Amazon

Mahadev. Kuldiha Forest লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Mahadev. Kuldiha Forest লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৮

পায়ে পায়ে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর(সঙ্গে কুলডিহা)-ওড়িশা

[প্রথম পর্ব]
বুকিংয়ের সময় থেকে বাধা আসছিলো। অনলাইনে উড়িষ্যা সরকারের ইকো রিসোর্ট বুকিং করতে গিয়ে আমার অনেক টাকা বেড়িয়ে যায়, কিন্তু বুকিং হয় না। আবার সমপরিমান টাকা দিয়ে পরের দিন রিসসিয়া ক্যাম্প বুক করে কুলডিহা থাকার ব্যাবস্থা করি। টাকা ফেরত পাই, কিন্তু অনেক কাঠখর পুরিয়ে। পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের উড়িষ্যা সরকারের গেস্ট হাউস বুকিং করতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে শেষে ক্যাপু র(সুগত বসুর) অফিসের সামনে এক এজেন্ট ব্যাবস্থা করে দিতে পারলো। এর পর মিটিং মিছিল করে খরচ পাতি হিসেব করে তৈরি হয়ে নিলাম জানুয়ারির ২৫ তারিখ রাতে মাস মেল বা এখন চেন্নাই মেল ধরার জন্য। ক্যাপু আরও বিশ্রামের ব্যাবস্থা করে রেখেছিল। মাঝ রাতে যখন আমি শুতে যাই সেই তিনটে নাগাদ পৌঁছব বালাসোর। সেখান থেকে গাড়িতে করে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর গিয়েই তো আর সরকার আমাদের ঘরে ঢুকতে দেবে না, তাই শুধু ভোরবেলাটা বিশ্রাম নেবার জন্য একটা ধর্মশালায়(হোটেল?) লম্বা ঘর নেওয়া হল।
বেরনোর কিছুদিন আগে হটাত এক দম্পতির বিপদ ঘটলো, আবার বাধা। তারা যেতে পারলেন না কিন্তু সব্যদা ও আনিতা ম্যাডাম তৈরি হয়ে নিলেন যাবার জন্য। ৪ পরিবার ও আমি আমার শালাবাবু শুভদীপ। এই হল সর্বশেষ টিম।
রাতের মাদ্রাস মেল সর্বদা ভয়ঙ্কর। খড়গপুড়ের পর আর কোন পুলিশ নেই। এদিকে চোর জোচ্চোর ভর্তি। সঙ্গে বাথরুমের সামনের অংশে বসে যাওয়া সন্দেহজনক লোকজন। চোর ধরাও পরল। কিন্তু পুলিশের অভাবে ছাড়াও পেয়ে গেলো। এই সব নাটক দেখতে দেখতে টুক করে বালাসোর এসে পৌঁছে গেলাম ২৬ জানুয়ারি ভোর বলা যায় কি? ওই ৩ টে নাগাদ। ভদ্রকের মত গা ছমছমে নয় এই স্টেশন। চা জুটে গেলো। বেরতেই রাম হাজির ১০ সিটের উইঙ্গার নিয়ে। এসব অঞ্চলে ভালই বাংলা বলত পাড়ে মানুষজন। মালপত্র উঠিয়ে গাড়ি ছুটল অস্থায়ী ঠিকানায়। ২৮ কিলোমিটার পথ ৪০ মিনিট মত গাড়ি চালিয়ে অস্থায়ী হোটেলটায় ঢুকিয়ে দিল আমাদের। দুটি ডরমিটরি খুলতেই ঝাঁপিয়ে পরলাম খাটে। এতক্ষণ আমার সমস্যা হয় নি, এবার শোবার সময়।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি পেছনে একটা বড় টিলা বা প্রথম দেখাদের পাহাড় বলে চালানোই যায় এমন একটি ভুমিরুপ। সামান্য উঁচু। এই রকম পাহাড় বা টিলাগুলির উৎপত্তি কিভাবে হয় সেটা ভৌগলিকগন বলতে পারবে। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক, সকালের হাতমুখ ধোয়া হল, জলখাবার খাওয়া হল কিন্তু প্রাতঃকৃত্য করার ইচ্ছা হল না। জামা কাপর পরিবর্তন বা স্নান করারও সুযোগ হল না। ঘর ছেড়ে দিয়ে আমরা চলে এলাম আর একটু এগিয়ে সরকারি রেস্ট হাউসের সামনের হোটেলে। এখানে সব্যদারা থাকবেন। তারা আমাদের গাড়ির ব্যাবস্থাও করেছে। আজকে সকালের খাওয়াটাও এদের থেকেই খাব। রাতেও তাই।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম বাবার দর্শনে। হোটেল থেকে ১ কিমি মত দূরত্ব যাওয়ার পর রাস্থা খাঁড়া হতে শুরু করল। দুপাশে হরেক পশরা নিয়ে দোকান। যেরকম হয় আর কি বিভিন্ন মন্দিরের সামনে। এগিয়ে চলেছি তো চলেছি। মাঝে মধ্যে দম নিচ্ছি। আবার গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছি। আমার জন্য মোটেই আরামের নয়। খুব বেশী দর্শনীয় নয়। এরকম এগুতে এগুতে একটা গেটের সামনে হাজির। শিব পার্বতীর মূর্তি সহ সুন্দর সাদা গেট। গেটের ওপারেই আমার জন্য অপেখ্যা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ২৬০ টি সিঁড়ি, যার ১০০টা সহজ সরল হলেও বাকি গুলি প্রমান মাপের উঁচু।
আমাদের টিমে ঃ
Kalyani Banerjee (অন্নপূর্ণা)
Sugata Basu (ক্যাপু, ক্যাপ্টেনের অপভংশ্র)
Sabyasachi Bhattacharya (সব্যদা)
Anita Bhattacharya
Shuvadeep Bhattacharyya (আমার শ্যালক)
Soma Bhattacharya
Shankar Bhattacharya
Anandamay Ghosh Hazra ও বউদি
এবং আমি।


[দ্বিতীয় পর্ব]
অনেক দিনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলাম। শারীরিক ভাবে আমার পক্ষে ওঠা সম্ভব নয়। মনের জোরে দেখা যাক কি হয়। ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম। অন্য সব ট্রেক স্পেশালিস্টরা চটপট উঠে পরলেন। হাজরা বউদি, অনিতা ম্যাডাম, সোমা ভট্টা দিদিদের দলে একদম পিছিয়ে থেকে থেকে এগুতে থাকলাম। পাশদিয়ে কলকল করে বয়ে চলেছে জলধারা। কখনো বাঁয়ে কখনো ডানে। অনেকেই তার ওপরে পরে থাকা পাথরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমি বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে ১০০-১৫০ সিঁড়ি অতিক্রম করছি। বাবার টানেই। কিন্তু একসময় দম শেষ। আর পারছি না। অল্পে হাফিয়ে উঠছি। অর্থাৎ আবার একটি বিফল প্রয়াশ।
ক্যাপু সুগতদা, তাই পিছিয়ে পরা সম্প্রদায়কে তুলে নিয়ে যাওয়ার দায় যেন তার। একবার সম্পূর্ণ উঠে আবার নেমে এসেছে কে কে উঠতে পারছে না দেখতে। আমার নিচে সোমা দিদি। দুজনেই উঠবো না ঠিক করে নামার প্রস্থুতি নিচ্ছি। কিন্তু সুগত স্যার নাছর। "আর একটু, এই তো অই বাঁক পেরলেই দেখতে পাবে, দেখ সব দাঁড়িয়ে আছে, আর ৩০ টা বড়জোর"। বিশ্বাস হোল না। এর আগে এরকম বলে অনেকদুর হাঁটিয়ে ছেড়েছে এই বান্দা। প্রায় টেনেই উঠিয়ে দিল, জাও জাও বলে। দেখি বিশ্বাস করে সত্যি ৩০ টা কিনা। এই ভেবে শেষ একবার ধাক্কা দিলাম শরীরকে। এবার মিথ্যা বলে নি। একটা মন্দির ও বাঁক পেরিয়ে যেতেই দেখলাম উঁচুতে জুতো রাখার জায়গায় অনেকেই দাঁড়িয়ে। শুধু অন্নপূর্ণা, আর বাকি ২-৩ বউদি নিচে নেমেছেন। তারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পুজ দিয়ে সামনের জলধারায় শিবের পাঁচটি লিঙ্গ স্পর্শ করে পুজা সম্পূর্ণ হবে। এই জলধারাই নিচে নেমে গেছে। আমি অই অঞ্চলে গেলাম না, কারন আমার জামা কাপর বাসি ছিল, স্নান করতে পারি নি। আমি একটু শিবঠাকুরের ব্যাপারে বড্ড খুতখুতে। তাই পরিস্কার জামাকাপর না পরে স্নান না করে বাবাকে ছোঁব না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে প্রনাম সারলাম। কিছু চাই নি। যা দেবেন তাই পরম প্রাপ্তি। বাকিরা পুজো দিয়ে ফিরে এলো। আমরা দাঁড়িয়ে দূর দুরান্ত দেখতে লাগলাম।
নামতে লাগলাম। মাঝে পাথরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হল। ওঠার আনন্দে একটা পাথরেও উঠে পরলাম। ছবি তোলা হল। পথে বসে চাট খাওয়া । অন্নপূর্ণা ও শঙ্করদা খাওয়াল। খাওয়া শেষে নামা শুরু। সুগতদা, সব্যদা, শুভদিপ একটু দ্রুত নেমে গেলো। তারা এখান থেকে ট্রেক করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা বাঁধ দেখতে চলে গেলো। আমার ওপরে আদেশ হল বাকিদের নিয়ে রুম গুলো চেকইন করা। সব্যদার হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া। সেই মত যে যার ব্যাগ নিয়ে হাজির হলাম উড়িষ্যা সরকারের পান্থনিবাসে। ডেস্কের ম্যানেজার ভদ্রলোক নিপাট ভালমানুষ। কিন্তু তার অধিনের কর্মচারিরা কেউ কাজ করতেই চায় না। অনেক কষ্টে ৪টে রুম পাওয়া গেলো। ২টো ভিউ ২টো নন ভিউ। ভিউ মানে সামনের টিলা দেখা যাচ্ছে ও ভেতরে ঢোকার রাস্থাটা। ব্যাস। এদিকে আমি ঘর গুলো দখল নিয়ে বসে আছি কিন্তু অন্নপূর্ণা বউদির ও হাজরা বউদির দেখা নেই। কি হল। এদিকে আমাদের ঘর গুলোর চাবি দেয় নি। ফলে ব্যাগ ছেড়ে জেতেও পারছি না। বেস কিছু পরে বউদি হাফাতে হাফাতে এসে জানাল হোটেল থেকে কেউ গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসে নি। অর্থাৎ দুটো বড় বড় ব্যাগ বউদিকে নিজেকেই টানতে হয়েছে। চূড়ান্ত অসহযোগিতার শুরু এখানেই।

[তৃতীয় পর্ব]
কম করে আধ ঘণ্টা লড়াই চালিয়ে নরমে গরমে কথা বলে বাথরুম তোয়ালে ও সাবান পাওয়া গেলো। এদিকে ঠাণ্ডা নেই। তাই হেঁটে আসা পরিশ্রান্ত শরীরটা পরিস্কার করতে গরম জলের দরকার হল না। স্নান করে বিছানায় এলিয়ে পরলাম। শুভদীপরা ফিরে এলো। এসে জানালো আমি চেষ্টা করলেও ড্যাম দেখতে পেতাম না। যদিও যাওয়া আসার রাস্থা খুব সুন্দর, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। কিন্তু বেশ কষ্টকর। সেই পথে হাতির যাতায়াত অবাধ। আছে আদিবাসী গ্রাম। একটি আদিবাসী ছেলেকে যোগার করে নিয়ে গেছিল পথপ্রদর্শক হিসেবে। কষ্ট হয়েছে, কিন্তু ওরা তৃপ্ত। চটপট দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম সামনের হোটেলে, হোটেলের নাম শকুন্তলা নিবাস। মালিক ছেলেটি ভালো। দাম কম। প্রথম দিনের খাবার ভালই লাগলো। এর থেকেই গাড়ি নিয়েছিলাম। খাওয়া শেষে একটু গড়িয়ে নিলাম।
সন্ধে নাগাদ ক্যাপুর ডাক, চলো বেড়িয়ে আসি। কোথায়? না সামনেই পঞ্চলিঙ্গেশ্বর বাজার। দেখে আসি কি কি পাওয়া যাবে। সামনে মানে কতদূর? এই তো সামনে। যেমন কথা তেমন কাজ নয়। হাঁটতে শুরু করলাম। যে জাতীয় সড়ক ধরে এসে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর রোডে উঠেছিলাম সেই দিকে। চলতে লাগলাম। ধীরে ধীরে রাত হতে থাকল। দূরে ইট ভাঁটা। ধু ধু মাঠ আর মাঝে মধ্যে দোকান বা বাড়ি। হেঁটেই চলেছি। খারাপ লাগছে না। কিন্তু পা বিদ্রোহ করছে। যদিয় সমতলে আমার হাঁটতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। তবে সকালের চাপ ছিলই। কি আর করা, পরেছি মুঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার হেঁটে ফেললাম। কোন বাজার চোখে পরল না। বরং আমরা জাতীয় সড়কের কাছে চলে এলাম। আর পারলাম না। আমি অন্নপূর্ণা বউদি, শুভদীপ একটা মন্দির দেখে দাঁড়িয়ে পরলাম। সুগতদা ও শঙ্করদা এগিয়ে গেলো। যদি একটা অটো পাওয়া যায়, কারন এত রাস্থা হেঁটে ফেরা অসম্ভব। সুগতদারা একটু এগতেই স্থানীয় বাজার পেলো। কিন্তু সেটা সেই জাতীয় সড়কের সংযোগস্থলে। অর্থাৎ আমরা প্রায় ৪ কিমি হেঁটে ফেলেছি। মন্দির থেকে প্রসাদ খেয়ে ফেরার পথে অটো পেয়ে গেলাম। বাকি কাহিনী সংক্ষিপ্ত। ফিরেই খাওয়া দাওয়া করে ঘুম, পরের দিন সকালে বেরতে হবে।
সকালে উঠে পান্থনিবাসে প্রাতরাশ সারার কথা আমাদের। প্রাতরাশ আমাদের ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত। তাই এটি অতিরিক্ত পয়সা না দিয়েই পাওয়া যাবে। কিন্তু ৯ টার আগে কোন খবর নেই। সেই সঙ্গে খাবারের ঘরের ম্যনেজার মশাইয়ের কি মেজাক। খুব বেশী বয়েস নয়। কিন্তু যা বুঝলাম কাজ করতে প্রচুর অনিহা। প্রাতরাশের কোন বাছাই নেই। লুচি ৪টে ও তরকারি। ব্যাস। আর কিছু চাইলেই অতিরিক্ত পয়সা। এরকম আমি এখন অব্ধি কোন সরকারি অথিতিশালায় দেখি নি। চূড়ান্ত অভদ্র ব্যাবহার। কালকে ঘর গুলির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব দেখেই বুঝেছিলাম ম্যনেজার ভালো হলেও কর্মীরা মোটেই কাজের নয়। ওড়িশা সরকারের ইকো অতিথিশালায় অনেকবার থাকলেও ও টি ডি সি তে এই প্রথম। আগের বহুবার কোন সমস্যা পাই নি। এবার সব কিছুতেই দেরি ও কাজ করতে অনিহা আমাদের বিরক্তির উদ্রেক করছে। যাই হোক ১০ টার মধ্যে অনেক কষ্টে খাওয়া সেরে ছবি তুলে গাড়িতে বসে পরলাম। গাড়ি চলল প্রথমে দেবকুণ্ড। পথ মধ্যে দাঁড়িয়ে স্থানীয় রসগোল্লা খাওয়া হোল। উরিশার রসগোল্লা সঙ্গে চা। লাল ধুলো মাখা পথে জঙ্গল পেড়িয়ে গাড়ি এসে দাঁড়ালো দেবকুন্ড থেকে বেড়িয়ে আসা ঝর্নার নিম্নগতির ধারার সামনে, একটা পারকিং অঞ্চলে। সেখানে প্রথম ড্রাইভার রামের সাথে একপ্রস্থ ঝামেলা হল। সে তার পছন্দমত অনেক দূরে গাড়ি রাখা নিয়ে ঝামেলা। সামান্য কথা শোনা ধাতে নেই। আমরা আমাদের পয়সা দিয়ে ঘুরতে এসে এদের সুবিধা মত চলব। এটাই এদের নির্দেশ। আমরা এগিয়ে চললাম। এখান থেকে দেবকুন্ড হাঁটা পথ। প্রায় ২ কিমি। সমতলে। একটু চড়াই মাঝে মধ্যে। পাশে বয়ে চলেছে ঝর্না থেকে বেড়িয়ে আসা জলের স্রোত। পারকিং থেকে দেবকূণ্ড অব্ধি যাওয়ার জন্য টোটো আছে, কিন্তু আমরা হেঁটেই চললাম। মাঝে মধ্যে জঙ্গলপথে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা ও এগিয়ে যাওয়া। অবশেষে ঝর্নার সামনে এসে পৌঁছলাম। ঝর্নাটি একটি ২০০ ফুট মত উঁচু অঞ্চল থেকে ঝাঁপিয়ে পরছে নিচে। সেখানে একটা কুণ্ড তৈরি হয়েছে। উঁচু জায়গাটায় একটা মন্দির। শুভদীপ ওরা ওপরের মন্দির ঘুরে এসেছে। আসে পাসে পাহাড়ি জঙ্গল ও পাথরের স্তুপ। পরিবেশ খুব সুন্দর লাগলো। অপূর্ব দৃশ্য। নিচে স্নান করা কঠিন, বড্ড ঠাণ্ডা জল। জলের স্রোত দেখার মত। এখানেই আমার প্রশ্ন। যার উত্তর আমার পছন্দ হয় নি। বরফ গলা জল না হলে, বর্ষার জলে এত তেজী ঝর্না কি করে সম্ভব। শীতকালেও এত জল কোথায়। পাহাড়ের কোন খাঁজে এত জল লুকিয়ে থাকে? কারো উত্তর জানা থাকলে জানাবেন। সুগতদার কথায় খাঁজে জমে থাকা বর্ষার জলেই এই ঝর্না। আনন্দদা ও সুগতদা ওই জলেই স্নান করেছে এবং ভালো ঠাণ্ডা অনুভব করেছে।
দেবকুন্ড দর্শনে মোহিত হয়ে গেলাম। আমরা এখন ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ জেলায়। সিমলিপাল জঙ্গলের আশেপাশেই ঘুরছি। স্থানীয় এক আধা শহরে দুপুরের খাবার খেয়েই এগিয়ে গেলাম "স্বামীবৃক্ষ" বা স্বামীবৃক্স দেখতে। স্বামীবৃক্স দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটা হটাত মাথা তুলে দাঁড়ানো গোল পাহাড়। সামনে দিয়ে তার একটা উচ্চতা পর্যন্ত ওঠার সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওপরে মন্দির ও কিছু স্তাপত্যের কাজ আছে। তবে পাহাড়টি নিজেই দেখতে খুব সুন্দর। ধু ধু ফাঁকা মাঠের মাঝে হটাত মাথা তুলে দাঁড়ানো টিলা। বিকেল হয়ে এলো, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম কালো বাঁধের দিকে। বাঁধটি উপবৃত্তাকার। জলাশয়ে নৌকা চলছে। দূরে স্বামীবৃক্স দেখা যায়। এখানে অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখলাম। জলাশয়ের ওপরে টুক করে ডুবে গেলো লাল সূর্য। বেশী কিছু দেখার নেই। চটপট বেড়িয়ে এলাম। নীলগিরি বলে স্থানীয় এক অঞ্চলে পুরীর মন্দিরের আদলে জগন্নাথ মন্দির ও সংলগ্ন রাজবাড়ি দর্শন করলাম। ফিরে এলাম। বাকিটা সংক্ষিপ্ত হতে পারত, কিন্তু আমাদের আড্ডা ও তাতে গান, আলোচনা সঙ্গে জমিয়ে বনফায়ার, পরিবেশ জমে উঠলো। এগুলি সব শকুন্তলার ফাঁকা মাঠে। এই হোটেল অপেক্ষাকৃত শান্ত ও ভদ্র। কর্মচারীরা আজ্ঞাবহ। অন্তত সরকারী কর্মচারী নয় বলেই বোধয়। রাতটা সরকারী পান্থশালায় খেলাম। দাম একটু বেশী, কিন্তু গুনমান অনেক ভালো। ব্যাবহার ভালো হলে সব ভালো হোত। কিন্তু সব ভালো হয় না কখনো।

[চতুর্থ পর্ব]
২৮ জানুয়ারী সকাল সকাল উঠে পরলাম। উঠতে বাধ্য হলাম। অন্যান্য ঘর গুলিতে কাঁই কিচির একদম জ্বালিয়ে পুরিয়ে উঠিয়ে দিল। অন্য কিছু "কখন বেড়াতে না যাওয়া" দল ভোর থেকে হই হই করে সহ আবাসিকদের বিরক্ত করে মন্দিরের দিকে চলে গেলো। আমরা উঠে পরেছি আর ঘুম এলো না। দুদিনের হাঁটায় শরীর খুব ক্লান্ত। আজকেও প্রাতরাশ এখানেই। খাওয়া দাওয়া করে ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে পরলাম। গন্তব্য কুলডিহা জঙ্গল।
কুলডিহা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ২৭৫ বর্গ কিমি অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত ওড়িশার বালাসোর জেলার একটি জঙ্গল। এখানে আনুমানিক বাঘ, চিতা, হাতি, গৌর, সম্বর হরিণ, স্পটেড হরিণ, ময়ুর, এছাড়া হরেক রকমের পরিযায়ী পাখি ও সাপ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ১৯৮৪ সালে অভয়ারণ্য ঘোষিত হয়। এটি নাটো এবং শুখপারা পাহাড়ের মাধ্যমে সিমলিপাল জঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত। ময়ুরভঞ্জ হাতি অভয়ারণ্য এর সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন আগেও এখানে যেতে গেলে বাইরে থেকে খাবারের ব্যাবস্থা করে ঢুকতে হোত। থাকার জায়গা ছিল একটু ভেতরে, কুলডিহা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে। কিন্তু এখন সরকার ওখানে সবাইকে থাকতে দেয় না। থাকার ব্যাবস্থা আছে ঢোকার মুখে রিসসিয়া বলে একটি অঞ্চলে। সেখানে ইকো টুরিসম এর ব্যাবস্থা আছে। একটু দামী। জি এস টি নিয়ে প্রতি তাঁবু প্রায় ৪০০০ টাকা প্রতিদিন। এর মধ্যে দুজনের খাওয়া ও ঢোকার টিকিট ধরে নেওয়া হয়। লেখা থাকে ৩ বেলা কিন্তু বিকেলের খাবারটাও দেওয়া হয়। খুব দামী।
আমাদের গাড়ি লাল ধুলো উড়িয়ে হাজির হোল প্রথমেই রিসসিয়া ক্যাম্পে। কিন্তু সকাল সকাল একটু ঘুরতে হয়েছে। প্রথমে চালক আমাদের বালাসোরে একটি জঙ্গল অফিসে নিয়ে যায়। এখান থেকে ঢোকার অনুমতি নেওয়ার জন্য। কিন্তু ওখান থেকে জানিয়ে দেয় আমাদের যেহেতু থাকার ব্যাবস্থা আছে তাই আমরা সরাসরি গেটে দেখালেই হবে। ওরা দেখে অনুমতি বানিয়ে দেবে। সেই মত প্রবেশ দ্বারে এসে দেখা যায় সেখানে ব্যাবস্থা আছে। রেঞ্জার সাহেব খুব ভালো ব্যাবহার করলেন। সাহায্য করলেন কাজ তারাতারি মিটিয়ে নিতে। ক্যমেরা প্রতি একটি টাকা গুনে দিতে হয়। তার জন্য কাগজ বানিয়ে দেওয়া হয়। সব কিছু ঝটপট হয়ে গেলো। বালাসোর থেকে দূরত্ব বেশী নয়। তাই সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম।
কিন্তু সময়ের আগে পৌঁছে যাওয়ায় তখনি তাঁবু তৈরি ছিল না। ব্যাগ রেখে দেওয়া হোল গাড়িতে। আমাদের হেঁটে সামনে ঘুরে আসতে অনুরোধ করলেন ওনারা। সেই মত এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সামনে একটা জলাশয় আছে। সেখানে প্যডেল বোটে করে ঘোরা যায়। একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে আর তার সামনে বসার জায়গা। প্রচুর না হলেও কিছু ফ্লাই ক্যচার, বুলবুল, ইবিস জাতীয় পরিযায়ী তখন দেখতে পেলাম। ছবি তোলা শুরু। সামনেই সল্ট লিক। যেখানে জন্তুরা নুন খেতে ও দর্শন দিতে আসে। কিন্তু আজকে পিকনিকের পরিবেশ। অনেক দল এসেছে। এরা দেখে চলে যাবে। তাই এখন কিছু পাওয়া অসম্ভব। যা পাখি ছিল, উড়ে গেলো। তেমনি গরম। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এখানে থাকার ব্যাবস্থা সুইস টেন্টে। অর্থাৎ টেন্টের সাথেই টয়লেট, পেছনের দিকে। আলাদা করে একসঙ্গে নয়। তাপবিদ্যুতের কোন ব্যাবস্থা নেই। সবকিছু সৌরবিদ্যুৎ চালিত। দুটি কক্ষ, একটিতে খাট পাতা, ফ্যান আছে, অন্যটিতে একটা ড্রেসিং টেবিল পর্যন্ত আছে। জানলা আছে। আমাদের পাঁচটি তাঁবু নেওয়া আছে। চারটি পর পর, আমি ও শুভদীপ একটু দূরে আর একটিতে। মোট ৭-৮ টি দেখলাম খাটানো আছে। পুরো অঞ্চল পরিখায় ঘেরা। সম্ভবত সল্প মাত্রার বিদ্যুৎ তার দিয়ে বাঁধা।
এদের ব্যবহার খুব ভালো। এমনকি ২৯ তারিখ ভোরে বেরবো, তাই ভোরেই ওরা প্রাতরাশ করে দেবেন। খাবার দাবার সীমিত, কিন্তু ওদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। মোবাইল একদম কাজ করে না। অর্থাৎ ৯০ এর দশকে ফিরে যাওয়া। সে এক আলাদা মজা। কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে সীমিত খমতার ওয়াকি টকিতে কথা বলে নিচ্ছেন। দুপুরের খাবার মন্দ হয় নি। খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে রামের গাড়িতে চেপে চললাম জঙ্গল দর্শনে। এখানে আলাদা করে সাফারি গাড়ি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রথম গেলাম জোরাচুয়া। একদম জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। এখানেও সল্ট লিক আছে। আমরা অপেখ্যা করলাম। কিন্তু আমাদের কেউ দর্শন দিলেন না। এর পরে যাব কুলডিহা ফরেস্ট ক্যাম্প ও সেখান থেকে ব্যাক করে রিসসিয়া ক্যাম্প। রাস্থা বড্ড ধুলময়। আশে পাশের পাতাগুলো লাল হয়ে আছে।

[পঞ্চম ও শেষ পর্ব]
জোরাচুয়া আমাদের হতাশ করেছে। পরবর্তী গন্তব্য কুলডিহা ফরেস্ট ক্যাম্প। আগে এখানেই থাকার ব্যাবস্থা হতো। এখন বনকর্মীরা থাকেন। অতিথিশালা আছে। বিশেষ অনুমতিতে কারো কারো সৌভাগ্য হয়। এখানে একটা পরিখা পেড়িয়ে তবে সল্ট পিট। এখানে জন্তুরা বেশী দর্শন দেয়। শুনলাম দুদিন আগেও এসেছিলেন গজরাজ। কিন্তু আজকে ফাঁকা। কর্মীরা আমাদের চা খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ অপেখ্যা করলাম। সন্ধে হয়ে এলো। এখন অব্ধি বড় কাঠবেরালি ছাড়া কারোর দর্শন হয় নি। এবার ফিরতে হবে। মনটা ভরল না। কিন্তু উপায় নেই। বেশী রাত করা যাবে না। ড্রাইভার ফিরে যাবে। যদিও তার থাকার কথা। কিন্তু থাকা খাওয়া বড্ড দামী বলে ফিরে যাবে।
উঠে চলে আসব, হটাত দুটি হরিণ দেখা দিলেন। স্পটেড মনে হোল। কিন্তু সন্ধে ভালই। সেভাবে বোঝা বা ছবি তোলা সম্ভব হোল না। ওই চোখের দর্শন। যাই হোক, কিছু পাওয়া গেলো। গাড়ি ফিরতে থাকল। একবার লাইট বন্ধ করে চেষ্টা হয়েছিল যদি কিছু দেখা যায় মাঝ জঙ্গলে। কিন্তু বিপদজনক বলে সেই প্রয়াশ প্রথমেই থামিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে গাড়ি রিসসিয়ার ক্যাম্পে প্রবেশ করল। গাড়ি আমাদের নামিয়ে ফিরে গেলো। সেরকম কিছু দেখা না গেলেও জঙ্গলের অনুভুতি এক অন্যস্বাদের। জঙ্গল ভালবাসলে এ জঙ্গল হতাশ করবে না। অন্তত স্থানীয় ক্যাম্পের কর্মচারীদের ব্যাবহার, আশেপাশের পরিবেশ , নির্জনতা এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। রাতে গা ছমছমে পরিবেশ সঙ্গে আনন্দদার ভুতের গল্প ও শুই শুই ঠাণ্ডা হাওয়া। পেছনের জঙ্গলে পাতা নড়া বা সরীসৃপের যাতায়াত (বা অন্য কিছু) এক অন্য মাত্রা এনে দেবে। সকালের দিকে বোট চড়ে জলাশয় দেখে আসার মজাও আলাদা।
ক্যম্পের লোকেরা বলেছিল হাতির পাল আসবে। কাছেই আছে। কিন্তু আসে নি। ফলে রাতের খাবার পেটে পরতেই সারা ট্যুরের ক্লান্তি ঘুম পারিয়ে দিল চটপট। ব্যাস সকালে উঠতেই ভ্রমন শেষ। একদিনের বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মজাও শেষ। সকাল ৭ টায় বেড়িয়ে পরা। বালাসোর থেকে ৯ টায় জনশতাব্দি ধরা। পাঠক, মনে রাখবেন, এই জঙ্গলে কোথাও এক ফোটা মোবাইল পাবেন না, অন্য কোন যোগাযোগ সম্ভব নয়। রাস্থা নোংরা করবেন না। ধুলো ভালই, লাল ও বালি মাটি বলে। তাই ধুলোর থেকে অ্যালারজির ওষুধ নিয়ে যাবেন। জঙ্গলে কিছু পাবেন না। সঙ্গে জল নিয়ে ঢোকা ভালো, কারন ওদের জলের পরিমান সীমিত। সঙ্গে টরচ রাখবেন। রাতে খুব ঠাণ্ডা ছিল। তাই অতিরিক্ত একটা চাদর অন্তত নেবেন যদি শীতে যান। তবে সকালের দিকে গরম হবে। শীতে যাওয়াই ভালো। পরিযায়ী পাখি দেখতে পাবেন।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে শকুন্তলা নিবাস ভালো হোটেল, থাকা খাওয়া ভালই। তবে গাড়ির চালকগণ ভালো লাগে নি। সরকারি পান্থনিবাস পরিস্কার নয়, কর্মচারীদের ব্যাবহার ও কাজ ভালো না, বড্ড ঢিমেতালে ও সঙ্গে মেজাজ ভরপুর। তবে গাড়ি এরা ভালো যোগার করে দেয়। খাবার মান বেশ ভালো। সামনেই পাহাড়ের অংশ যা হিল ভিউ হোটেল থেকেও দেখা যায়। মোটের ওপরে খারাপ নয় কিন্তু শকুন্তলা বা হিল্ ভিউ আমার ভালো লেগেছে।