রাহক। সামান্য পদস্খলন বহু দামি ক্যামেরা গুলির বারটা বাজিয়ে দেবে। সঙ্গে রয়েছে মুন্সিয়ারির স্মৃতি। বাকিরা হিমেল জলে পা ভেজাতে লাগলো।
এর পরেই থল। একটু বড় জনপদ। এখানেই দুপুরের খাবার খাওয়া হল। ঠিক ছিল ধুউলচিনা বলে একজায়গায় খাবো, ভাগ্যিস এখানে খাবারের সিধান্ত নিয়েছিল অনবদা। নাহলে সেদিন রাতের আগে খাবার মিলত না। খাবার মান খুব ভালো নয়। ভাত, রায়তার ডাল, ডিম ভাজা সহযোগে অল্প বিস্তর পেট ভরিয়ে আবার ছোটা শুরু।
রাস্থা আর শেষ হয় না। বিকেল বিকেল পেরলাম চাকউরি। জঙ্গলে ঘেরা দারুন প্রকৃতি। কিন্তু এখন পর্বতমালা কুয়াশায় ঘেরা। তাই ভাগ্যে কিছু জুটল না। বেশিক্ষণ সময় নষ্ট না করেই এগিয়ে চললাম। সবাই বমির হাত থেকে বাঁচতে ঘুমন্ত। শুধু পথ মধ্যে এক স্থানীয় ছোট দোকানে চায়ের জন্য ও লিপিকে সুস্থ করতে নামা হল। একবার উঠছি তো একবার নামছি। একবার গরম তো একবার ঠাণ্ডা। এর ফলেই সঙ্গে মনে রাখার মত পাকদণ্ডি, যে কেউ শরীর খারাপ করে ফেলবে। যাই হোক চা খেতে মন ফুরফুরে হল। চাদোকানের মালিকের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে। এসেছিল আমাদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। সুফির তো খুব পছন্দ। আজকেই পারলে বিয়ে করে ফেলে। ওর মা, হবু বউমার ছবি ইত্যাদি নিয়ে এসেছে। ভবিষ্যৎ কি বলে সেখা যাক।
আবার বিরক্তিকর যাত্রা। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামবে। সূর্য ডুবতে চলেছে। হটাত সামনে বেশ বড় একটি গাছ ধপাস করে পরল। না ধস নয়। কয়েকজন মিলে গাছটিকে কোতল করলো। দেখে মনে হয় নি গাছটি মৃত বা কাটার উপযুক্ত। অরন্য ধ্বংস। মনে হল বন বিভাগের লোক। অর্থাৎ সরকারি খুন। শুনেছি এই অঞ্চলে প্রচুর গাছ। কিন্তু পেলাম কই? অর্থাৎ প্রচুর খুন খারাপি হয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় আলো নেই এমন সময় হটাত চন্দনজী আসল রাস্থা ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেলেন। বললেন এটাই আসল বিন্সার জঙ্গল। কালকে আপনারা অনেক নিচে কেএমভিএন এর লজে বা জিরো পয়েন্ট জেতেই পারেন কিন্তু জন প্রতি ২৫০ টাকা ও গাড়ির জন্য ২০০ টাকা গুনতে হবে। তার থেকে আসল বনপথ দিয়ে চলুন। কিছু দেখলেও দেখতে পারেন। বরং কালকে কাসার দেবী মায়ের মন্দির ও আলমোরা চিরিয়াখানা ঘুরিয়ে দেবো। প্রস্থাব মন মত হল। খরচের চাপ পড়েছে। তাই আরও অতিরিক্ত খরচ করতে ইচ্ছা হল না। জঙ্গলের ভেতরে কাঁচা রাস্থা ধরে এগতে থাকলাম। আমার সঙ্গে জন্তুদের সম্পর্ক আছে। আমি গাড়িতে থাকলে নিদেন পখ্যে একটা হরিনতো দেখাই যাবে। মুন্সিয়ারি ঢোকার মখে শিয়াল ও হরিন দেখেছিলাম। এখানেও কিছুটা এগতেই বাচ্চা হরিন আমাদের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেলো। একটু এগতেই গলু দেবতার ছোট্ট মন্দির। গাছমছমে জঙ্গল। তবে ঘনত্ব আমাদের উত্তরবঙ্গের থেকে অনেক কম। এর একটু এগতেই কৌষিকী দর্শন পেল কালো কালো হামাগুরি দেওয়া বাচ্চা কোন পশু। পাথরের ফাঁকে এক ঝলক। নিশ্চয়ই ভালুক বাচ্চা। একদম নিরাশ হতে হল না। বাঘ বাঘ ভেবে অনেক কিছুই দেখলাম, কিন্তু চিতা সেই চিরিয়াখানায়।







পর্ব-৯
কাসার পৌঁছলাম। কাছেই কাসার দেবী মায়ের মন্দির। আমরা থাকব কাসার জঙ্গল রিসর্ট। একটি তিন তারা হোটেল। জঙ্গলে ঘেরা। ৪ টি করে ঘর নিয়ে একটি ব্লক। আমাদের অভ্যর্থনা করলো মকটেল সহযোগে। আয়োজন ভালই। ঘর একটু গা ছমছমে ও একদম গাছপালায় ঘেরা। কাছেই বিন্সার জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। কুমায়ুন মণ্ডলের রিসর্ট দেখা যায়। বিদেশীদের পছন্দের। কারন জঙ্গলে ঘেরা ও খুব সুন্দর ভিউ আছে। ঘর পরিষ্কার। তবে জঙ্গল হলে যা হয়। অল্প বিস্তর মাকড়শা জাতীয় উতপাত। রাত টা ঘটনাহীন হতে পাড়ত। হয় নি। খাবার টেবিলে বসতেই হাতে ছ্যাকা লাগলো। প্রায় কিছু না খেয়েই হাজার চারেক টাকা খসে গেলো। তিন তারায় এত খরচ আগে পাই নি। পরিমান প্লেট হিসেবে কম। রাতে অত রাস্থা অতিক্রম করে ক্লান্ত থাকলেও আমরা তিন ছেলে মিলে অনেক রাত পর্যন্ত বকবক করেছি। গাছমছমে পরিবেষ গায়ে মেখে।
সকাল আজকে দেড়ি করে হল সবার। তবে আমি সেই ভরেই উঠে পড়েছি। কুয়াশা ঘেরা দৃশ্য। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে সেই ত্রিশুল ও নন্দাদেবী চূড়া দেখা যাচ্ছে। বাকি সব ঢাকা। অল্প সময় দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো। শুভাদীপদের ঘর থেকে ভালো দেখা যাচ্ছিল। আমাদের নিচের তলায় গাছের জন্য দৃশ্য বাঁধাপ্রাপ্ত। তবে জঙ্গল দর্শন খুব ভালো হচ্ছে।
১০ টা নাগাদ গাড়ি চেপে বেরলাম। সামনে সস্থার হোটেলে প্রাতরাশ সেরে ধীরে সুস্থে এগিয়ে চললাম কাসার দেবীমার দর্শনে। একটু এগিয়ে চন্দনজী থেমে গেলেন। ওপরে দেখিয়ে বললেন ওই যে মায়ের মন্দির। ওপরে উঠে দর্শন করুন সময় কাটান। আমি আজকে একদম রিস্ক নিতে চাইছিলাম না। কিন্তু সবাই উৎসাহ দিলো। অনবদা প্রায় তুলে নিয়ে গেলো। এই রকম লোক সঙ্গে থাকলে উৎসাহ অনেকগুন বেরে যায়। ধীরে ধীরে পাথরের রাস্থায় উঠতে উঠতে মনে মনে মা কে ডাকলাম। অন্তত দর্শন দিয়। একটু অসুবিধা হলেও ৬০০-৭০০ মিটার এই খাঁড়াই রাস্থা আমি পার করে দিলাম। হাঁটুতে ব্যাথা হয়েছে। তবে আজকে হার মানি নি। অরনবদার উৎসাহ আমাকে আজকে সফলতা দিলো। ওপরে উঠে মায়ের দর্শন করলাম। ওপর থেকে দৃশ্য খুব মনরম। সমগ্র আলমোরা দেখতে পাওয়া যায় প্রায়। সঙ্গে শীতকালে অবশ্যই শৃঙ্গ দর্শন হয়। আজকে কুয়াশার চাদর সরিয়ে হল না। এখানে দেখলাম স্বামী বিবেকানন্দ তপস্যা করেছেন। মন্দিরটি একটি গুহার বাইরে অবস্থিত। গুহায় বসেই তপস্যা করেছেন স্বামীজি। মন্দিরের পুজারী হটাত কি হল, আমাকে একটি টিপের পাতা দান করলেন। আমি গ্রহন করলাম। আরও ওপরে মহাদেবের মন্দির তৈরি হচ্ছে। আমি উঠিনি। অরনবদা ও শুভদীপ গেছিলো। কিছুক্ষণ থেকে নেমে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম বিদেশীদল ওপরে উঠছে। ঘেমে নেয়ে একশা। এদিকে আমাদের ঠাণ্ডা লাগছে। হাই হেলো বলে নেমে এলাম।
এবার গন্তব্য আলমোরা চিরিয়াখানা। টিকিট কেটে উঠতে লাগলাম। একটু উঠে দেখতে পেলাম দুই মহিলা ও এক পুরুষ চিতাবাঘের। কয়েকজন ওপরে উঠেছিলো। হরিন দেখতে। কিন্তু বেশি ওপরে ওঠার দম রাখতে পারে নি। নেমে এসেছে।
এর পর গেলাম গলুদেবতার মন্দির। মহাদেবের রুপ। অনেকেই এখানে কামনা করে ঘণ্টা বেঁধে রেখেছেন। ঘণ্টায় ঢাকা রাস্থা দিয়ে মন্দিরে যেতে হয়। মন্দিরে বাঁদরের উতপাত ভালই। ভেতরে মন ভরে প্রনাম করলাম।
আজকে লিপি সুস্থ আছে। বিকেলে কোন কাজ নেই। সামান্য ভাত ঘুম দুপুরে দিয়েই বিকেল থেকে নিখাদ আড্ডা। সঙ্গে ভৌতিক আলোচনা। ভুতুরে জঙ্গলে ভৌতিক আলোচনা জমে উঠল। যদিও কালকের থেকে আজকে লোক বেশি, তবে জঙ্গলের মধ্যে হওয়ায় গা ছমছম বেশি করেছে। এত দিনে আমরা যেন একটা পরিবার হয়ে গেছি। আর মাত্র একটি স্পট। ব্যাস ভ্রমন শেষ। মন খারাপ। আর দুই রাত থাকবো আজকের পরে। রাতে অনেখন গল্প হল।
সকালে উঠে ক্যামেরা নিয়ে বেরলাম। পাখির আনাগোনা ভালই। একটি কালো মাথার জয় পাখি সুন্দর ভঙ্গিমায় ধরা দিলো। ব্যাগ পত্র গোছান ও গাড়িতে তোলাসম্পন্ন হতেই আমরা রওনা দিলাম নৈনিতাল।













 পর্ব-১০
সকাল ৯ঃ৩০ নাগাদ চন্দনজী হাজির গাড়ি নিয়ে। আজকে আলমোড়া বাইপাস ধরে নিলাম। সময় সংক্ষিপ্ত করতে। পথে বালমিঠাই কিনে নিলাম বাড়ির জন্য। এই মিষ্টিএকটু অদ্ভুত। এখানে পাওয়া যায় কিনা জানি না। করাপাক লম্বাটে ও গায়ে হাল্কা বাঁধুনিতে ছোট নকুলদানা লাগানো। খেতে গেলে ঝরে পরবেই। রস হীন। আর এক রকম নিলাম, নাম টা বলল চকলেট, কিন্তু মিষ্টি। ২৪০ টাকা প্রতি কেজি দুটোই। মন একটু খারাপ। এতদিনের ভ্রমন প্রায় শেষের পথে। সঙ্গীরা প্রায় পরিবার। কিন্তু সব কিছুর শেষ আছে। সেই মত শেষ ভ্রমন স্পট নৈনিতাল পৌঁছলাম। রাস্থায় একটু দাঁড়িয়ে কষ্ট করতে হয়েছে, রাস্থা সারাই হচ্ছিলো। গরম ভালই ছিল। চন্দনজী ও কুমায়ুন ট্রিপ ম্যাহেমাননওাজি ভালই করেছে সারা ভ্রমন। গাড়িতে সমতল বা উপত্যকায় এলেই বাতানকুল যন্ত্র চালু করে দিয়েছেন। আজকেও চালু করতে হয়েছিল খানিখন। আবার পাহাড়ে উঠতেই যন্ত্র বন্ধ।
একটু পরেই "তাল" দেখতে পেলাম। বুঝে গেলাম নৈনিতাল এসে গেছে। পাকদণ্ডি বেয়ে নেমে আসলাম বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে ম্যালরোড ঢুকেই হোটেল এলিফেনস্টোন আমাদের পরবর্তী দু রাতের ঠিকানা। সামনেই "নৈনিতাল"। হোটেলের উল্টো দিকেই। হোটেল থেকে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের সাধারন মানের রুম দিলো অসাধারন দামে। রুম বড় কিন্তু স্নানঘর এতই ছোট যে গায়ে দেওয়াল লেগে যাচ্ছে। ইংরেজ আমলের কাঠামো। পরিষ্কার হলেও সম্পূর্ণ নয়। আমাদের ঘরগুলর সামনে গাছেঢাকা লেক। ফলে গাছের ফাঁকদিয়েই যা দেখা যাবে। অন্য পাশটা পরিষ্কার ভিউ রুম থাকলেও আমাদের দিলো না। খাবার অত্যন্ত দামি। কাসারের মতই। কিন্তু পরিমান বেশি হওয়ায় কম নিলেও পুশিয়ে যাচ্ছিলো। আমরা দুপুরটা ও রাতটা ওখানে খেলাম। বিকেলে অনেকটা হেঁটে ম্যালে এলাম। সেখানেই প্রথমে লেক ভ্রমন করলাম নৌকায়। এক একটি নৌকায় ৪ জন করে সর্বাধিক। ২২০ টাকায় পুরো লেক বললেও আসলে অর্ধেক লেক ঘোরা। মাঝে ড্রাম ফেলে সিমানা নির্দিষ্ট। একদিকে তল্লিতাল সেটাই ঘুরলাম। আমাদের হোটেলের সামনে মাল্লিতাল। ওটা আর ঘোরা হয় নি।
এর পর রোশনিদি কফি খাওয়াল। আমরা খেলাম তার সাথে খাসির মোমো। ভালই স্বাদ ছিল। আসেপাশে কেনাকাটার হরেক সম্ভার। অতয়েব মহিলা সদস্যদের কেনাকাটা শুরু। অতিরিক্ত ব্যাগ বেরে যেতে থাকলো। দাম খুব একটা সস্থা নয়। কিন্তু কিনলাম। এই অঞ্চলে একসঙ্গে নৈনি দেবী মার মন্দির, একটু দূরে মসজিদ, পাশে গুরুদোয়ারা, বিশাল ক্রিকেট মাঠ। কাছাকাছি চার্চও ছিল। অর্থাৎ সর্বধর্ম সমন্বয়। আজকে একটু ক্লান্ত থাকায় মহিলাবাহিনী জলদি বাড়ি ফিরে এলেন।
রাতে হটাত ভুতুরে উপদ্রব। আমাদের ছাদের ওপরে বুট পায়ে হেঁটে বেড়ানোর শব্দ। শুভাদীপ ভয়ার্ত ফোন করে বসলো। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম ওপরে বাচ্চা সহ অনেকের হাঁটা চলার শব্দ। রাত প্রায় ১২ টা। অর্থাৎ নতুন অথিতি এসেছে ওপরের ঘরে। তাই এত বিরক্তিকর শব্দ। যাই হোক শুভাদীপকে এটাই বুঝিয়ে শুয়ে পরলাম। পরের দিন সকালে হোটেলের লোকেদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। দিল্লি নিবাসীরা ৩ দিনের ছুটিতে চলেএসেছেন। যেমন আমরা দার্জিলিং যাই আর কি। আসতে রাত হওয়ায় এই উপদ্রব।
যাই হোক, পরের দিন সকালে প্রাতরাশ না করেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম ঝর্না দেখতে। ঝর্নার সামনেই হোটেল। খুব বড় না হলেও তেজ আছে, পাহাড়িতো। পাশেই উত্তরাখন্ড সরকারের কাপড়ের দোকানে চুটিয়ে কেনাকাটা। এখন প্রায় শেষের দিকে বলে আর ভয় নেই পয়সা করির। যা আছে উগড়ে জিনিস কেনা হল। সস্থা হল। তবে সময় অনেকটা ব্যয় হল।
পরবর্তী গন্তব্য খুরপিয়া তাল ও মনসামন্দির। পাহারের গায়ে মা মনসা দেবীর মন্দির। তার এক পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে ঘোড়ার খূরের মত দেখতে লেক। এর পর এক ভিউ পয়েন্টে গিয়ে পুরো লেক টা আমের আকৃতি দেখা গেলো। পথে পরল সুখাতাল, যার জল সুখিয়ে গেছে। সেই সব ছবি নেওয়া হল। গেলাম স্নো ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে শৃঙ্গ দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দুরভাগ্যের জন্য জুটল না। ফেরার পথে রোপওয়েতে নামলাম না। খিদে পেয়েছিল। বাঙালি হোটেল মৌচাক আমাদের সস্থায় খাসি সহযোগে রসনা তৃপ্ত করলো। বিকেলে আমি আর বেরোই নি। মহিলা মহল ঘুরতে গেলো। প্রায় নৈনিতাল বাজার ফাঁকা করে জিনিস কিনল। ফিরতে রাত করলো। চকচকে মুখ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আরও একটু কিনলে ভালো হত। কিন্তু হোটেলের দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। যাই হোক আজকেই ভ্রমনের শেষ রাত। কালকে ফিরব ট্রেন ধরতে।
[পরের পর্বে সমাপ্ত]




















পর্ব-১১
শেষ রাতে কেনাকাটা করে জিনিসপত্র ব্যাগে ঢোকাতে রিতিমত লড়াই চলল। লিপিকে ব্যাগের ওপরে বসিয়ে ৩ জনে মিলে ব্যাগের চেন লাগানো হল। সব ঘরের এক ছবি। রাতে আর আজকে কোন উপদ্রব হয় নি। খাবার সময়মত হোটেলেই সারলাম। হোটেল মালিক দু চারটে বাক্য বিনিময় করলেন এবং প্রচেষ্টা করলেন বাংলায় বলার। ব্যাবসা কিভাবে করা যায় এদের থেকে শেখা ভালো। সকালের সম্পূর্ণ খাবার শুভাদীপ টাকা দিয়েছিল, রাতে তাই ওদের টা আমরা দেবো ঠিক হল। দেখা গেলো আপতকালীন সময় ব্যাবহার করার জন্য কিনে রাখা শুখন খাবার অনেক থেকে গেছে। নিয়ে নেওয়া হল ব্যাগে।
সকালে ঠিক ১০ টায় হোটেল ছেড়ে দিলাম। ৯ঃ৩০ থেকেই খোঁজ নিচ্ছিল কখন ছাড়বো। নরম ভাবে। আসলে প্রচুর ভ্রমন প্রিয় বা ছুটি কাটানোর লোক দিল্লি থেকে এসে গেছে। একটু নিচে নামতে হল । মাল বাহকরা নামিয়ে আনলেন। এই প্রথম এই হোটেলে দেখলাম খোরাকি নিয়ে ভিখারিপনা। এর আগে যে হোটেলে রুমবয়দের যে টাকাই দিয়েছি, হাঁসি মুখে মেনে নিয়েছে। এখানে এমন করতে লাগলো যে মোট ৮০০ টাকা দিতে হল দুবারে। ভিখারিপনার চূড়ান্ত। আমি বলবো এই হোটেলে না যেতে।
গাড়ি এগিয়ে চলল বিভিন্য তাল বা হ্রদ দেখাতে। নল দময়ন্তি তালের পাশ দিয়ে একটু পরেই রাম, লক্সমন, ইত্যাদি ৭ জনের নামে সাততাল। খুব সুন্দর। একটি পাহাড়কে মাঝে দ্বীপের মত করে চারপাশদিয়ে ঘিরে হ্রদ গুলি পরস্পরের সাথে যুক্ত। এখানেও নৌকায় ঘোরা যায়। কিন্তু আমরা উঠিনি। অনেখন সময় এখানে কাটালাম। ট্রেন দেড়ি আছে। এখান থেকে বেরিয়ে পৌঁছে গেলাম নউখছিয়া তাল। এই হ্রদ অপেক্ষায় ছোট। কিন্তু এখানে নৌকায় চাপার ভাড়া অনেক বেশী। নৌকাগুলি সুন্দর ও ওপরে ঢাকা দেওয়া।
পরবর্তী গন্তব্য সুবিশাল হনুমান মন্দির ও মা কালির মন্দির। গুহাপথে মাদর্শন করতে হয়। আমি যাই নি। জামাকাপর পরিষ্কার ছিল না। বাইরে থেকেই ছবি তুলে গাড়িতে উঠে পরলাম। বাকিরা গেছিলো।
শেষ গন্তব্য ভিমতাল, আসার দিন এর পাসদিয়ে গেলেও আসল রুপদেখা হয় নি। সুবিশাল হ্রদ। নৈনিতালের মতই প্রায় লম্বায় চওড়ায়। শুধু ছবি তুলতে নামলাম। রৌদ্র ভালই তেজী। গরম, তাই সবাই সব জায়গা দেখতে পেল না। ভিমতাল ও সাততাল আমার নৈনিতালের থেকে ভালো লেগেছে।
গাড়ি ধীরে ধীরে নেমে এলো কাঠগদাম। তার আগে দুপুরের খাওয়া সেরেছি, ভালো লাগেনি। আমরা গাড়ি ধরব লালকুয়া থেকে। লালকুয়া/হাওড়া এক্সপ্রেস খুব ভালো আসে। কিন্তু সপ্তাহে শুধু শুক্রবার হাওড়া থেকে ছাড়ে ও শনিবার লালকুয়া থেকে ফেরে। আজকে শনিবার। দেখতে দেখতে ১২ দিন শেষ। কাঠগদাম থেকে মিনিট ৪০ গাড়ি চলে লালকুয়া এসে দাঁড়াল। চন্দনজীকে বিদায় জানিয়ে আমরা মালপত্র নিয়ে ট্রেনের সামনে চলে এলাম। সময় মত ট্রেন ছেড়েও দিলো।
গল্প এখানেই শেষ হতে পাড়ত। হল না। রাতের খাবার নিয়ে সমস্যা তিব্র হল। গাড়িতে একটিও হকার নেই। নেই খাবার অর্ডার নিতে আসা কোন লোক। কারন সামনে এই রাস্থায় রাজ্যরানি এক্সপ্রেস লাইনচুত হয়েছে। সবাই কি সেখানে গেছে? জানি না। আমি রুদ্রপূর ঢুকতেই আইআরসিটিসি মোবাইল খাবার থেকে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বেরেইলি পৌঁছে আমাকে ফোন করলো তারা খাবার দিতে পারবে না। কারন সেই ট্রেন উল্টে যাওয়া। একপ্রস্থ বাকবিতন্ডা হতেই আমি অর্ডার কেন্সেল না করে বিষয়টি রেল মন্ত্রকের নজরে আনলাম। ওদের আমি জিগ্যাসা করেছিলাম, আমরা কি খাবো তবে? ওদের উত্তর আমরা কি জানি। ভাবুন।
তবে বাচ্চাদের ব্যাবস্থা হয়ে গেলো। একদল ট্যুরপার্টিও ছিল আমাদের সঙ্গে। সেই পার্টির মালিকের বউ (এনার নাম জিগ্যাসা করি নি, পদবি লোহার) আমাদের পরিস্থিতি বুঝে বাচ্চাগুলোর জন্য পরঠা ব্যাবস্থা করে দিলেন। নিখরচায়। আসানসোল নিবাসি সম্ভবত সানি ট্রাভেলস এর মালকিনের এই মানবিকতা আমাদের ভোলা সম্ভব নয় কোন দিন। আপনাকে ধন্যবাদ আবার। আমাদের পেট পোরার জন্য ব্যাবস্থা হল কিছু শক্ত শক্ত লুচি, যা আমরা বেরেইলি থেকে তুলে নিয়েছিলাম।
রাতেই রেল মন্ত্রক ব্যাপারটা আইআরসিটিসি নর্থজোনকে দেখতে নির্দেশ দেয়। সমগ্র লেখালেখি টুইটারের মাধ্যমে। এই কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি খাদ্য পরিবেশন সংস্থা শুধু ধমকই খায় নি, তাদের কাজ করার লাইসেন্স কিছুদিনের জন্য বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আমাকে দুবার ফোনে সব ঘটনা জেনে নিয়েছে। সম্ভবত ট্রাভেলখানা ওদের নাম।
ফেরার পথে পরে গয়া- কোডারমা-হাজারিবাগ রোড। মানে বুঝতেই পারছেন ট্রেনে বসেই আর এক প্রস্থ জঙ্গল সাফারি।
যাই হোক ফিরে এলাম ঘরে, ফিরে এলাম আর এক নতুন তৈরি পরিবার নিয়ে। প্রায় অচেনা মানুষগুলি কত কাছের হয়ে গেলো। সঙ্গে সুন্দর অভিজ্ঞতা। আহা, জীবনের মণিকোঠায় অনেকদিন থেকে যাবে এই অভিজ্ঞতা।
রুট যেভাবে গেছিঃ
শিয়ালদহ- দিল্লি( এক রাত)- কাঠগদাম-সিতলাখেত ভায়া রানিখেত (এক রাত)- কউশানি ( এক রাত)- মুন্সিয়ারি (৩ রাত)- বিন্সার/কাসার ( ২ রাত) - নৈনিতাল (২ রাত)
জন প্রতি আমাদের পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা কেনাকাটা নিয়ে।
সঠিক সময় শীতকাল হলেও মার্চ ও এপ্রিলের প্রথমার্ধে যাওয়া সম্ভব ও গুরাস দেখা যাবে।
মনে রাখবেনঃ
১। রাস্থা একদম দার্জিলিং/লাদাখ/কাশ্মীরের এর মত নয়, অনেক বেশী পাকদণ্ডি। তাই মাথা ঘুরবে ও বমি পেতেই পারে।
২। রাস্থা সর্বত্র ভালো নয়।
৩। আমাদের সঙ্গে পাতালভুবনেস্বর থাকলেও শুধু পাতালভুবনেস্বর এ একদিন রাখবেন। নাহলে আমাদের মত যেতে পাড়বেন না।
৪। সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা ভালো, বিশেষ করে মুন্সিয়ারির দিকে।
৫। এখানে হোমস্টে ব্যাপারটা দেখলাম না।
৬। সবকিছু খুব দামি।
৭। খাবার দাবার পাঞ্জাবি ঘরানার। ফলে হজমের ওষুধ নিয়ে যাবেন।
[শেষ]